একটি দেশের মানুষ ধনী না দরিদ্র, সে অবস্থান বোঝার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো তাদের ক্রয়ক্ষমতা কতটুকু। সে যে অর্থ আয় করে, তা দিয়ে সে কী কী কিনতে পারে। তবে একটি দেশের কোনো পণ্যের দর অন্য দেশের সঙ্গে মিলবে না। এ কারণেই বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিকে তুলনার জন্য পিপিপির ভিত্তিতে জিডিপির আকার হিসাব করা হয়। মূলত একটি দেশের জনগণের জীবনযাত্রার মানকে তুলনীয় করার জন্য নমিনাল জিডিপিকে ‘পিপিপি ডলারে জিডিপি’তে রূপান্তরিত করা হয়। ধরা যাক, বাংলাদেশে ১০০ টাকা দিয়ে একগুচ্ছ পণ্য ও সেবা ক্রয় করা যায়, যা কিনতে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যয় হয় ২ ডলার। এ হিসাবে মার্কিন ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় মূল্য দাঁড়াবে ৫০ টাকা। অর্থাৎ পিপিপিতে ১ ডলার সমান ৫০ টাকা।
এ হিসাবে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী কোন কোন দেশ। চলতি বছরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এপ্রিলের তথ্য নিয়ে গ্লোবাল ফিন্যান্স ম্যাগাজিন সবচেয়ে ধনী ১০ দেশের যে তালিকা তৈরি করেছে, তাতে শীর্ষে রয়েছে লুক্সেমবার্গ।
১. লুক্সেমবার্গ
ধনী দেশ হিসেবে গত বছর দেশটির অবস্থান ছিল তৃতীয়। এবার দেশটির অবস্থান শীর্ষে। পিপিপি জিডিপিতে মাথাপিছু আয়ও গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। এ বছর এ আয় হলো ১ লাখ ১৮ হাজার ডলার, গত বছর যা ছিল ১ লাখ ১২ হাজার ডলার। লুক্সেমবার্গ হলো ইউরোপের আরেক ট্যাক্স হ্যাভেন বা করস্বর্গ। ২০১৫ সালে প্রথম দেশটির মাথাপিছু আয় এক লাখ ডলার অতিক্রম করে। এরপর আর তাদের পেছন ফিরতে হয়নি। যদিও বৈশ্বিক আর্থিক সংকট এবং ইইউ ও ওইসিডি থেকে ব্যাংকিং গোপনীয়তা হ্রাসের চাপ এসেছিল। তবে তা অর্থনীতিতে খুব কম প্রভাব ফেলেছিল। অবশ্য করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে অনেক ব্যবসা বন্ধ হয়েছিল। অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছেন, তবে এরপরও মানুষের আয় খুব একটা কমেনি।
২. সিঙ্গাপুর
গত বছর চতুর্থ অবস্থানে ছিল দেশটি। এ বছরে মে পর্যন্ত অবস্থান দ্বিতীয়। পিপিপি জিডিপিতে মাথাপিছু আয় ৯৭ হাজার ৫৭ ডলার। গত বছরের চেয়ে আয় কমেছে, তবে অবস্থান বেড়েছে। গত বছর পিপিপি জিডিপিতে মাথাপিছু আয় ছিল ১ লাখ ৫ হাজার ৭০০ ডলার। এশিয়ার অন্যতম করের স্বর্গরাজ্য বা ট্যাক্স হ্যাভেনের দেশ। অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন করা হয় না, করও ধরতে গেলে খুবই কম। ১৯৬৫ সালে স্বাধীন হওয়ার সময় দেশটির তেমন কিছুই ছিল না। কিন্তু কঠোর পরিশ্রম, স্মার্ট নীতি ও সঠিক নেতৃত্বের গুণে সিঙ্গাপুর এখন অন্যতম ধনী দেশ। ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলার সম্পদ নিয়ে সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে শীর্ষ ধনী রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী ঝাং ইয়ং।
৩. আয়ারল্যান্ড
পিপিপি জিডিপিতে মাথাপিছু আয় ৯৪ হাজার ৩৯২ ডলার। গত বছর পিপিপিতে মাথাপিছু জিডিপি ছিল ৮৭ হাজার ডলার। কোভিড-১৯-এর আগে ব্রেক্সিট, বাণিজ্যযুদ্ধ, উদ্বাস্তুসহ নানা সমস্যায় যখন ইউরোপ ছিল জর্জরিত, তখনো আয়ারল্যান্ড ছিল সবকিছুর ঊর্ধ্বে। ২০১৯ সালে যখন ইউরোজোনের মাত্র ১ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল, আয়ারল্যান্ডের হয়েছিল ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০২০ সালে প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমলেও এ বছর আবার এ অর্থনীতি ভালো প্রবৃদ্ধি দেখবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
