করোনা মহামারি প্রতি ৩০ ঘণ্টায় একজন করে নতুন শতকোটিপতি বা বিলিয়নিয়ার তৈরি করেছে। আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফাম এ তথ্য জানিয়েছে। খবর এএফপির।
সুইজারল্যান্ডের দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক সম্মেলন শুরুর প্রেক্ষাপটে অক্সফাম এ তথ্য জানাল।
২২ মে সম্মেলন শুরু হয়েছে। ২৬ মে পর্যন্ত সম্মেলন চলবে। এ সম্মেলনে অংশ নিতে বিশ্বের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, শতকোটিপতি, সিইও দাভোসে জড়ো হচ্ছেন।
দাভোস সম্মেলন শুরুর পর আজ সোমবার অক্সফাম জানায়, করোনা একদিকে যেমন নতুন শতকোটিপতি তৈরি করেছে, অন্যদিকে এই মহামারি বহু মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নিচে ঠেলে দিয়েছে।
চলতি বছর নতুন করে বিশ্বের ২৬ কোটি ৩০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে বলে ধারণা করছে অক্সফাম। এমনা হলে প্রতি ৩৩ ঘণ্টায় ১০ লাখ মানুষ চরম দরিদ্র হবে।
করোনা মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। এ কারণে বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয়। এ সংকটের কথা উল্লেখ করে অক্সফাম বিপরীত চিত্রও তুলে ধরেছে।
অক্সফাম বলছে, করোনা মহামারিকালে বিশ্বে নতুন করে ৫৭৩ জন ব্যক্তি শতকোটিপতি বা বিলিয়নিয়ার হয়েছেন। অর্থাৎ, প্রতি ৩০ ঘণ্টায় শতকোটিপতি হয়েছেন একজন।
অক্সফামের নির্বাহী পরিচালক গ্যাব্রিয়েলা বুচার এক বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, শতকোটিপতিরা তাঁদের ভাগ্যের অবিশ্বাস্য উন্নতি উদ্যাপন করতে দাভোসে আসছেন। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, করোনা মহামারি ও বর্তমানে খাদ্য-জ্বালানির অত্যধিক মূল্যবৃদ্ধি তাঁদের জন্য আশীর্বাদ হয়েছে। অন্যদিকে, কয়েক দশকে চরম দরিদ্র দূরীকরণে যে অগ্রগতি হয়েছে, তার গতি এখন বিপরীতমুখী। বিশ্বের বিপুলসংখ্যক মানুষ অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধির মুখে পড়েছে। টিকে থাকার জন্য তাদের লড়তে হচ্ছে।
মহামারির সুবাদে যাঁরা শতকোটিপতি হয়েছেন, তাঁদের ওপর ‘সংহতি কর’ আরোপের আহ্বান জানিয়েছে অক্সফাম। সংস্থাটি বলছে, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির শিকার লোকজনকে সহায়তার জন্য এই কর আরোপ করা উচিত। পাশাপাশি মহামারি থেকে টেকসই পুনরুদ্ধার তহবিলেও এই কর কাজে লাগানো যাবে।
সংকটকে কাজে লাগিয়ে মুনাফা করার প্রবণতা বন্ধের এখনই সময় বলে উল্লেখ করেছে অক্সফাম। বড় করপোরেশনগুলোর এমন মুনাফার ওপর অস্থায়ী ভিত্তিতে অতিরিক্ত কর চালু করার পক্ষে মত দিয়েছে সংস্থাটি।
কোটিপতিদের সম্পদের ওপর বার্ষিক ২ শতাংশ ও শতকোটিপতিদের সম্পদের ওপর বার্ষিক ৫ শতাংশ করারোপ করা হলে এক বছরে ২ দশমিক ৫২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ সংগ্রহ করা যাবে বলে জানায় অক্সফাম।
ধনীদের কাছে থেকে এই কর আদায় করা গেলে তা দিয়ে বিশ্বের ২৩০ কোটি মানুষের দারিদ্র্য দূরীকরণ, পর্যাপ্ত টিকা তৈরি ও দরিদ্র দেশগুলোর মানুষের সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করা সম্ভব বলে জানিয়েছে অক্সফাম।
ফোর্বস সাময়িকীর শতকোটিপতি তালিকার পাশাপাশি বিশ্বব্যাংকের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এই হিসাব দিয়েছে অক্সফাম।
বিশ্বের তথাকথিত এলিট শ্রেণি ১৯৯৫ সাল থেকে দাভোসে এ সম্মেলন করে আসছে। তবে করোনা মহামারির কারণে দুই বছর এ সম্মেলন হয়নি। দাভোস সম্মেলন উপলক্ষে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অসমতা নিয়ে নিয়মিত এমন তথ্য তুলে ধরে অক্সফাম। সংস্থাটির এবারের তথ্য বলছে, বিশ্বজুড়ে ধনী ও গরিবের মধ্যে অসমতা বাড়ছে। তাই দরিদ্রদের সহযোগিতার জন্য ধনীদের ওপর কর বাড়ানোর এখনই সময় বলে মনে করছে সংস্থাটি।
****এক দশকে অতি ধনী বেড়ে দ্বিগুণ
বিশ্বে অতি ধনী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, আর তার যৌক্তিক পরিণতি হিসেবে সমাজে বৈষম্য বেড়েছে। কিছু মানুষের হাতে বেশি ধনসম্পদ জড়ো হওয়ার অর্থ হলো, অন্যদের সম্পদ কমে যাওয়া। দেখে নেওয়া যাক, গত এক দশকে বিশ্বে শতকোটি ডলারের মালিকের সংখ্যা কতটা বেড়েছে।
২০১০ সালে বিশ্বে মোট বিলিয়নিয়ার বা শতকোটি ডলারের মালিকের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১ জন। তাঁদের সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৬০ হাজার কোটি ডলার। এক দশক পরে ২০২০ সালে বিশ্বে অতি ধনী মানুষের সংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে—২ হাজার ৯৫ জন। আর তাঁদের সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ আট লাখ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক দশকে অতি ধনীর সংখ্যা যেমন দ্বিগুণ হয়েছে, তেমনি তাঁদের মোট সম্পদের পরিমাণও দ্বিগুণ হয়েছে।
