রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এই এক বছরে দুনিয়া অনেকটা বদলে গেছে। এমন কিছু পরিবর্তন ঘটেছে, যা খুব কম মানুষই ধারণা করতে পেরেছিলেন। প্রতিবেশী দুই দেশের যুদ্ধে ইউক্রেনের যেমন ক্ষতি হয়েছে, তেমনি ইউক্রেন থেকে বহু দূরের দেশের মানুষের জীবনে এর অভিঘাত লেগেছে, দেশে দেশে অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা।
এই যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বের যে ভোগান্তি হয়েছে বা হচ্ছে, তাতে তিনটি ক্ষেত্রে প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে বেশি। এগুলো হলো খাদ্যদ্রব্য, জ্বালানি আর মূল্যস্ফীতি। যুদ্ধের আঁচ প্রায় সব দেশে লেগেছে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলো। এসব দেশে যুদ্ধের প্রভাব সবচেয়ে প্রকট হয়েছে।
যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্যের দাম রেকর্ড সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠে। তবে এখন যুদ্ধের আগের দামে নিত্যপণ্য পাওয়া যাচ্ছে।
খাদ্যপণ্য
খাদ্যদ্রব্যের কথাই যদি বলা হয়, তাহলে ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বজুড়ে খাদ্যদ্রব্যের দাম এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে গেছে, যা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ। এর কারণ রাশিয়া ও ইউক্রেন বিশ্বে গমসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় দুই দেশ। জাতিসংঘ সতর্ক করেছে, ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে কোটি কোটি মানুষ বিশেষ করে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অংশের মানুষ দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে পড়েছে। গত বছরের জুলাইয়ে মস্কো ও কিয়েভ খাদ্যশস্য রপ্তানি নিয়ে একটি চুক্তি করে। এই চুক্তির কল্যাণে ইউক্রেনে আটকে থাকা কোটি কোটি টন খাদ্যপণ্য রপ্তানির সুযোগ তৈরি হয়। এসব পণ্য আটকা পড়ার কারণ কৃষ্ণসাগরে থাকা ইউক্রেনের বন্দরগুলো থেকে খাদ্যপণ্য রপ্তানি করা যাচ্ছিল না। কারণ, রাশিয়া নৌপথ অবরোধ করে রেখেছিল। তবে গত বছরের অক্টোবরে এসে হঠাৎ করে রাশিয়া এই চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। তবে এরপরও চুক্তিটি এখনো বলবৎ আছে। ইউক্রেন থেকে খাদ্যপণ্য রপ্তানি হচ্ছে। এতে বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যের দাম যুদ্ধের আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে।
জ্বালানি
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গত শতকের সত্তরের দশকের পর সবচেয়ে ভয়াবহ জ্বালানিসংকটে পড়েছে বিশ্বে। নিষেধাজ্ঞার কারণে অনেক দেশ রাশিয়া থেকে জ্বালানি কেনা বন্ধ বা কমিয়ে দেয়। এতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জ্বালানির দাম এক লাফে অনেক বেড়ে যায়। যুদ্ধের প্রথম ছয় মাসের মধ্যেই ইউরোপে বাসিন্দাদের গ্যাসের বিল দ্বিগুণ এবং বিদ্যুতের খরচ ৭০ শতাংশ বেড়ে যায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকেরা গত ডিসেম্বরে রাশিয়ার জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৬০ মার্কিন ডলারে বেঁধে দেন। যার অর্থ ইইউ জোটের বাইরে কোনো দেশ রাশিয়ার তেল কিনতে চাইলে ৬০ ডলারের বেশি দাম দিতে পারবে না। এর প্রধান লক্ষ্যই ছিল রাশিয়ার তেল বিক্রি করে ক্রেমলিন যেন সেই অর্থ যুদ্ধে ঢালতে না পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও বিপাকে পড়ে ইউরোপ ও তার পশ্চিমা মিত্ররা। এর কারণ বিশ্ববাজারে জ্বালানির সরবরাহ অতটা নেই। এতে জ্বালানি তেলের বাজারে রাশিয়ার আধিপত্য থেকে যায়। কারণ, রাশিয়া গত এক বছরে চীন ও ভারতের কাছে বেশি তেল ও গ্যাস বিক্রি করেছে।
