বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গতকাল সোমবার দুপুরে আন্দোলনকারীরা অবস্থান করছিলেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায়। তাঁরা সরকারবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছিলেন। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে শুরু করেন। এতে নিহত হন অনেকে। ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল সূত্র জানায়, গুলিতে মারা যাওয়া ৩০ জনকে যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে ওই হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
গতকাল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক দফা দাবি আদায় হওয়ার শেষ মুহূর্তে এভাবে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘাতে নিহত হন অন্তত ১০৯ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও দুজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। এর আগে গত রোববার রাত ১২টা পর্যন্ত ৯৮ জনের মৃত্যুর খবর প্রকাশ করে প্রথম আলো। মাঝরাতে আরও ১৬ জনের মৃত্যু খবর পাওয়া যায়। রোববার মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১৪। এ নিয়ে গত ১৬ জুলাই থেকে গতকাল পর্যন্ত ২১ দিনে মোট মৃত্যু দাঁড়াল ৪৪০–এ।
ঢাকা মেডিকেলে ৩৭ লাশ
গতকাল বেলা ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লাশ আসে ৩৭টি। হাসপাতাল সূত্র জানায়, যাত্রাবাড়ী থেকে রাসেল (২৫), আবদুর রহমান (২২), সাইফুল ইসলাম (২২), আবু ইসহাক (২৪), আজমত (৪০), ইয়াসিন সরকার (২৪), শাহিন (২৮), সোহেল (২২), হামিদুর রহমান (২২), শাওন (১৩), রিটন (৩২), আবদুল হান্নান (৫০), মনোয়ার (৫০), আবদুর নূর (২৪) এবং অজ্ঞাতনামা আরও ১৬ জনের লাশ এসেছে। এ ছাড়া চানখাঁরপুর থেকে এসেছে রাকিব (২২) ও মানিক মিয়ার (২৬) লাশ। বাড্ডা থেকে রায়হান (২২) ও বংশাল থেকে রনি (২৮) নামের এক ব্যক্তি লাশ এসেছে এ হাসপাতালে। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা তিন ব্যক্তির গুলিবিদ্ধ লাশ এসেছে হাসপাতালটিতে। তাঁরা কোথায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, সে তথ্য জানা যায়নি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানায়, গুলিবিদ্ধসহ বিভিন্নভাবে আহত ৫০০ জনকে হাসপাতালে আনা হয়। তাঁদের মধ্যে ৭০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
যাত্রাবাড়ীর ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মো. শোয়াইব ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রথম আলোকে বলেন, ‘জোহরের নামাজ আদায়ের পর আমরা সবাই যাত্রাবাড়ী থানার সামনে ছিলাম। হঠাৎ পুলিশ আমাদের ওপর গুলি করতে শুরু করে। আমি অন্তত ১০–১৫ জনকে থানার সামনে মরে পড়ে থাকতে দেখি। পরে যখন গোলাগুলি থামে, তখন থানার সামনে পড়ে থাকা লাশগুলো নিয়ে আসি।’
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিকেলে বিক্ষোভকারীরা যাত্রাবাড়ী থানায় হামলা চালান।
উত্তরায় গুলিতে নিহত ১০
রাজধানীর উত্তরায় থানা ঘেরাওকে কেন্দ্র করে পুলিশের গুলিতে ১০ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। গতকাল বিকেল চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত পুলিশ ও বিক্ষোভকারীর মধ্যে সংঘর্ষের এ ঘটনা ঘটে।
উত্তরা আধুনিক হাসপাতালের পরিচালক মেজর (অব.) হাফিজ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ দুজনকে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে। আর ক্রিসেন্ট হাসপাতালের পরিচালক মেজর (অব.) নাজমুল বলেন, গুলিবিদ্ধ হয়ে তাঁদের হাসপাতালে আটজন মারা গেছেন।
সাভারে নিহত ১৮
ঢাকার সাভারে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের পৃথক সংঘর্ষের ঘটনায় ১৮ জন নিহত হয়েছেন।
বেসরকারি এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মো. ইউসুফ জানান, হাসপাতালটিতে পাঁচজনকে মৃত অবস্থায় আনা হয়। তিনজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
