এই তেইশ বছর বেশ দ্রুত কেটে গেল, এই সময়টিতে দানির ছোট্ট চাচা দেশে এসেছিল মোট ছয়বার, প্রথম যে বছর দানির চাচা জার্মানী থেকে দেশে আসল সে বছরই দানির জন্ম হলো, দানিউব নামটি দানির চাচাই রেখেছিল, জার্মানী তথা ইউরোপের বিখ্যাত নদীর নামে নাম দানিউব, দানিউব থেকে দানি।
দানিদের বা দানির পড়শী বিশাখা। দানির সম-বয়সের মেয়ে, একই ফ্লাট বাড়িতে থাকে। মাঝে মাঝে সিঁড়িতে উঠা নামার সময় বা মেইন গেটের ফাঁকা জায়গাটায় দেখা হয়, তবে কথা হয় না।
২০১৩ সালের শেষের দিকের সময়, তখন ছিল সরকার বদলের দিন-কাল, অন্য কথায় হরতাল, অবরোধের সময়। বিশাখার মত মেয়ে বা দানির মত ছেলেদের ঘরের বাইরে না যাওয়াটাই নিরাপদের, অভিভাবকরা ঘরে থাকাটাই আশা করে, চোখের আড়াল হলে দু;চিন্তা যদিও বাড়ে তবুও মুঠোফোনের কল্যাণে অভিভাবকরা সন্তানের খবরা খবর রাখতে পারে।
হরতাল, অবরোধের সময়গুলিতে বা ভার্সিটির বন্দের দিনগুলিতে দানি মেইন গেটের কাছে দেওয়ালের উপরে বন্ধুদের সাথে গল্প গুজব করে। সতর্ক একটি দৃষ্টি রাখে কখনও যদি বিশাখা বান্ধবীদের নিয়ে হৈ হৈ করে দানিকে অতিক্রম করে যায় বা একা মাথা নিচু করে দানির সামনে দিয়ে চলে যায়। বাসার ভিতরে যে সামান্য রাস্তাটা সেখানে হাঁটার সময় প্রায় বিশাখার সাথে দানির ক্রসিং হয়েছে, অনেকটাই রেলগাড়ীর ক্রসিং এর মত, যেন প্রচন্ড শব্দে দুইটা রেলগাড়ী ক্রসিং করে গেল। কখনও বিশাখার কিছু কথা কানে এসেছে যেমন “কিছুতে মানা যায় না, অসহ্য……। আবার ” লাল রঙের কামিজটা সত্যই দারুন ছিল কিন্তু জানিস ওর র ………. ” কিম্বা এটা কোন খাবার হলো টেষ্ট না ছাই একদম বাজজ……। এই সব কথা বার্তা দানির কানে ঢুকে যেত যেমন করে রেলড়গাড়ীর প্রচন্ড ঝিক ঝিক শব্দ কানে ঢুকে যায়।
বিশাখা সম্পর্কে দানির কিছুই জানা নেই, শুধু কেমন করে যেন বিশাখা নামটা জানা হয়েছে। তার নাম বিশাখা। তবে দানি বিশাখা পাটনাম ( Visakhapatnam) নামটা অনেকবার শুনেছে কিন্তু বিশাখা পাটনাম ( Visakhapatnam) সম্পর্কে তেমন কিছু জানা হয় নাই। শুধু জানে ভারত মহা-সাগরে এর অবস্থান।
হঠাৎ দানির মনে একটি প্রশ্ন সামনে এসে দাড়িয়েছে একটি ষাঁড়ের মত, দানিকে উত্তরটি বের করতেই হবে না হলে ষাঁড়টি তার শিং দিয়ে দানিকে আঘাত করবে। দ্রুত উত্তরটি বের করা এখন জরুরি। বিশাখা কি একটি নদীর নাম! দানিউব যেমন একটি নদীর নাম, দানিউব থেকে যেমন দানি তেমন করে করে কি বিশাখাও কী একটি নদীর নাম !!! আর বিশাখাকে কী আদর করে শাখা নামে ডাকা যাবে বা আরও সংক্ষিপ্ত করে বিশা নামে !! কিম্বা বি নামে !!এই সব নানান চিন্তা দানির মনে।
বন্ধুদের অনেকেই জানে বিশাখার নাম, তাই বন্ধুদের কাছে বিশাখা কি একটি নদীর নাম এর উত্তর জানার চেষ্টা না করাই ভালো। সবচেয়ে নিরাপদ বই-পত্র, ইন্টারনেট ঘেঁটে ঘঁটে উত্তর বের করা আসলই কি বিশাখা একটি নদীর নাম।
বিশাখা একটি নদীর নাম কিনা এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিশাখা নামের মেয়েটি দানির মনের অনেক খানি জায়গা দখল করে ফেলেছে যেমন করে মুঘলরা বা ইংরজেরা ভারত বর্ষ দখল করে ফেলছিল।