মূল্যস্ফীতি
ইউক্রেন যুদ্ধ যখন শুরু হলো, তখন বিশ্ব অর্থনীতি সবে করোনা মহামারির ধকল কাটিয়ে উঠছিল। যুদ্ধ শুরুর পর জ্বালানিসংকট ও প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার কারণে মূল্যস্ফীতি তরতর করে বাড়তে শুরু করে। নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে কমে যায় মুদ্রার মান। মানুষের তাদের সঞ্চয়ের অর্থ ভেঙে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা শুরু করে। এতে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যায়। এতে করে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যেতে শুরু করে। মূল্যস্ফীতি যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যসহ দেশে দেশে সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারগুলো সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নগদ প্রণোদনা দিতে শুরু করে। একই সঙ্গে বিভিন্ন ভর্তুকি, পণ্যের মূল্য বেঁধে দেওয়া, এমনকি কর কমানোর পদক্ষেপও নেয়।
ন্যাটো
সম্প্রতি ঝটিকা সফরে ইউক্রেন যান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সে সময় ইউক্রেনের পাশের দেশ পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশতে এক সমাবেশে বাইডেন বলেন, ‘যেকোনো সময়ের চেয়ে ন্যাটো এখন বেশি শক্তিশালী।’ রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন হয়তো ভেবেছিলেন, ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর আগ্রাসনের কারণে ন্যাটোতে বিভাজন আরও বাড়বে। তবে পুতিনের সে আশার গুড়ে বালি। বরং ইউক্রেন যুদ্ধ ন্যাটোকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার সঙ্গে সীমান্ত থাকা ইউরোপের দেশ ফিনল্যান্ড নিজেদের দীর্ঘদিনের নিরপেক্ষতার নীতি থেকে সরে এসে পশ্চিমা এই সামরিক জোটের সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করেছে। ফিনল্যান্ডের মতোই নীতি বদলে ন্যাটোর সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করেছে সুইডেন। ন্যাটোর নেতারা বলেছেন, এই দুই দেশের আবেদন গৃহীত হবে বলে আশা করছেন তাঁরা। তবে সুইডেন সদস্য হওয়ার পথে বাদ সেধেছে তুরস্ক। কারণ, সুইডেন কুর্দি গোষ্ঠীগুলো নিয়ে এমন অবস্থান নিয়েছে, যাতে নাখোশ তুরস্ক। কারণ, আঙ্কারা এসব কুর্দি গোষ্ঠীকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে বর্ণনা করে থাকে। এদিকে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ইউক্রেনও ন্যাটোর সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করেছে। তবে দেশটির আবেদন যে শিগগিরই গৃহীত হচ্ছে না, তা প্রায় নিশ্চিত।
ইউরোপ
যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেনের ৮০ লাখের বেশি নাগরিক ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে। বিশেষ করে যুদ্ধ শুরুর দিকে ইউক্রেনের নাগরিকেরা বেশি দেশ ছাড়েন। সবচেয়ে বেশি ১৫ লাখ ইউক্রেনীয় আশ্রয় নিয়েছেন প্রতিবেশী দেশ পোল্যান্ডে। এই হিসাব জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের। এ ছাড়া ইউক্রেনের ভেতরে বাস্তুচ্যুত অর্থাৎ গৃহহীন হয়েছেন আরও ৫০ লাখ ইউক্রেনীয়। একই সঙ্গে এই যুদ্ধ ইউরোপে পোল্যান্ড ও বাল্টিক দেশগুলোর ওপর প্রভাব বাড়িয়েছে। কারণ, এসব দেশ ইউক্রেনের পক্ষে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেছে এবং ইউক্রেনকে বড় ধরনের সামরিক সাহায্য ও দ্রুত অস্ত্র সরবরাহের জন্য চাপও দেয়। তবে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ফ্রান্স ও জার্মানির মতো দেশের নেতারা শুরুর দিকে ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিলেন। কারণ, এসব দেশ দীর্ঘদিন ধরেই ইউরোপের ‘নিরাপত্তা কাঠামো’ মানার নীতি মেনে আসছিল। এই নীতি অনুযায়ী, রাশিয়ার সঙ্গে বৈরিতা নয়, সহযোগিতার সম্পর্ক রাখতে হবে।
চীন
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ বিষয়ে দ্বিমুখী নীতি গ্রহণ করতে দেখা যায় চীনকে। একদিকে শান্তির কথা বলে, আবার অন্যদিকে রাশিয়ার সমালোচনা করা থেকেও বিরত থেকেছে বেইজিং। চীনের শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ই সম্প্রতি ইউরোপ সফর করেন। ইউরোপ সফরের সময় তিনি ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছেন, এই যুদ্ধ দীর্ঘ বা সংঘাত আরও ছড়িয়ে পড়ুক তা তিনি চান না। ওয়াং ই যখন এ কথা বলছেন, ঠিক তখনই রাশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়া চালাচ্ছিল চীন। এদিকে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের চলতি বসন্তে রাষ্ট্রীয় সফরে মস্কো যাওয়ার কথা রয়েছে। বাইডেন প্রশাসন চীনের এই অবস্থান গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। চীন সরাসরি রাশিয়াকে সামরিক সহায়তা দেয় কি না, তা নিয়ে ওয়াশিংটনের উদ্বেগ রয়েছে। ইতিমধ্যে ওয়াশিংটন দাবি করেছে, তাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য আছে যে বেইজিং মস্কোকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাশিয়াকে সম্ভাব্য সামরিক সহায়তা দেওয়া নিয়ে চীনকে সতর্ক করেছেন। তবে বেইজিং যুক্তরাষ্ট্রের এই অভিযোগের শক্ত জবাব দিয়েছে। বেইজিং বলছে, ইউক্রেনে ক্রমাগত অস্ত্র সরবরাহ করে শান্তি ফেরানো সম্ভব নয়।
আইএমএফ
যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। উন্নয়নশীল দেশে থাকা বিনিয়োগ তুলে নিতে শুরু করেছেন বিনিয়োগকারীরা। আর্থিক সংকটের কারণে মার্কিন ডলারের পরিবর্তে অনেক দেশের মুদ্রার মান কমে গেছে। এতে আমদানি খরচ বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে ভারত ও ব্রাজিলের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো নিজেদের মুদ্রায় বন্ড বাজারে ছেড়ে সংকট সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে তাতেও সংকটের সমাধান হচ্ছে না। সংকটের মুখে অনেক দেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতো বৈশ্বিক ঋণদাতাদের দ্বারস্থ হয়েছে ও হচ্ছে। আইএমএফের ঋণ পেতে বহু কঠিন শর্ত মানতে হচ্ছে সংকটে পড়া দেশগুলোকে। কিন্তু শর্ত মানা ছাড়া উপায় থাকছে না। আইএমএফ ২০২২ সালে ২৭টি ঋণ কর্মসূচির আওতায় মোট ৯৫ বিলিয়ন (১ বিলিয়ন সমান ১০০ কোটি ডলার) ঋণ ছাড় করেছে। আইএমএফ তাদের ইতিহাসে এর আগে কখনো এক বছরে এত অর্থ ছাড় করেনি।
****অনুবাদ করেছেন: আল–আমিন সজীব।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:মার্চ ০২, ২০২৩
রেটিং করুনঃ ,