একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার অন্যতম শর্ত কী? তা হলো আপনাকে মনোযোগ দিয়ে অন্যের বক্তব্য শুনতে হবে এবং উদ্ভূত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে জানতে হবে। আর এটি আপনার অহংকে পরিপক্বতা দেবে। বিষয়টি বুঝিয়ে বলা যাক, অনেক সময় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, সদুত্তর না জানা থাকলেও সিদ্ধান্ত নিতে হয় উদ্যোক্তাকে। আবার তিনি যখন নেতৃত্ব দেন, তখন তিনি তাঁর সবচেয়ে সেরা কয়েকটি ধারণা দিয়ে শুরু করেন। এখন তাঁর বুদ্ধিমতো যদি সব ঠিকমতো হয়, তবে খুব ভালো। কিন্তু যদি তা না হয়, তাহলে? এ জন্যই সফল হতে হলে উদ্যোক্তাকে জানতে হয় সব পরিস্থিতিতে কীভাবে তিনি এগিয়ে যাবেন।
বিশ্বের অন্যতম সফল উদ্যোক্তারা কিন্তু এক দিনে সব অর্জন করেননি। চলার পথে অনেক অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তাঁরা এখন একেকজন উদ্যোক্তা মোগল। ‘এমন কিছু করতে হবে, যা একদম আলাদা’—প্রায় সব সফল উদ্যোক্তাই অন্যদের উদ্দেশে এই কথাটা বলেন। এটা বোঝা খুব জরুরি যে সব সিদ্ধান্ত সব সময় সাফল্য এনে দেবে না। তবে ভুল বা সঠিক—সব সিদ্ধান্তই তাঁকে নতুন করে এগিয়ে যাওয়ার ও সফল হওয়ার সূত্র খুঁজে দেবে। নিচে কয়েকজন সফল উদ্যোক্তার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরা হলো।
১. প্রয়োজন সঠিক আচরণের প্রতিদান
নেটফ্লিক্স প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রিড হাস্টিং নিজের কাজের থেকে মজার একটি অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। হাস্টিংয়ের প্রথম কোম্পানি ছিল পিউর সফটওয়্যার। এই কোম্পানির ক্ষেত্রে তাঁর যা হয়েছিল তা হলো প্রতিবারই একটি উল্লেখযোগ্য ত্রুটি দেখা দিত। এসব ত্রুটি যাতে আর না হয়, তার জন্য কী প্রক্রিয়া স্থাপন করা যায়, তা নিয়ে অনেক চিন্তা করেছেন তাঁরা। প্রথমে সমস্যা বুঝতে বেশ কষ্ট হয়েছে তাঁদের। পরে প্রযুক্তিগত সমস্যাটি উদ্ঘাটন করেন তাঁরা।
এই বিষয়ে এক সাক্ষাৎকারে হাস্টিং বলেন, ‘আমাদের মধ্যে অনেকে ছিলেন যাঁরা ফার্স্ট প্রিন্সিপাল থিংকার নন। তাঁরা কেবল প্রক্রিয়াটি অনুসরণ করে যেতেন। ফার্স্ট প্রিন্সিপাল থিংকার প্রতিনিয়ত ভাবেন কোম্পানির জন্য কোনটি সবচেয়ে ভালো হবে এবং আমরা সফল হতে কোনো কাজ অন্যভাবে করতে পারি কি না?’ নেটফ্লিক্সের ক্ষেত্রে শুরু থেকেই এমনটা ভেবেছেন হাস্টিং। কোম্পানির পক্ষে সেরা কী, সেটাই সব সময় মাথায় রেখেছেন। এটা মাথায় রেখেই বিষয়বস্তু নির্ধারণ করেন তাঁরা।
২. সত্যকে মেনে নিতে হবে
