লকডাউনের শুরু থেকেই অর্থনীতিবিদেরা বাজারে নগদ টাকার সরবরাহ বৃদ্ধির দাওয়াই দিয়ে আসছেন। তাঁদের ভাষ্য, মানুষের হাতে টাকার জোগান নিশ্চিত করতে এর বিকল্প নেই। কিন্তু সেই নীতির প্রতিক্রিয়ায় এখন মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ, যদিও সরকারের লক্ষ্য ছিল এই বার্ষিক মূল্যস্ফীতি গড়ে ৫ দশমিক ৪০ শতাংশের মধ্যে রাখা। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে যা ছিল ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে বন্যা ও সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার কারণে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তবে পরে তা কমে আসে।
বাংলাদেশের প্রণোদনা প্যাকেজ মূলত ব্যাংকঋণনির্ভর। এ ছাড়া নানা ধরনের নীতিগত ছাড় দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক মুদ্রা নীতি পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, বিভিন্ন ধরনের ছাড় ও ঋণের কারণে বাজারে ইতিমধ্যে টাকার প্রবাহ বেড়েছে। এতে নিকট ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা বাড়তে পারে। তবে দেশে সুদহার বাজারের ওঠানামার ওপর নির্ভর করে না। সরকারি নির্ধারিত হারের আশপাশেই থাকছে সুদহার। ফলে বাজারের নিয়ম এখানে খাটছে না।
প্রণোদনা ঋণের সুদের একটি অংশ সরকার বহন করছে। তাতে রাজস্ব ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর বিকল্প নেই বলেই মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা।
ভারতে রেপো অপরিবর্তিত
এদিকে মূল্যস্ফীতির আশঙ্কায় ফেব্রুয়ারি মাসে ঘোষিত ঋণ নীতিতে রেপো হার অপরিবর্তিত রেখেছে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই)। সংকট কাটিয়ে অর্থনীতি চাঙা করতে ভারতের এবারের বাজেটে অবকাঠামো, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু মোট দেশজ উৎপাদন এখন নেতিবাচকের ঘরে। তাতে রাজস্ব ঘাটতি বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। দেশটির অর্থমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, আগামী অর্থবছরে (২০২১-২২) রাজস্ব ঘাটতি ৬ দশমিক ৮ শতাংশের মধ্যে থাকবে। অনেকের আবার আশঙ্কা, ঘাটতি বাড়লে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাবে।
তবে ঋণনীতি ঘোষণায় রিজার্ভ ব্যাংকের ইঙ্গিত, মূল্যস্ফীতি আগামী দিনে তেমন বাড়বে না। যে কারণে চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি-মার্চ ত্রৈমাসিকে তার পূর্বাভাস ৫ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ দশমিক ২ শতাংশ করেছে তারা। সতর্কতা হিসেবে সুদ (রেপো রেট) কমানো হয়নি।
সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি, এত ঘাটতি বইতে হলে মূল্যস্ফীতির হার আগামী দিনে বাড়বে কি না, সে প্রশ্ন থাকছেই। তাই এখনই সম্ভবত ঝুঁকি নিতে চাইছে না শীর্ষ ব্যাংক। রিজার্ভ ব্যাংক গভর্নর শক্তিকান্ত দাস নিজেও অর্থনীতিকে চাঙা করার যুক্তিতেই সুদ স্থির রেখে সাহায্য করার কথা বলেছেন।
বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিত
এদিকে শুধু ভারতে নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা মাথাচাড়া দিয়েছে। নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যে ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজের পরিকল্পনা করছেন, তাতে জনপ্রতি ১ হাজার ৪০০ ডলারের চেক দেওয়ার কথা। অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, টিকাদান শুরু হওয়ার কারণে সেবা খাত ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা থেকে যায়। দেশটিতে করোনাভাইরাসের নতুন আরেক স্ট্রেইন পাওয়া গেলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, সংক্রমণের হার গত কয়েক সপ্তাহে কমেছে, তাতে এই আশঙ্কা মোটেও অমূলক নয়। পাশাপাশি বাণিজ্যে নতুন কিছু প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। কনটেইনার জাহাজের ভাড়া ১৮০ শতাংশ বেড়ে গেছে। এ ছাড়া মহামারিতে প্রযুক্তি পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বাজারে সেমিকন্ডাক্টরের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এতে গাড়ি, স্মার্টফোন, কম্পিউটারের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
