সাহেব বিবি গোলাম
বিমল মিত্র
মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, মূল্য 350
সদ্য পড়লাম বিমল মিত্রের বিখ্যাত উপন্যাস সাহেব বিবি গোলাম। পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজরা হয়ে উঠল দেশের শাসক আর কোলকাতা হয়ে উঠল বাংলার প্রাণকেন্দ্র। ইংরেজদের খুশি করে গড়ে উঠল কিছু জমিদার আর বাবু সম্প্রদায়। উপন্যাস শুরু হয়েছে বউবাজারের বড়ো বাড়িকে কেন্দ্র করে। বড়োবাড়ির বাবুদের তখন বেজায় দাপট। তা সেই বড়োবাড়ির মাস্টারমশাই ব্রজরাখালের আত্মীয় হবার সুবাদে ভূতনাথ এসে উঠল সেখানে। এই ভূতনাথের চোখ দিয়ে আমরা সারা উপন্যাস জুড়ে দেখব কোলকাতাকে, সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোকে। ভোর হবার সাথে সাথেই বড়ো বাড়ির কর্মকান্ড শুরু হয়। কত দারোয়ান চাকর সহিস রাঁধুনি হুঁকোদার খাজাঞ্চি কোচয়ানদের ছোটাছুটি, বাবুদের পায়রা ওড়ানো, বউদের পুতুলের বিয়ে, আর সন্ধ্যা হলেই বড়োবাড়ির সামনে জোতা হবে ল্যান্ডো, বাবুরা বেরিয়ে যাবেন ফুর্তির নেশায়।
চাকরি পেল ভূতনাথ সুবিনয় বাবুর কারখানায়। সুবিনয় বাবু ব্রাহ্ম। গাঁয়ের ছেলে ভূতনাথ মুগ্ধ হয়ে গেছে সুবনিয় বাবুর স্থিরতায়, পাণ্ডিত্যে, ধৈর্য্যয়। লেখকের অপূর্ব লেখনী-পটুতায় একাত্ম হয়ে যাই উপন্যাসের সঙ্গে। মনে হয় ভূতনাথ নয়, আমিই হারিয়ে গেছি শিয়ালদা স্টেশনে লক্ষ মানুষের ভীড়ে, বিবেকানন্দ যে অনেকদিন পর ফিরে আসছেন কোলকাতায়। কিংবা সেই বঙ্গভঙ্গের দিন, সারা কোলকাতায় প্রত্যেকের বাড়িতে অরন্ধন, রবীন্দ্রনাথ রাখী পড়িয়ে আন্দোলনের সূচনা করলেন, স্বদেশী আন্দোলনের বহু ঘটনা অনেক কাছ থেকে দেখা যাবে এই উপন্যাসে। ব্রজরাখাল রামকৃষ্ণের গুণগ্রাহী। ব্রজরাখালের অসম্ভব মানব দরদ, স্বদেশ প্রেম, জীব সেবা আশ্চর্য করে আমাদের। রাস্তায় মার খেয়ে অচৈতন্য অবস্থায় ভূতনাথ। উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে সেবা করল অনুশীলন সমিতির ছেলেরা। যতীন বাঁড়ুজ্যে, বারীন ঘোষ, অরবিন্দ ঘোষ এলেন কোলকাতায়, এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি।
এত ঘটনার ঘোরে ঘুরে চলেছে কোলকাতা, বাবুদের বিলাস অপব্যয় বেড়েই গেছে, ক্ষয় ধরেছে জমিদার শ্রেণীদের মধ্যে আর গড়ে উঠেছে আর এক নতুন কোলকাতা কেরানি, উকিল, মাস্টার, ব্যবসায়ী এদের নিয়ে। তবে এত কিছুর ভিড়েও উপন্যাসটির সুস্পষ্ট একটা প্লট রয়েছে, উপন্যাসটিতে প্রেম রয়েছে। আছে সুবিনয় বাবুর মেয়ে জবা, আর আছে বড়োবাড়ির ছোটোবউ; উপন্যাসটির প্রধান দুটি নারী চরিত্র। উপন্যাসটির গতিপথে হঠাৎ করে এসেছে অনেক আশা সম্ভাবনা আবার তেমনি আকস্মিক ভাবেই ঘটেছে যবনিকা পতন। আর এই উত্থান পতনের মাঝে রয়েছে সুবিনয় বাবু, ব্রজরাখালের অনেক আত্মোপলব্ধির কথা, আছে উপনিষদের কথা, আর আছে নিবেদিতার কথা। ব্রজরাখাল বলেছেন – গাছপালা জন্মেই গাছপালা, পশুপাখি জন্মেই পশুপাখি, কিন্তু মানুষ জন্মাবার পর অনেক পরিশ্রমের মাধ্যমে তাকে মানুষ হতে হয়। ভূতনাথের জীবনযুদ্ধ, জীবনে অবর্ণনীয় সব পরিস্থিতি আর সে সবের মধ্যে দিয়ে কীভাবে এগিয়ে গেছে ভূতনাথ তথা উপন্যাসটি তা সত্যিই হৃদয়স্পর্শী।
ঝরঝরে ভাষায় লেখা এই উপন্যাসটি পড়তে পড়তে থামতে পারা যায়না। বই বন্ধ করে রাখলেও মন রেখে আসতে হয় সেই পুরোনো কোলকাতায়। তাই শেষ হবার পর বারবার মনে হয় আর একটু থাকলে ভালো হত। বইটির শুরুতে দেশ প্রত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ লিখেছেন এ ধরনের উপন্যাস একশ বছরে একটি রচিত হওয়াই যথেষ্ট। শান্তিনিকেতনের উপাচার্য ইন্দিরা দেবীচৌধুরাণী লিখেছেন এই উপন্যাসের জন্য লেখকের নোবেল পাওয়া উচিত কিংবা তার অনুরূপ স্বদেশী কিছু। বিমল মিত্র সাহেব বিবি গোলাম উপন্যাসটি সত্যিই একটি যুগোত্তীর্ণ ক্লাসিক।
সূত্র: সংগৃহিত।
তারিখ: এপ্রিল ০৬, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,