সিএনএন, রয়টার্স, ডেইলি স্টার ও ব্যাংকক পোস্ট অবলম্বনে লিখেছেন অনিন্দ্য সাইমুম ইমন।
দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার ছোট্ট দেশ ব্রুনেই। আয়তনে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম, মাত্র ৫ হাজার ৭৬৫ বর্গকিলোমিটার। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্রুনেইয়ের জনসংখ্যা সাড়ে চার লাখের কিছু বেশি। একসময় ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল দেশটি। ১৯৮৪ সালে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ব্রুনেই। স্বাধীন দেশ হিসেবে চার দশকের কম সময়ের যাত্রায় নিজেদের অর্থনীতিকে বেশ সমৃদ্ধ করেছে ব্রুনেই। জ্বালানি তেল ও গ্যাস রপ্তানি দেশটির অর্থনীতির মূল ভিত্তি।
তবে আজকের আলোচনার বিষয় ব্রুনেইয়ের মানুষ, সমাজ কিংবা অর্থনীতি নয়। বরং দেশটির সুলতান হাজি হাসানাল বলকিয়াহ মুইজ্জাদ্দিন ওয়াদ্দৌলাহকে নিয়ে এ লেখা। তাঁর জন্ম ১৯৪৬ সালের ১৫ জুলাই, দেশটির রাজধানী বন্দর সেরি বেগওয়ানে। পড়াশোনা করেছেন ব্রুনেই ও মালয়েশিয়ায়। ব্রুনেইয়ের ২৮তম সুলতান ছিলেন তাঁর বাবা ওমর আরি সাইফুদ্দিন সা’আদুল কাহাইরি ওয়াদ্দেইন। ১৯৬৭ সালে ৫ অক্টোবর ব্রুনেই দারুস সালামের ২৯তম সুলতান হিসেবে বাবার স্থলাভিষিক্ত হন হাসানাল বলকিয়াহ।
সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ যে প্রাসাদে থাকেন, সেটার নাম ইস্তানা নুরুল ইমাম প্যালেস। অভিজাত ও বিলাসবহুল প্রাসাদটিতে কক্ষের সংখ্যা ১ হাজার ৭৮৮। বাথরুম রয়েছে ২৫৭টি। রয়েছে পাঁচটি সুইমিংপুল। ১৯৮৪ সালে ৫০ একর জমির ওপর এ প্রাসাদ বানাতে খরচ হয়েছে ১৪০ কোটি মার্কিন ডলার।
সেই থেকে প্রায় ৫৫ বছর ধরে ব্রুনেই শাসন করছেন সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ। তিনি একাধারে দেশটির রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান। পাশাপাশি ব্রুনেইয়ের পররাষ্ট্র, অর্থ ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভার তাঁর কাঁধে। সুলতান হাসানাল বলকিয়াহর আমলেই ব্রুনেই স্বাধীনতা লাভ করে।
সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ কয়েকটি কারণে বেশ বিখ্যাত। তিনি বিশ্বের শীর্ষ ধনী রাষ্ট্রপ্রধানদের একজন। প্রভাবশালী মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস জানায়, ২০০৮ সালে সুলতানের মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল দুই হাজার কোটি ডলারের মতো। ধারণা করা হয়, এখন তাঁর সম্পদের পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
এ ছাড়া টানা ৫৫ বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ। ২০১৭ সালে ঘটা করে নিজের শাসনামলের ৫০ বছর পূর্তি উদ্যাপন করেছেন সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ। ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর বর্তমানে সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে শাসনক্ষমতায় থাকা রাজা।
