সংকটকালে বৈশ্বিক এক উদ্যোগ কোভ্যাক্স; উদ্দেশ্য, ধনী-গরিবনির্বিশেষে বিশ্বের সব দেশের জন্য করোনার টিকার ন্যায্য বিতরণ যার লক্ষ্য। জাতিসংঘের সহায়তায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এই উদ্যোগের আওতায় চলতি বছরের শেষ নাগাদ গরিব দেশগুলোকে বিনা মূল্যে ২০০ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ দিয়ে এসব দেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া সম্ভব। কোভ্যাক্স থেকে আগামী জুন মাস নাগাদ ১ কোটি ৯ লাখ ৮ হাজার টিকা পাওয়ার কথা রয়েছে বাংলাদেশেরও।
কোভ্যাক্স মানে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনস গ্লোবাল অ্যাকসেস ফ্যাসিলিটি। এর যৌথ নেতৃত্বে ডব্লিউএইচও ছাড়াও রয়েছে স্বল্পমূল্যে টিকা দেওয়ার বৈশ্বিক উদ্যোগ গ্যাভি, সংক্রামক রোগের টিকা তৈরির জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতামূলক সংস্থা (সিইপিআই)। এরই মধ্যে এই উদ্যোগে ১৯৮টি দেশ যুক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে ডব্লিউএইচও।
বিশ্বজুড়ে করোনা সংক্রমণ নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে। ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় প্রতিদিনই সংক্রমণ রেকর্ড ছাড়াচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে টিকার চাহিদা যেমন বেড়েছে, তেমনি সময়মতো টিকা পাওয়া নিয়েও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। তাই চলমান মহামারির লাগাম টানতে কোভ্যাক্সের মতো উচ্চাভিলাষী বৈশ্বিক উদ্যোগ এগিয়ে নিতে ও ধনী-গরিবনির্বিশেষে টিকার ন্যায্য প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। রোববার প্রকাশিত ইউএন নিউজের এক প্রতিবেদনে এই চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরা হয়।
রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ
মহামারি শুরুর দিকে উৎপাদনকারী দেশগুলোর বাইরে ৫০ কোটি সিরিঞ্জের মজুত গড়ে তুলেছিল ইউনিসেফ। এর প্রতিক্রিয়ায় উৎপাদনকারী দেশগুলো সিরিঞ্জ রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। সরবরাহ কমে আসায় বেড়ে যায় সিরিঞ্জের দাম। এখন করোনার টিকা নিয়েও একই পরিস্থিতি দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই পরিস্থিতিকে ‘ভ্যাকসিন ন্যাশনালিজম’ বা ‘টিকার জাতীয়করণ’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর অর্থ, উৎপাদনকারী দেশগুলো আগে নিজেদের জনগণের জন্য টিকা নিশ্চিত করবে। এরপরই কেবল রপ্তানি করবে। যেহেতু টিকা উৎপাদন কয়েকটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তাই রপ্তানিতে কড়াকড়ি আরোপ হলে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের মানুষ টিকা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতে পারে। চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে কোভ্যাক্স উদ্যোগ।
ডব্লিউএইচও বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে সতর্ক করে দিয়েছে। সংস্থাটির মতে, ‘জাতীয়করণের’ কারণে করোনার টিকা রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ এলে মহামারির বিরুদ্ধে লড়াই প্রলম্বিত হতে পারে, যা মানুষের জীবন ও অর্থনীতিকে ভোগাবে।
এর সমাধান হতে পারে গরিব দেশগুলোকে স্থানীয়ভাবে টিকা উৎপাদনের অনুমতি দেওয়া। সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা ও প্রযুক্তি সরবরাহ করা। কোভ্যাক্স প্রকল্পের যোগাযোগ প্রধান ডিয়ানে আবেদ-ভারগারা বলেন, টিকা সংগ্রহ কিংবা উৎপাদনে সক্ষমতা বাড়াতে ও প্রযুক্তি সংগ্রহে দেশগুলোকে সহায়তা দেবে ডব্লিউএইচও। এর ফলে আফ্রিকা, এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকার গরিব দেশগুলোর টিকার জন্য নির্ভরশীলতা কমে আসবে।
প্রান্তিক পর্যায়ে বিতরণ
উৎপাদনকারী দেশগুলো থেকে উড়োজাহাজে টিকা কোনো দেশে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে সেখানে প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে তা সংরক্ষণ অবধি নানা কাজ রয়েছে। এরপর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে টিকার সুষ্ঠু বিতরণও করতে হবে। বিশ্লেষকেরা এই পর্যায়কে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং বলছেন। কেননা, গরিব দেশগুলোর প্রান্তিক এলাকায় টিকা সংরক্ষণ ও প্রদানে পর্যাপ্ত সুবিধা না থাকলে টিকা বিতরণে বৈষম্য রয়ে যাবে। বিপুল পরিমাণ মানুষ টিকা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবে।