নিহত ব্যক্তিরা হলেন রমজান, মোজাহিদ, নাফিসা, তৌহিদুর রহমান, রাসেল, রফিক, নিসান ও শব্দ। তাঁদের বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া যায়নি।
এ ছাড়া সাভারে সংঘর্ষের ঘটনায় শ্রাবণ গাজী (২১) নামের একজন নিহত হন। তাঁর পরিবারের সদস্যরা বলছেন, তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন।
আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়েছেন। আশুলিয়ার নারী ও শিশু হাসপাতালের ব্যবস্থাপক হারুন অর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, তিনজনকে হাসপাতালে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে। তাঁদের শরীরে গুলি লেগেছে। তিনি জানান, মৃত একজনের নাম জানা গেছে। তাঁর নাম জাহিদুল ইসলাম (২৫)।
এদিকে সাভারের গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সমন্বয়ক গোলাম রহমান শাহজাহান জানান, তাঁদের হাসপাতালে গুলিবদ্ধ ছয়জন মারা গেছেন।
শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের পাঁচ তারকা হোটেল জাবির ইন্টারন্যাশনালে অগ্নিসংযোগ করেন বিক্ষুব্ধ লোকজন। এতে ১৩ জন পুড়ে মারা যান। তাৎক্ষণিকভাবে তাঁদের নাম জানা যায়নি।
যশোর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক হারুন অর রশিদ আগুনে পুড়ে অন্তত ১৩ জনের মৃত্যুর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের পাঁচ তারকা হোটেল জাবির ইন্টারন্যাশনালে অগ্নিসংযোগ করেন বিক্ষুব্ধ লোকজন। এতে ১৩ জন পুড়ে মারা যান। তাৎক্ষণিকভাবে তাঁদের নাম জানা যায়নি।
যশোর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক হারুন অর রশিদ আগুনে পুড়ে অন্তত ১৩ জনের মৃত্যুর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
কুষ্টিয়ায় গুলিতে ছয়জন নিহত
কুষ্টিয়া শহরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ছয়জন নিহত হয়েছেন। গতকাল দুপুরে কুষ্টিয়া মডেল থানা ও পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে হামলাকে কেন্দ্র করে পুলিশ গুলি চালালে এ নিহতের ঘটনা ঘটে।
নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন শহরের থানাপাড়া এলাকার এলাকার ইউসুফ আলী (৭০) ও লোকমানের ছেলে আবদুল্লাহ (১৩), সদর উপজেলার হরিপুর এলাকার নওশের আলীর ছেলে বাবু (৪০) ও কফিলুদ্দিনের ছেলে আশরাফ (৪২)। অন্যদের নাম পরিচয় জানা যায়নি।
বানিয়াচংয়ে গুলিতে নিহত ৬
হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে গতকাল দুপুরে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন ছয়জন। এ ঘটনার পর বানিয়াচং থানা ঘেরাও করে আগুন ধরিয়ে দেন বিক্ষুব্ধ জনতা।
নিহত ব্যক্তিরা হলেন বানিয়াচং উপজেলার যাত্রাপাশা মহল্লার সানু মিয়ার ছেলে হাসান মিয়া (১২), মাঝের মহল্লার আবদুর নূরের ছেলে আশরাফুল ইসলাম (১৭), পাড়াগাঁও মহল্লার শমশের মিয়ার ছেলে মোজাক্কির মিয়া (৪০), কামালহানি মহল্লার নয়ন মিয়া (১৮), যাতুকর্নপাড়া মহল্লার আবদুর রউফের ছেলে তোফাজ্জল (১৮) ও পূর্বঘর গ্রামের দলাই মিয়ার ছেলে সাদিকুর (৩০)। বানিয়াচং উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শামীমা আক্তার ছয়জনের মৃত্যুর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
শিবালয়ে নিহত ১
মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলায় নৌ পুলিশের গুলিতে রফিকুল ইসলাম ওরফে চঞ্চল (২১) নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। এর আগে শিবালয় নৌ থানা ও শিবালয় থানায় আগুন দেন বিক্ষুব্ধ লোকজন। গতকাল দুপুরে এ ঘটনা ঘটে। নিহত রফিকুল মহাদেবপুর ডিগ্রি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) সুজন সরকার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
শ্রীপুরে নিহত ৫
গাজীপুরের শ্রীপুরে গতকাল বেলা দুইটার দিকে বিজিবির সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। এ সময় অর্ধশতাধিক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হন। এর আগে বেলা ১১টার দিকে শ্রীপুরের ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের মুলাইদ গ্রামে বিজিবি সদস্যদের বহন করা দুটি বাসে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