তবে এসব ছাপিয়ে সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ বিখ্যাত তাঁর অভিজাত ও আয়েশি জীবনের জন্য। রাজা–বাদশাহদের জীবন আভিজাত্যে, ধনসম্পদে ভরপুর থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে ব্রুনেইয়ের সুলতান যেন অন্য সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন। বিশেষত তাঁর গাড়ির প্রতি অনুরাগ আলাদা করে নজর কাড়ে। ২টি, ৩টি কিংবা ১০টি নয়, প্রায় ৭ হাজার দামি গাড়ির বিশাল বহর রয়েছে সুলতান হাসানাল বলকিয়াহর সংগ্রহে। ব্রুনেইয়ের সুলতানের সংগ্রহে রয়েছে সোনায় মোড়ানো ছাদখোলা এই রোলস–রয়েস গাড়ি
ইস্তানা নুরুল ইমাম প্যালেসে কী আছে
রাজধানীতে সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ যে প্রাসাদে থাকেন, সেটার নাম ইস্তানা নুরুল ইমাম প্যালেস। অভিজাত ও বিলাসবহুল প্রাসাদটিতে কক্ষের সংখ্যা ১ হাজার ৭৮৮। বাথরুম রয়েছে ২৫৭টি। রয়েছে পাঁচটি সুইমিংপুল। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস কর্তৃপক্ষ প্রাসাদটিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাসাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। ১৯৮৪ সালে ৫০ একর জমির ওপর এ প্রাসাদ বানাতে খরচ হয়েছে ১৪০ কোটি মার্কিন ডলার। সুলতান হাসানাল বলকিয়াহর সংগ্রহে থাকা গাড়ি রাখার জন্য সেখানে বড় আকারের ১১০টি গ্যারেজ রয়েছে। তিনি ঘোড়া ভীষণ পছন্দ করেন। তাই পছন্দের ঘোড়াগুলো রাখার জন্য প্রাসাদে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত আস্তাবল বানিয়ে নিয়েছেন।
সুলতান হাসানাল বলকিয়াহর একবার চুল কাটাতে খরচ হয় ২০ হাজার মার্কিন ডলার। যুক্তরাজ্যের লন্ডনে তাঁর প্রিয় একজন নাপিত আছেন। প্রতিবার চুল কাটাতে সেই নাপিতকে ব্যক্তিগত উড়োজাহাজ পাঠিয়ে ব্রুনেইয়ে উড়িয়ে আনা হয়।
দামি গাড়ি সুলতান হাসানাল বলকিয়াহর ভীষণ পছন্দ। তাঁর সংগ্রহে রয়েছে সোনায় মোড়ানো রোলস–রয়েস গাড়ি। তাঁর জন্য বিশেষভাবে ছাদখোলা গাড়িটি বানানো হয়েছে। তাঁর ৭ হাজার গাড়ির বহরে ৬০০টি রোলস–রয়েস, ৪৫০টি ফেরারি, ৩৮০টি বেন্টলেসের মতো দামি গাড়ি রয়েছে। আরও রয়েছে ল্যাম্বরগিনি, পোরশে, বিএমডব্লিউ, অডি, অ্যাস্টন মার্টিনস, বুগাতি, জাগুয়ার, ল্যান্ড রোভার, মার্সিডিজ বেঞ্জের মতো দামি সব গাড়ি। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি রোলস–রয়েস গাড়ির মালিক হিসেবে ২০১১ সালে গিনেস কর্তৃপক্ষের স্বীকৃতি পেয়েছেন সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ।
ব্রুনেইয়ের সুলতানের রয়েছে নজরকাড়া সব দামি গাড়ির সংগ্রহ
উড়োজাহাজের কেবিন সোনায় মোড়ানো
শুধু গাড়ি নয়, সুলতান হাসানাল বলকিয়াহর সংগ্রহে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কোম্পানির তৈরি একাধিক বিলাসবহুল ব্যক্তিগত উড়োজাহাজ। এর মধ্যে ‘ফ্লায়িং প্যালেস’ নামে একটি উড়োজাহাজের কেবিন সোনায় মোড়ানো। এটি কিনতে সুলতান হাসানাল বলকিয়াহকে ৪০ কোটি মার্কিন ডলার গুনতে হয়েছে। এমনকি নিজের মেয়ের জন্মদিনে তিনি একটি বিলাসবহুল ব্যক্তিগত উড়োজাহাজ উপহার দিয়েছেন।
সুলতান হাসানাল বলকিয়াহর প্রাসাদ ইস্তানা নুরুল ইমাম প্যালেসে কক্ষের সংখ্যা ১ হাজার ৭৮৮