২০২০ সালে কোভিড মহামারি শুরু হয়। ওই বছর কয়েক মাস বিশ্বের প্রায় সব দেশেই লকডাউন বা বিধিনিষেধ ছিল। বিশ্ব অর্থনীতি সংকুচিত হয় তখন। তাই ২০২০ সালে অতি ধনীর সংখ্যা ও তাদের মোট সম্পদ—উভয়ই কমেছে। ২০১৯ সালে অতি ধনীদের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ১৫৩ এবং তাঁদের হাতে থাকা সম্মিলিত
সম্পদের পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ৭০ হাজার কোটি ডলার।
আবার ২০১৮ সালে অতি ধনীর সংখ্যা এবং তাঁদের সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ ২০১৯ সালের চেয়েও বেশি ছিল। ওই বছর অতি ধনীর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ২০৮ জন এবং তাঁদের
মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ১০ হাজার কোটি ডলার। অর্থাৎ ২০১৮ সালের পর থেকেই বিশ্ব অর্থনীতিতে একধরনের মন্দাভাব দেখা যাচ্ছে।
যাঁদের আমরা ধনী বলি, তাঁদের সংখ্যা প্রত্যাশিত হারের তুলনায় বেশি নয়। কিন্তু অতি ধনীর সংখ্যা বেশখানিকটা বেশি। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করলে প্রত্যাশিত হারের প্রায় দেড় গুণ। অন্যভাবে বললে, ভারতের আর্থিক পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতি বজায় রেখে দেশে যতজন অতি ধনী থাকা উচিত, অতি ধনীর প্রকৃত সংখ্যা তার তুলনায় বেশি।
উন্নত দেশে অতি ধনীরা থাকবেন, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু ইদানীং ভারত ও চীনের মতো দেশেও অতি ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ২০১০ সালের এক সমীক্ষায় জানা গেছে, ভারতের মতো অর্থনীতির যে অংশটি কালো টাকায় চলে, যাকে ছায়া-অর্থনীতি বলা হয়, তার অনুপাত অন্তত ২০ শতাংশ, যেখানে আরও সচ্ছল দেশগুলোতে তা ১০ শতাংশের বেশি নয়। সবাই মনে করেন, ভারতের ক্ষেত্রে এই অনুপাত আসলে ২০ শতাংশের অনেক বেশি। ইউপিএ সরকারের নির্দেশে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফিন্যান্স অ্যান্ড পলিসি ভারতের কালো অর্থনীতি বিষয়ে যে প্রতিবেদন তৈরি করেছিল, ২০১৩ সালে সরকারের হাতে তা জমা পড়ার পরও চিদাম্বরম বা অরুণ জেটলি তা সংসদে পেশ করতে দেননি। সম্প্রতি জানা গেছে, সেই প্রতিবেদনে নাকি বলা হয়েছে, ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন যত, দেশের কালো অর্থনীতির মাপ তার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ। এই ৭৫ শতাংশের হিসাব একেবারে কথার কথা বলে উড়িয়ে দেওয়া মুশকিল। ফলে ভারতে অতি ধনীদের আসল সংখ্যা হিসাবের চেয়ে বেশিই হবে। ফলে এসব দেশে বৈষম্যের হার বেশি বলেই ধরে নেওয়া যায়।
গত এক দশকে ধনী তালিকার উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ধনীদের তালিকায় ভারতীয় ও চীনাদের সংখ্যা বৃদ্ধি। ২০১০ সালে ভারতীয়
অতি ধনীর সংখ্যা ছিল ৪৯ জন, তাঁদের মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ২১০ কোটি ডলার। আর এক দশক পরে ২০২০ সালে
ভারতীয় অতি ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১০২ জন, তখন তাঁদের মোট সম্পদের পরিমাণ ৩১ হাজার ২৬০ কোটি ডলার। অর্থাৎ এই সময়ে ভারতীয় অতি ধনীর সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ
এবং তাঁদের মোট সম্পদ বেড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি।
অন্যদিকে ২০১০ সালে চীনা অতি ধনীর সংখ্যা ছিল ৬৪ জন, আর তাঁদের মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ৩২০ কোটি ডলার। ১০ বছর পর চীনা অতি ধনীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮৯ জন এবং তাঁদের মোট সম্পদের পরিমাণ ১ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার।
এদিকে করোনা মহামারিতে অনেক মানুষ দরিদ্র হয়েছেন। কিন্তু এই সময়ে বিশ্বের ধনকুবেরদের সম্পদ আরও বেড়েছে বলে দাতব্য সংস্থা অক্সফামের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে। বলা হয়েছে, মহামারি শুরুর পর ২০২০ সালের মার্চ থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বের শীর্ষ ১০ জন ধনীর সম্মিলিত সম্পদ দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। অন্যদিকে বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন ২১ হাজার নিম্ন আয়ের মানুষ মারা যাচ্ছেন।
অর্থাৎ অতি ধনীর সংখ্যা ও সম্পদ বৃদ্ধি যে বিশ্বমানবতার জন্য সুখকর সংবাদ নয়, সে বিষয়ে সবাই কমবেশি একমত। এখন বিশ্বমানবতার সংগ্রাম তাই অসাম্যের বিরুদ্ধে।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: মে ২৩, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,