বিন্দু বিন্দু জলে সিন্ধু হয়—করোনাকালে যেন এই প্রবাদে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মানুষ। যে যেভাবে পারছে সঞ্চয়ে মনোনিবেশ করেছে। কী করলে সঞ্চয় করতে পারবে, কোথায় সঞ্চয় করবে, সঞ্চয় কেন করবে—এমন সব খবর লুফে নিচ্ছে সাধারণ মানুষ। সেদিন কথা হচ্ছিল পুরোনো এক বন্ধুর সঙ্গে, খুব জানতে চাইলেন কোথায় টাকা রাখবেন। তিনি এখন এক টাকাও বাড়তি খরচ করেন না। খুব হিসাব করে চলছেন। এমন কথা শুনলাম আরও বেশ কয়েকজনের মুখে। আর এটিই শঙ্কা জাগাচ্ছে ভবিষ্যৎ নিয়ে।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সঞ্চয় থাকা যে কত জরুরি, তা খুব টের পাচ্ছে মানুষ। তবে সবকিছুরই ‘নেগেটিভ-পজিটিভ’ দুটি প্রভাব থাকে। অর্থশাস্ত্রে ‘প্যারাডক্স অব থ্রিফট’ বলে একটি বিষয় আছে। অর্থনীতিবিদ জন মেইনার্ড কেইনস ১৯৩০ সালে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন মিতব্যয়ী হওয়ার এক কঠিন জটিলতা। প্যারাডক্স অব থ্রিফট নামে তাঁর এই বক্তব্য খুব সংক্ষেপে কিছুটা বুঝিয়ে বলা যায়। ধরেন, দেশে বেশ অর্থনৈতিক সংকট চলছে। রহিম আলী ভবিষ্যতের কথা ভেবে ব্যয় কমিয়ে দিল। রহিম আলীর পাঁচ বন্ধুও একই রকম ভাবল। তেমনি করে ওই পাঁচ বন্ধুর প্রত্যেকের আরও পাঁচজন করে বন্ধু একই রকম ভাবল। এভাবে একটি পুরো অর্থনীতির সবাই যদি ব্যয় কমিয়ে সঞ্চয় করতে থাকে, তাহলে এ ধাক্কায় বাজারে মোট চাহিদা কমে যায়, ফলে বাজারে টাকা ঘোরে না এবং শেষমেশ সবারই আয় কমে যায় এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মন্দায় পড়ে অর্থনীতি।
বর্তমান করোনাকালে বিষয়টি যেন আরও প্রতিফলিত হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে মার্কিন অর্থনীতিকে তুলে ধরা যাক। মার্কিন অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, মানুষ যখন আগামীর ভালো দামের আশায় ব্যয় না করে সঞ্চয় করার সিদ্ধান্ত নেয়, তা বাজার ব্যর্থতা হিসেবেই বলা যায়। তারা অর্থ রাখছে, ব্যয় করছে না। কারণ, তারা মনে করে যে তাদের সতর্ক হওয়া উচিত। ঠিক এটাই ঘটছে করোনার কালে।
বিশ্বব্যাপী করোনা সংকট তীব্র অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে, মানুষ যেভাবে পারছে হাতে অর্থ রাখতে চাইছে। যুক্তরাষ্ট্রে এপ্রিল মাসে দেখা গেছে, ভোক্তা ব্যয় রেকর্ড পরিমাণ কমে গেছে। দেশটির ব্যুরো অব ইকোনমিক অ্যানালাইসিসের তথ্য অনুযায়ী, ওই মাসে ব্যক্তিগত ব্যয় কমে যায় প্রায় ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যদিকে পরিবারগুলোর সঞ্চয়ের হার বেড়ে যায় ৩৩ শতাংশ। ৪৫ বছরের মধ্যে যা সর্বোচ্চ। ফেব্রুয়ারিতে যা ছিল মাত্র ৮ শতাংশ।
এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, সঞ্চয় করলে অসুবিধা কী? সঞ্চয়ে প্রাথমিকভাবে একজন ব্যক্তি লাভবান হলেও এই সঞ্চয়ই নেতিবাচক প্রভাব আনতে পারে তার জীবনে আরেক দিক দিয়ে। যেমনটা ওপরে বলা হলো, কেইনসের প্যারাডক্স অব থ্রিফট থিওরিতে। সেই অনুযায়ীই বিষয়টি বিশ্লেষণ করি। মার্কিন অর্থনীতির জিডিপির ৭০ শতাংশ নির্ভর করে ভোক্তা ব্যয়ের ওপর। যদি মানুষ ব্যয় না করে, অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়বে, জিডিপি কমে যাবে এবং একটি দুষ্টচক্র তৈরি হবে। যার প্রতিফলন দেখা গেছে দ্বিতীয় প্রান্তিকে। অর্থাৎ, এপ্রিল থেকে জুন—এই সময়ে মার্কিন অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ।
অর্থনীতিতে একটি কথা আছে, টাকায় টাকা আনে, কাজে কাজ আনে। অনেক অর্থনীতিবিদ ভোগের নীতিতে বিশ্বাসী। আবার অনেকে সঞ্চয়ের। কিন্তু অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ বলেন, ব্যয় আর সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য রেখে যুক্তির প্রতিফলন ঘটানোটা জরুরি। মার্কিন বিশ্লেষকেরা বলছেন, মানুষ যত বেশি অর্থ ব্যয় করতে অনীহা প্রকাশ করবে, অর্থনীতিকে ঘুরিয়ে আনতে তত বেশি সময় লাগতে পারে। জটিলতাটা হলো, যেখানে মানুষ মন্দার কারণে সঞ্চয় করছে, সেখানে সেই সঞ্চয়ই মন্দাকে দীর্ঘায়িত করতে পারে।
সাধারণত একজন মানুষের আয়ের কত শতাংশ সঞ্চয় করা উচিত, তা নির্ভর করে তার আয় এবং অবশ্যম্ভাবী ব্যয়ের ওপর। অর্থনীতির সাধারণ হিসাব হচ্ছে, একজন মানুষের আয়ের এক–চতুর্থাংশ, অর্থাৎ ২০-২৫ শতাংশ অর্থ যদি কেউ নিয়মিত সঞ্চয়ের অভ্যাস করতে পারে, তাহলে তাকে ভবিষ্যতে অর্থকষ্টে পড়তে হবে না ।
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: আগষ্ট ১৭, ২০২০
রেটিং করুনঃ ,