সামগ্রিকভাবে এখনো বিশ্ব বাণিজ্য স্বাভাবিক হয়নি। পণ্য বাণিজ্য ইতিবাচক ধারায় ফিরলেও প্রাক্-মহামারি সময়ের তুলনায় কম। সেবা বাণিজ্য এখনো নেতিবাচক ধারায়। এই পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বেই পণ্যের দাম বাড়তি। এর সঙ্গে তেলের দাম বাড়তি, এক বছর পর ব্যারেলপ্রতি ৬০ ডলারে উঠে গেছে। জার্মানিতে ভ্যাট হার সাময়িকভাবে হ্রাস করা হলে এক মাসে মূল্যস্ফীতি মাইনাস শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ১ দশমিক ৬ শতাংশে উঠে গেছে।
দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারির আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে কর্মসংস্থানের উচ্চ হারে দেখা গেলেও মূল্যস্ফীতি রহস্যজনকভাবে কম ছিল। অর্থাৎ বাজারের নিয়ম অনুসারে মূল্যস্ফীতি ওঠানামা করেনি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতির হার কম থাকার মানে হলো, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা হ্রাস।
সম্ভাব্য নতুন বাস্তবতা
২০০৭–০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতি কমই ছিল। কিন্তু সেই দিন বোধ হয় শেষ হতে চলেছে। দ্য গ্রেট ডেমোগ্রাফিক রিভার্সাল: এজিং সোসাইটিস, ওয়েনিং ইনইক্যুয়ালিটি অ্যান্ড ইনফ্লেশন রিভাইভাল নামের বইয়ে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের মুদ্রানীতি বিভাগের সাবেক সদস্য চার্লস গুডহার্ট ও মর্গ্যান স্ট্যানলির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনোজ প্রধান, বলেছেন, যেসব কারণে বর্তমানে আমরা নিম্ন সুদহারের জমানায় বসবাস করছি, তা সম্ভবত শেষ হতে যাচ্ছে। সেই কারণগুলো হলো—চীনের উত্থানের মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক শ্রমবাজারের উত্থান, মজুরি বাড়ানোর ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষমতা হ্রাস, ক্রমবর্ধমান বিশ্বায়ন ও প্রতিযোগিতার কারণে মূল্য হ্রাস। তাঁরা বলেছেন, বর্তমান জমানা যে কেবল শেষ হতে যাচ্ছে, তা-ই নয়, হাওয়া বিপরীত দিকেও বইতে পারে।
আগামী ২০-৩০ বছরে চীন ও পশ্চিমা পৃথিবীতে জাপানের মতো বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবে। এতে স্বাভাবিকভাবে নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা বাড়বে, অর্থাৎ যত মানুষ কাজ করবে, তার চেয়ে বেশি মানুষ কর্মক্ষম মানুষের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। এখন কোভিড-১৯-এর প্রকোপ চলছে, তবে তার আগে থেকেই পশ্চিমা দুনিয়া এই ক্রমবর্ধমান বুড়ো মানুষদের চিকিৎসার খরচ, পেনশন ও ভরণপোষণ দিতে হিমশিম খাচ্ছে।
ফলাফল—এই মহামারি সামলাতে এবং বুড়ো মানুষদের ভরণপোষণ দিতে দেশে দেশে ঋণের বোঝা বাড়বে। এর সঙ্গে বিশ্বায়নবিরোধিতার পালে আরও হাওয়া লাগবে, সরবরাহব্যবস্থার সংকট মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশ নিজ দেশে কারখানা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে। তখন কম শ্রমিক বেশি কাজ করবে, বুড়ো মানুষদের দেখাশোনার মানুষও কমে যাবে। কারখানা দেশে ফিরে এলে স্বাভাবিকভাবে শ্রমিকদের মজুরি বাড়বে, সেই সঙ্গে কমবে অসমতা, বাড়বে মূল্যস্ফীতি।
মূল্যস্ফীতির প্রভাব
অর্থনীতদিবিদেরা বলেন, কিছুটা মূল্যস্ফীতি থাকা খারাপ নয়। এর অর্থ হলো, অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য আছে। মূল্যস্ফীতির সম্পর্ক নিরূপণে বহুল ব্যবহৃত ফিলিপস (নিউজিল্যান্ডের অর্থনীতিবিদ এ ডব্লিউ ফিলিপস) কার্ভের সারকথা হলো, বেকারত্ব কম থাকলে এবং মজুরি ঊর্ধ্বমুখী হলে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পায়। কিন্তু মূল্যস্ফীতির হার বেশি হলে সমস্যা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তখন সুদহার বৃদ্ধি করে। এতে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ গ্রহণ কমে যায়। বিনিয়োগে প্রভাব পড়ে। ফলে এটা একধরনের উভয়সংকট।
দেশে সরকার সুদহার যতই নিয়ন্ত্রণ করুক না কেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না থাকলে বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হবেন। তাঁরা যদি না জানেন, বিনিয়োগ থেকে কতটা লভ্যাংশ পাওয়া যাবে, তাহলে তাঁরা বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন না, এটাই স্বাভাবিক। এতে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে।
এ ছাড়া বৈশ্বিক পরিসরে মূল্যস্ফীতি বাড়লে বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়বে।
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: ফেব্রুয়ারী ২৩, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,