অভিজাত ও বিলাসী জীবন সুলতান হাসানাল বলকিয়াহর। একসময় পশ্চিমা রীতিনীতি মেনে চলতেন। তরুণ বয়সে তাঁকে ‘প্লেবয়’ ডাকতেন অনেকেই। ব্যক্তিগত জীবনে তিনজন স্ত্রী রয়েছে তাঁর। দুজনের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়েছে। তাঁর পাঁচ ছেলে ও সাত মেয়ে। যুক্তরাজ্যের লন্ডনে তাঁর প্রিয় একজন নাপিত আছেন। প্রতিবার চুল কাটাতে সেই নাপিতকে ব্যক্তিগত উড়োজাহাজ পাঠিয়ে ব্রুনেইয়ে উড়িয়ে আনা হয়। সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, সুলতান হাসানাল বলকিয়াহর একবার চুল কাটাতে খরচ হয় ২০ হাজার মার্কিন ডলার। দামি চিত্রকর্ম সংগ্রহ করার ঝোঁক রয়েছে সুলতানের।
বাংলাদেশের ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল’ ছাগল পছন্দ
এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন বিলাসবহুল ও অভিজাত হোটেলে বিনিয়োগ রয়েছে সুলতান হাসানাল বলকিয়াহর। রয়েছে ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা। সেখানে বেঙ্গল টাইগারসহ বিভিন্ন বিলুপ্তপ্রায় ও বিরল পশুপাখির সংগ্রহ রয়েছে তাঁর। জানা গেছে, ব্রুনেইয়ের সুলতান বাংলাদেশের ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল’ ছাগল খুব পছন্দ করেন। গলফ খেলতে খুব পছন্দ করেন, তাই ব্যক্তিগত গলফ কোর্স বানিয়ে নিয়েছেন তিনি। আশির দশকের মধ্যভাগ ও নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ছিলেন তিনি। পরে মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের কাছে তিনি সেই খেতাব হারান।
সুলতান হাসানাল বলকিয়াহর ভাই জেফরি প্রাসাদে একটি হেরেম গড়ে তুলেছিলেন। সেখানে অল্প বয়সী ৪০ জন নারী ছিলেন। ওই হেরেমে জিলিয়ান লৌরেন নামের এক মার্কিন নারীও ছিলেন। ১৮ বছর বয়সে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে সেখানে আনা হয়েছিল। পরে সেখানকার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি ‘সাম গার্লস: মাই লাইফ ইন আ হেরেম’ নামে একটি বই লেখেন।
পরবর্তী সময়ে সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জিলিয়ান বলেছিলেন, ‘সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ বিবাহিত হয়েও নিয়মিত হেরেমে আসতেন। মদ্যপান করতেন। সেখানকার নারীদের সঙ্গে সময় কাটাতেন।’ ১৯৯৮ সালে মিস ইউএসএ খেতাবজয়ী ম্যানন মার্কেটিক এক মাস ওই হেরেমে ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনিও সংবাদমাধ্যমকে একই ধরনের কথা বলেছিলেন। যদিও এমন অভিযোগ বিবৃতি দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে অস্বীকার করেছে ব্রুনেই সরকার।
এত কিছুর পরও ব্রুনেইবাসীর কাছে সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ ভীষণ শ্রদ্ধাভাজন মানুষ। সচরাচর তাঁর প্রাসাদের দরজা সাধারণ মানুষ ও পর্যটকদের জন্য বন্ধ থাকে। কিন্তু প্রতিবছর ঈদুল ফিতরের দিন প্রাসাদের দরজা খুলে দেওয়া হয়। সেদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লাখো মানুষ প্রাসাদে ছুটে আসেন সুলতানকে একনজর দেখতে, তাঁকে সম্মান জানাতে।
*****সিএনএন, রয়টার্স, ডেইলি স্টার ও ব্যাংকক পোস্ট অবলম্বনে লিখেছেন অনিন্দ্য সাইমুম ইমন।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:অক্টোবর ১৫, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,