ইউনিসেফের গ্লোবাল কোভ্যাক্স কো-অর্ডিনেটর জিয়ান গান্ধী বলেন, কোভ্যাক্স থেকে প্রথম টিকা পেয়েছে ঘানা। টিকার সুষ্ঠু বিতরণে দারুণ সাফল্য দেখিয়েছে দেশটি। তবে পশ্চিম আফ্রিকার অনেক দেশে ঘানার মতো ভালো সুযোগ-সুবিধা, মানবসম্পদ নেই। এসব দেশে টিকা প্রদান কার্যক্রম শহরকেন্দ্রিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ফলে সুষ্ঠু বিতরণ নিশ্চিত হবে না।
ইউনিসেফের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আমরা চাই সবার জন্য টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে। অনেক দেশেই তা শহরকেন্দ্রিক ও সম্মুখসারির যোদ্ধাদের মধ্যে সীমিত। এতে অনেক মানুষ টিকা পাবেন না। টিকা প্রদানের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।’
প্রয়োজন আরও অর্থ
১৯০টির বেশি দেশের জন্য করোনার টিকা কিনতে ২০২১ সালে কোভ্যাক্স প্রকল্পের ৩২০ কোটি মার্কিন ডলার প্রয়োজন হবে বলে জানিয়েছেন ডিয়ানে ভারগারা। তবে গরিব দেশগুলো এসব টিকা পাবে বিনা মূল্যে। তবে এই টিকা পাওয়াই শেষ কথা নয়। তা সংরক্ষণ, মজুত, বিতরণে অনেক কাজ করতে হবে। টিকাদানকারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এসব কাজেও প্রয়োজন হবে বিপুল অর্থ।
টিকা প্রকল্পে মূলত দুই ধাপে বরাদ্দ প্রয়োজন। প্রথমত, টিকা কেনা। দ্বিতীয়ত, সেই সব টিকা ব্যবহারকারী পর্যন্ত পৌঁছে দিতে ব্যবস্থাপনাগত বিভিন্ন প্রকল্প এগিয়ে নেওয়ার কাজে। যেহেতু গরিব দেশগুলো কোভ্যাক্স থেকে বিনা মূল্যে টিকা পাবে, তাই এই খাতে তাদের ব্যয় করতে হবে না। কিন্তু সেই সব টিকা সাধারণ মানুষের বাহু পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে নিজ খরচে। তাতে ব্যয় হবে বিপুল। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো টিকা প্রাপ্তি ও তার ব্যবস্থাপনার ব্যয়ে ব্যবধান কমিয়ে এনেছে।
ইউনিসেফ বলছে, টিকা সংরক্ষণে ফ্রিজিংয়ের ব্যবস্থা করা, টিকাদানে নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ, টিকা পরিবহনে নিয়োজিত ট্রাকের জ্বালানি কেনার মতো ব্যবস্থাপনাগত নানা কাজে গরিব ৯২টি দেশের অতিরিক্ত ২০০ কোটি মার্কিন ডলার প্রয়োজন হবে, যা এসব দেশের নিজেদের পক্ষে বহন করা কষ্টসাধ্য। সংস্থাটি এসব কাজে অবিলম্বে ৫১ কোটি মার্কিন ডলার মানবিক সহায়তা দিতে দাতাদের অনুরোধ করেছে।
ধনী দেশগুলোর মজুত প্রবণতা
গরিব দেশগুলো টিকার পাওয়া নিয়ে চিন্তিত। অনেক দেশ সীমিত সামর্থ্য নিয়েই ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে নিজেরা সরাসরি দর-কষাকষি করছে। এতে টিকা ইস্যুতে চাপের মধ্যে রয়েছে অনেক দেশ। সময়মতো টিকা পাওয়া যাচ্ছে না। এর বিপরীতে ধনী দেশগুলো রয়েছে তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থানে। অনেক দেশ ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত টিকা মজুত করেছে। এর ফলে করোনা টিকা নিয়ে ধনী-গরিবের বৈষম্য হয়েছে প্রকট।
জিয়ান গান্ধী বলেন, যেসব দেশ এরই মধ্যে টিকার মজুত গড়েছে, তাদের অতিরিক্ত ডোজ কোভ্যাক্সে দিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত বলার মতো সাড়া মেলেনি।
ডিয়ানে আবেদ-ভারগারা জানান, করোনার টিকার পেছনে যারা অর্থ খরচে সক্ষম, তাদের মধ্যে ‘আমি আগে’ মনোভাব দেখা দিয়েছে। তবে এই মনোভাব সবার জীবন বাঁচাতে সক্ষম হবে না বলে সতর্ক করেছেন তিনি।
টিকা নিতে দ্বিধা
করোনার টিকা প্রাপ্তি, বৈষম্য দূর করা নিয়ে অনেক কথা বলা হলেও এখনো প্রায় প্রতিটি দেশের অসংখ্য মানুষের মধ্যে টিকা নিয়ে দ্বিধা রয়ে গেছে। টিকা জীবন বাঁচায়- এটা স্বীকৃত হলেও তাঁরা এখনো ভাবছেন, টিকা কি আদতেই কাজে দেয়? টিকা নেওয়া কি উচিত?
এর অন্যতম কারণ, অনেকের কাছে এখনো টিকা নিয়ে সঠিক তথ্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এমন মনোভাব টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে এখনো বড় সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মহামারির সময় বিশ্বজুড়ে অনেক ভুল তথ্য, ভ্রান্ত ধারণা ছড়িয়েছে। এসব দূর করতে কাজ করা হচ্ছে। টিকা নিয়ে মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে।
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: এপ্রিল ০৬, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,