ফেসবুকের প্রধান পরিচালনা কর্মকর্তা শেরিল স্যান্ডবার্গের অভিজ্ঞতা বেশ আলাদা রকম। সারা বিশ্ব থেকে যোগ দেওয়া সব কর্মীর সাক্ষাৎকার নিতেন শেরিল। যখন ১০০ জনের নেওয়া হয়ে গেল, তখন হঠাৎ করেই তিনি লক্ষ করলেন, তাঁর এই সাক্ষাৎকারের জন্য নিয়োগপ্রক্রিয়া আটকে থাকছে। বিষয়টি তাঁকে একটু ভাবাল। একদিন এক মিটিংয়ে তিনি বললেন, ‘আমার মনে হচ্ছে এই সাক্ষাৎকারের বিষয়টি বন্ধ করা উচিত।’ শেরিল ভেবেছিলেন সবাই না না করে উঠবে। বলবে, ‘এমনটা করা ঠিক হবে না। তুমি অসাধারণ সাক্ষাৎকার নাও।’ তবে শেরিলের ধারণাকে একদম ভুল প্রমাণ করে উপস্থিত সবাই এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে হাততালি দেন। ওই ঘটনার পর শেরিল বুঝতে পারেন, কর্মক্ষেত্রে নিজের কাজের গ্রহণযোগ্যতা মাঝেমধ্যে পরিমাপ করা উচিত। তিনি না বললে হয়তো এটি চলতেই থাকত।
৩. প্রয়োজন একটি জাদুকরি অভিজ্ঞতা
এয়ারবিএনবি ট্রাভেলের সহপ্রতিষ্ঠাতা ব্রায়ান চেসকি ব্যবসার জন্য কী করা প্রয়োজন, এটি বুঝতে চমৎকার একটি বুদ্ধি বের করেন। নাম না দিয়ে একটি বিজ্ঞাপন দেন। তাতে লেখেন, ‘একজন ভ্রমণকারীর সন্ধান করছি, যাকে আমরা সান ফ্রান্সিসকো ঘুরিয়ে আনব।’ রিকার্ডো নামের লন্ডনের এক বাসিন্দা সাড়া দিলেন। রিকার্ডোর সঙ্গে একজন আলোকচিত্রী দিয়ে তাঁকে সান ফ্রান্সিসকো পাঠানো হলো। রিকার্ড সেখানে গেলেন, নিজে নিজে বাজেট অনুযায়ী একটা হোটেল খুঁজে নিলেন, অনলাইনে দেখে একটা-দুটো দর্শনীয় স্থানে গেলেন। অন্তর্মুখী রিকার্ডো কারও সঙ্গে নিজে থেকে কথা বলেননি। বলা যায়, বেশ বাজে একটি অভিজ্ঞতা নিয়েই ফিরে এলেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে চেসকি ভাবলেন। এরপর রিকার্ডোকে একদম পারফেক্ট একটি ট্যুরের ব্যবস্থা করে দিলেন তিনি। বিমানবন্দর থেকে একজন রিকার্ডোকে গাড়িতে তুললেন। হোটেল ঠিক করা ছিল। সঙ্গে গাইড থাকল, ঘুরে দেখানো হলো দর্শনীয় স্থানগুলো। ঐতিহ্যবাহী খাবারের জায়গায় নিয়ে পার্টির ব্যবস্থা করা হলো। সব মিলিয়ে অসাধারণ অভিজ্ঞতা। আর এই অভিজ্ঞতায় কাজে লাগান চেসকি। এটি ছিল ব্যবসার জন্য ম্যাজিকেল অভিজ্ঞতা।
৪. কর্মী বসের চেয়ে দক্ষ হলেও চিন্তা নেই
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক জাকারবার্গের বক্তব্য হলো, নিজের জন্য এমন কাউকে নিয়োগ করা উচিত নয়, যার জন্য আপনি কাজ করবেন না। বিষয়টি এমন, কর্মীর থেকে কাজ আদায় করে নিচ্ছেন অথচ তাঁকে তাঁর প্রাপ্য দিচ্ছেন না, এমন মনোভাব থাকলে টিকে থাকা কঠিন। জার্কারবাগ ব্যবসার ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। সেটা হলো কর্মী যদি বসের চেয়েও বেশি দক্ষ হয়, এতে নিজের অবস্থান নড়ে যাবে, এমন ভেবে শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। জাকারবার্গ বলেন, ফেসবুকের প্রধান পরিচালনা কর্মকর্তা শেরিল স্যান্ডবার্গ তাঁর চেয়ে অনেক ভালো কাজ করেন। এতে তিনি দুশ্চিন্তা অনুভব করেন না, বরং খুশি হন। কারণ, শেরিলের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা তাঁকে সমৃদ্ধ করে, ফেসবুককে সমৃদ্ধ করে। আর এই শক্তিই ফেসবুককে আরও চমৎকার করে তোলে।
৫. দ্বিগুণ অর্থ জোগাড় করা উচিত
শিল্পী ও ডিজাইনারদের অনলাইন মার্কেটপ্লেস মিনটেডের প্রতিষ্ঠাতা মরিয়ম নাফিসি মনে করেন, ব্যবসায়িক বিষয়টি যা মনে করা হয়, তার চেয়ে বেশি ব্যয়বহুল। মজার বিষয় হচ্ছে, এটা বুঝতে বুঝতে অনেক সময় লেগে যায়। আর এ জন্যই দূরদর্শিতার প্রয়োজন। অর্থাৎ ব্যবসা শুরু করার আগে অনুমিত যে ব্যয় ধরা হয়েছে, চেষ্টা করা উচিত তার চেয়ে কিছুটা বেশি সংগ্রহ করার। তাহলে হুট করে বিপদে পড়ার আশঙ্কা থাকে না।
৬. ভালোবাসায় মনোযোগ দিন, পছন্দে নয়
ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালির বেশ পরিচিত মুখ স্যাম অল্টম্যান। স্টার্টআপ এক্সেলেটর কোম্পানি ওয়াই কম্বিনেটরের প্রেসিডেন্ট স্যামের উদ্যোক্তা জীবনের অভিজ্ঞতা বলে, যেসব কোম্পানি বিশ্বে অন্যতম বড় হয়ে উঠেছে, দেখবেন, তাদের গোড়া কিছু গ্রাহক রয়েছে। যেমন ফেসবুক, গুগল। দেখা যায়, কারও কাছে এই সব কোম্পানির খুব প্রশংসা শুনেই এর গ্রাহক হই আমরা। মানুষ এমন পণ্য বারবার ব্যবহার করে না, যারা তা ভালোবাসে না। তাই বলা যায়, বিক্রি বাড়াতে সস্তা কৌশল নিয়ে হয়তো গ্রাহক বাড়ানো যায়, তবে গ্রাহক ধরে রাখা যায় না। এই ব্যবহারকারীদের মান প্রায়শই খুব খারাপ হয়। তারা এটি অল্প সময়ের জন্য ব্যবহার করে। তাই আপনি কিছু কৌশল নিয়ে তাদের আটকান। কোম্পানির প্রতি আগ্রহ ধরে রাখুন।
৭. মানের ওপর নজর দিন
স্বাস্থ্য ও প্রসাধনী পণ্য প্রস্তুতকারী কোম্পানি ওয়াকার অ্যান্ড কোর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ত্রিস্তান ওয়াকার মনে করেন, যদি মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন না থাকে, তাহলে আর কোনো আলোচনার প্রয়োজন নেই। কতগুলো পণ্য বাদ হলো, এসব কিছু নিয়ে আলোচনা করা গন্ডগোল ছাড়া আর কিছু নয়। অর্থাৎ মান ঠিক রাখাটা সবচেয়ে জরুরি। হয়তো তৈরির প্রক্রিয়ায় অনেক পণ্য বাদ হতে পারে। তবে শেষ পর্যন্ত মান ঠিক রেখে পণ্য উৎপাদনই মূল কথা।
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: জানুয়ারী ১৯, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,