সংঘর্ষে নিহত পাঁচজনের লাশ শ্রীপুরের মাওনা চৌরাস্তার আল-হেরা হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতাল সূত্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজনের নাম পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন মো. কাওছার (২২), মো. শরীফুল ইসলাম (২০) ও সিফাত উল্লাহ (২৩)। তাঁদের মধ্যে কাওছার ও সিফাত ছাত্র, শরীফ পোশাক কারখানার শ্রমিক।
চুয়াডাঙ্গায় চারজনের মৃত্যু
চুয়াডাঙ্গা শহরের সিনেমা হলপাড়ায় জেলা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক আরেফিন আলম রঞ্জুর বাড়িতে দুর্বৃত্তের দেওয়া আগুনে অন্তত চারজন নিহত হয়েছেন। নিহত চারজনই পুরুষ। আগুনে পুড়ে বিকৃত হয়ে যাওয়ায় তাঁদের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
চুয়াডাঙ্গা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন অফিসার জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে জানান, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর ভবনের চারতলায় চারজনের মরদেহ পাওয়া গেছে। লাশ পুড়ে বিকৃত হয়ে যাওয়ায় পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি।
এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে আরেফিন আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে তাঁর মুঠোফোনে কল করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
ঝিনাইদহে ইউপি চেয়ারম্যানসহ নিহত ২
গতকাল বিকেলে ঝিনাইদহ শহরের আদর্শপাড়ায় বিক্ষুব্ধ লোকজন জেলা সদরের ৯ নম্বর পোড়াহাটি ইউপির চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম ওরফে হিরনের বাড়িতে হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন। আগুনে পুড়ে তিনি মারা যান। একই সময় চেয়ারম্যানের গাড়িচালক আক্তার হোসেন গণপিটুনিতে মারা যান।
গাজীপুরে আনসার একাডেমিতে হামলা, নিহত ২
গাজীপুরের কালিয়াকৈরের সফিপুর আনসার–ভিডিপি একাডেমিতে গতকাল বিক্ষোভকারীরা হামলা চালান। এ সময় আনসার সদস্যরা গুলি ছোড়েন। গুলিতে অন্তত দুজন নিহত হন। নিহত ব্যক্তিরা হলেন উপজেলার রাখালিয়াচালা এলাকার এলিম হোসেন (৩০)। নিহত অপর যুবকের (৪০) পরিচয় পাওয়া যায়নি।
সফিপুর মডার্ন হাসপাতালের চিকিৎসক সাদ্দাম হোসেন বলেন, হাসপাতালে দুজনকে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে।
চাঁদপুরে ইউপি চেয়ারম্যান ও ছেলেকে পিটিয়ে হত্যা
চাঁদপুর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সেলিম খান ও তাঁর ছেলে চিত্রনায়ক শান্ত খানকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, গতকাল এলাকা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় বালিয়া ইউনিয়নের ফরক্কাবাদ বাজারে এসে তাঁরা জনরোষে পড়েন। সেখানে পিস্তল থেকে গুলি করে উদ্ধার হয়ে আসতে পারলেও পাশের বাগাড়া বাজারে এসে পিটুনিতে নিহত হন তাঁরা।
সেলিম খান ও তাঁর ছেলের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন শান্তর শ্বশুর এম আই মমিন খান।
এদিকে কচুয়া থানার উপপরিদর্শক মামুনুর রশিদ গতকাল গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন। চাঁদপুরের গোয়েন্দা পুলিশের ওসি মনিরুল ইসলাম ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
শরীয়তপুরে যুবকের মৃত্যু
শরীয়তপুরের জাজিরার হরিয়াসা এলাকায় বিকেলে দুই পক্ষের সংঘর্ষে মাসুদ ব্যাপারী (৩৫) নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। জাজিরা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মারা গেছেন।
কয়রায় উপজেলা চেয়ারম্যানকে পিটিয়ে হত্যা
খুলনার কয়রায় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জি এম মোহসিন রেজাকে গতকাল তাঁর বাসভবনে ঢুকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মোহসিন রেজার চাচাতো ভাই সাইফুল ইসলাম ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: আগষ্ট ০৬, ২০২৪
রেটিং করুনঃ ,