বিশাখার কথা বলার ধরণ, হাঁটার ধরণ দানির মনের মধ্যে বার বার একাধিক বার উঁকি দিয়েই চলেছে, সংক্ষেপ বর্ণনায় শয়নে স্বপনে জাগরণে অথচ বিশাখার সাথে তার তো কোন দিনও কোন কথাও হয় নি, আর কথা হবেই বা কেন ! ইদানিং বিশ্ব বিদ্যালয় গন্ডির ছেলেদের অনেক মেয়ে বন্ধু থাকে আবার মেয়েদেরও অনেক ছেলে বন্ধু থাকে, অহেতুক পড়শি বলে বিশাখা দানির সাথে কথা বলবে বন্ধুত্বের হাত বাড়াবে দানি তা মনে করে না।
মেইন গেটের কাছে দেওয়ালের উপরে যে জায়গাটায় বসে সন্ধুদের সাথে দানি গল্প করে আড্ডা দেয় সেখান থেকে দানি লক্ষ্য করেছে কখনও কখনও বিশাখা বিরাট এক জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে জানালার বেশ খানিকটা পর্দা সরিয়ে, দূর থেকে ফুল ফুল ডিজাইনের পর্দার পাশে বিশাখাকে দাঁড়িয়ে থাকতে অসাধারণ লাগে তবে দানির চোখ বিশাখার দিকে পড়তেই বিশাখা পর্দা টেনে দিয়ে পর্দার আড়ালে চলে যায়। ঐ দিন সকাল দুপুর বা বিকালে বিশাখাকে জানালায় আর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় না। ঐ সময়টা দানির জন্য খুবই এক যন্ত্রনাময় সময়, যাতনাময় সময়, তবুও দানি কখনও ভাবি নি যে যাতনা কী !! কেনই বা বিশাখাকে এক নজর দুরের জানালায় দেখার এতো প্রবল বাসনা !
দানির এক বন্ধু একদিন দানিকে বলল মেয়েটা কিন্তু বেশ খোঁজ করে দেখ কোন কলেজে নাকি ভার্সিটিতে পড়ে আর কোন সাবজেক্টে !!
দানি তেমন কোন উত্তর নি দিয়ে বলল পরিচিত হওয়া বা কথা বলার কী দরকার আমদের কি কম মেয়ে বান্ধবী আছে !! কিন্তু দানি একটি সত্য গোপন করে গেল যে বিশাখা নেমেই এই মেয়েটি কী ভাবে তার চিন্তা চেতনার একটি বিিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। বন্ধুদের সাথে সেল ফোনে কথা বলা, ইন্টানেটের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। বিশাখা বিষয়টি যে এক তরফা দানির তা বুঝতে বাকি নেই।
ইদানিং দানির মন পরে থাকে বিশাখাদের বড় জানালাটায় তাই বাসা ছাড়া অন্য কোথাও সে সময় কাটায় না, বছরের প্রথম দিন ২০১৪ সালের পহেলা জানুয়ারী বিশ্ব বিদ্যালয়ে নানান ধরণের বন্ধু বান্ধনীদের সাথে আড্ডা দিয়ে বিকালে বাসায় ফিরার পথে নিত্য দিনের মত বিশাখাদের বড় জানালাটায় চোখ পড়তেই দানি লক্ষ্য করল যে জানালায় কোন পর্দা নেই, কেমন যেন খটকা লাগলো। স্থির হয়ে অনেক কিছু ভাবলো, যে ভাবনাটা সে ভাবতে চায় নি সেটাই সত্য হলো; বিশাখা, বিশাখার পরিবার আজ সকালে বাসা বদল করে অন্য কোন বাসায় চলে গিয়েছে।
কেউ একজন কারও জীবনে অনেক প্রভাব ফেলে অথচ প্রভাব বিস্তারকারী কিছুই জানে না। দানি নিজেকে সাস্ত্বনা দিয়ে বলল আমার প্রিয় কবির কথা আমি কতই না ভাবি, কত ভাবে ভাবি, কবির প্রিয় কবিতাগুলি কত বারই না পড়ি কিন্তু কবি তো আমাকে চিনে না, আমার সম্পর্কে কিছুই জানে না। এ পৃথিবীতে ভালো লাগার মানুষগুলি অনেক কিছুই জানে না।
অনেক অনেক দিন পরে দানি বিশাখা নামের উত্তর খুঁঁজে পেয়েছে, বিশাখা একটি নদীর নাম আর বিশাখা নদীর মতই দানির মনে প্রাণে প্রবাহিত হয়েছে বহুকাল ধরে কিন্তু বিশাখা কিছুই জানে নি যেমন করে নদী জানে না সে কার মনে প্রবাহিত হয় ! কে তার প্রিয় ! কে তাকে ভালোবাসে ! কে মনে রাখে ! কে তাকে পূজা করে !!
রেটিং করুনঃ ,