৪. কাতার
গত বছর গ্লোবাল ফিন্যান্সের তালিকায় শীর্ষে ছিল কাতার। ২০ বছর ধরেই তারা শীর্ষ ধনী দেশের অবস্থান ধরে রেখেছিল। তবে এবার দেশটির অবস্থান চলে এসেছে চতুর্থে। এর অধিবাসী মাত্র ২৮ লাখ। আবার এর ১২ শতাংশ স্থানীয়। গত বছর তেলের দামের যে তীব্র পতন হয়েছিল, তার প্রভাব পড়তে দেখা গেছে দেশটির অর্থনীতিতে। পিপিপি জিডিপিতে মাথাপিছু আয় ৯৩ হাজার ৫০৮ ডলার। গত বছরের হিসাবে যা ছিল ১ লাখ ৩৮ হাজার ৯০০ ডলার।
৫. সুইজারল্যান্ড
পিপিপি জিডিপিতে মাথাপিছু আয় ৭২ হাজার ৮৭৪ কোটি ডলার। গত বছর পিপিপি ডলারে দেশটির মাথাপিছু জিডিপি ৬৭ হাজার ৬০০ ডলার। সুইজারল্যান্ড মানেই কেবল ঘড়ি, সাদা চকলেট, সুইস চাকু বা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়। পর্যটন তো আছেই, ভারী শিল্পের জন্যও বিখ্যাত দেশটি। সুইজারল্যান্ডের আর্থিক সেবার সুখ্যাতি বা কুখ্যাতি তো বিশ্বজোড়া। কোটিপতির ঘনত্বের দিক থেকেও দেশটি সবার ওপরে। প্রতি ১ লাখ পূর্ণবয়স্ক মানুষের মধ্যে ৯ হাজার ৪২৮ জনই কোটিপতি। তবে কোভিডের প্রভাবে উৎপাদনে বড় আঘাত এসেছে। ২০২০ সালে উৎপাদন কমেছে ২ দশমিক ৯ শতাংশ।
৬. নরওয়ে
পিপিপিতে মাথাপিছু আয় ৬৫ হাজার ৮০০। ১৯৬০ সালে এখানে তেল আবিষ্কার হয়। যত দিন পর্যন্ত জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছিল, তত দিন দেশটির সমৃদ্ধি কেবলই বেড়েছে। তবে ২০২০ সালের জ্বালানি তেলের দামের ব্যাপক দরপতন হয়। সেই সঙ্গে ছিল মহামারির তাণ্ডব। সব মিলিয়ে গত বছর নরওয়ের অর্থনীতি আড়াই শতাংশ সংকুচিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যা সর্বোচ্চ। গত বছর পিপিপিতে মাথাপিছু আয় ছিল ৭৯ হাজার ৬০০ ডলার।
৭. যুক্তরাষ্ট্র
২০২০ সালে করোনার কারণে কঠিন সময় পার করলেও ধনী দেশের তালিকায় এগিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। পিপিপিতে মাথাপিছু আয় ৬৩ হাজার ৪১৬ ডলার। ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজ অনুসারে মার্চ ২০২০ থেকে এপ্রিল ২০২১–এর মধ্যে আমেরিকার ৭১৯ বিলিয়নিয়ারের সমষ্টিগত সম্পদের পরিমাণ ১ দশমিক ৬২ ট্রিলিয়ন ডলার। বেড়েছে প্রায় ৫৫ শতাংশ।
৮. ব্রুনেই দারুসসালাম
পিপিপি জিডিপিতে মাথাপিছু আয় ৬২ হাজার ৩৭১ ডলার। ১ হাজার ৭৮৮টি কক্ষ, ২৫৭টি বাথরুম, ৫ হাজার অতিথির সংকুলান হবে এমন একটি হলরুম, পোলো খেলার জন্য ২০০ ঘোড়ার শীতাতপনিয়ন্ত্রিত আস্তাবল—এই হচ্ছে দেশটির সুলতান হাসসান-আল বলখিয়াহর থাকার প্রাসাদের ছোট এক বিবরণ। তেলসহ বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে দেশটিতে। আবার আয়ের বৈষম্য ও পুষ্টিহীনতাও প্রকট। সাড়ে ৪ লাখ অধিবাসীর এ দেশে ৪০ শতাংশের বেশি মানুষের আয় বছরে ১ হাজার ডলারের কম। কোভিড-১৯-এ ক্ষতি হলেও অর্থনীতি এখন তা কাটিয়ে উঠছে।
৯. হংকং
এটি সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশ, চীনের এ বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চলটি মূল ভূখণ্ড এবং এশিয়ার শীর্ষ আর্থিক কেন্দ্রের প্রবেশদ্বার। পিপিপি জিডিপিতে মাথাপিছু আয় ৫৯ হাজার ৫২০ ডলার। স্বল্প কর, উত্তরাধিকার শুল্ক বিহীন, আমদানি বা রপ্তানির ওপর কোনো শুল্ক না থাকা হংকংয়ের অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য।
১০. ডেনমার্ক
পিপিপি জিডিপিতে মাথাপিছু আয় ৫৮ হাজার ৯৩২ ডলার, গত বছর যা ছিল ৬২ হাজার ৩৭১ ডলার। ডেনমার্কের সবচেয়ে বড় র্যাঙ্কিং হলো, বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের শীর্ষে রয়েছে ডেনমার্ক।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ অক্টোবর ২০, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,