লেখক:শওকত হোসেন।
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে, ২০২২ সাল হতে যাচ্ছে বিপদের সঙ্গে বসবাসের আরেকটি বছর। কোভিড-১৯-এর নতুন ধরন অমিক্রন, মূল্যস্ফীতির চাপ, বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের মধ্যে নানা ধরনের সংঘাত ও উত্তেজনা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব—সব মিলিয়েই গার্ডিয়ান-এর এই বিশ্লেষণ। জীবনানন্দ দাশ যেমনটা লিখেছিলেন, ‘আলো যেন কমিতেছে-বিস্ময় যেতেছে নিভে আরো।’
বৈশ্বিক পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশও খুব দূরে নেই। মূল্যস্ফীতির চাপ এখানেও বাড়ছে, প্রণোদনার ঋণ ব্যাংকে ফিরে আসবে কি না, তা নিয়ে আছে অনিশ্চয়তা, থাকবে নির্বাচনের আগের বছরের সরকারের ব্যয় বাড়ার চাপ। অমিক্রনের সংক্রমণ কতটা ছড়াবে, আফ্রিকা থেকে আসা নতুন এই ধরন কতটা প্রাণঘাতী ও টিকার কার্যকারিতা কতটা—এর ওপরই নির্ভর করছে ২০২২ সালের ভবিষ্যৎ। ফলে ২০২২ সালটি এখনো অনিশ্চয়তারই বছর।
মূল্যস্ফীতি চাপ: দেশে-বিদেশে
সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া এখন পয়লা নম্বর বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্বের প্রায় সব দেশই মূল্যস্ফীতির চাপ কমানোকে প্রধান লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছে। অথচ ২০২১ সালের শুরুতে মনে হয়েছিল, বছরটি হবে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের। কারণ, তখন টিকা বাজারে চলে এসেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো কোভিড সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বেশ সফলও হয়েছিল। ফলে সবারই অগ্রাধিকারে ছিল অর্থনীতি পুনরুদ্ধার। কিন্তু অর্থবছরের শেষের দিকে এসে সরবরাহ ব্যবস্থায় নানা বিঘ্ন প্রকট হলে পুনরুদ্ধারের গতিও খানিকটা শ্লথ হয়ে পড়ে। এর মধ্যে আবার পুরোনো লোকসান পুষিয়ে নিতে তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেক ও রাশিয়া জ্বালানি তেলের উৎপাদন কমিয়ে দেয়। এর প্রভাব পড়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর প্রধান অস্ত্র হচ্ছে অর্থ সরবরাহ কমিয়ে আনা। এ জন্য বাড়াতে হয় সুদহার। কিন্তু অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের সময়ে সুদহার বাড়ানো উল্টো ফল দিতে পারে। এতে কমবে বিনিয়োগ। সন্দেহ নেই, নতুন বছরে এ নিয়ে চলবে নানা আলোচনা ও বিতর্ক। তুরস্কের রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান যেমন উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়েও সুদহার আরও কমাতে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চাপ দিয়েই যাচ্ছেন, অন্যদিকে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড এরই মধ্যে সুদহার বাড়িয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভও এই পথে হাঁটবে।
দেশেও এখন মূল্যস্ফীতি ৬ ছুঁই ছুঁই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে মূল্যস্ফীতি যতটা, সীমিত আয়ের মানুষ টের পাচ্ছেন আরও বেশি। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের নীতিনির্ধারকেরা মূল্যস্ফীতির চাপ বৃদ্ধি নিয়ে কতটা চিন্তিত। অবশ্য দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে অস্ত্র একেবারেই কম। বিনিয়োগ মন্দার সময়ে মুদ্রা সরবরাহ কমানোর কথা সরকার ভাববে না বলেই মনে হয়। সুতরাং বাংলাদেশকে ভরসা করতে হবে বৈশ্বিক মূল্য পরিস্থিতির ওপরেই।
গুরুত্বপূর্ণ ২০২২
অমিক্রন কতটা প্রাণঘাতী, তা জানা যাবে নতুন বছরের শুরুতেই। ইউরোপের কিছু দেশ আবারও লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে লকডাউনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। নতুন বছরটি বাংলাদেশের জন্য নির্বাচনী বছর নয়। তবে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ অর্থবছর শুরু হবে আগামী জুলাই মাস থেকেই।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ভোট গ্রহণ দিনে না রাতে হবে, সে আলোচনা এখানে নয়। তবে গণতন্ত্র সম্মেলনে ডাক না পাওয়া কিংবা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষাপটে বলা যায়, নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মনোযোগ থাকবে। রাজনৈতিক ঘটনা যা-ই থাকুক, নতুন বছরে ব্যয় বৃদ্ধির একটি চাপ থাকবে। অতীতেও দেখা গেছে, নির্বাচনের আগের বছর থেকেই সরকারের ব্যয় বাড়ে। দলের নেতা-কর্মীদের হাতে অর্থ তুলে দেওয়ার নানা কৌশল সরকারকে করতে হয়। এই অর্থ কোথায়, কার কাছে যাবে, সেটাই হবে দেখার বিষয়।
যদিও অর্থ ব্যয়ের জন্য অনুকূল বছর ২০২২ নয়। মূল্যস্ফীতি এ ক্ষেত্রে একটি বড় বিবেচনা। আবার সরকার গত দুই বছরে যে প্রণোদনা তহবিল দিয়েছে, তার বড় অংশই মূলত ব্যাংকঋণ। এই অর্থ ব্যাংকে কতটা ফেরত আসবে, এ নিয়ে এরই মধ্যে সংশয় দেখা দিয়েছে। সুতরাং নতুন বছর হতে পারে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ লাফ দেওয়ার বছর।
নতুন বছরে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে সংলাপ শুরু করেছেন দেশের রাষ্ট্রপতি। তবে সংলাপ ফলপ্রসূ হবে, গঠিত হবে সবার পছন্দের নির্বাচন কমিশন, যাঁরা স্বাধীনভাবে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য কাজ করবেন—এসব যাঁরা ভাবছেন, তাঁরাই হচ্ছেন নতুন বছরের সবচেয়ে আশাবাদী মানুষ। বরং রাজনীতির মাঠে যে দ্বন্দ্ব, সংঘাত, প্রার্থী হতে মরিয়া চেষ্টা, অপরকে জায়গা না দেওয়ার প্রবণতা, অর্থের অপচয় ও দুর্নীতি—সবই বজায় থাকবে নতুন বছরেও।
বিশ্ব কোথায় যাবে
পারমাণবিক অস্ত্রের প্রশ্নে ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েল কী ব্যবস্থা নেবে, সে আলোচনা শেষ হওয়ার নয়। লেবানন, লিবিয়া বা ইয়েমেন নিয়ে মাথাব্যথাও থাকবে। তবে নতুন বছরে মধ্যপ্রাচ্যের জন্য বড় ঘটনা হবে কাতারের বিশ্বকাপ ফুটবল। প্রথমবারের মতো মধ্যপ্রাচ্যে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলাটি হবে। সব ভুলে ফুটবলের দিকে মনোযোগ দেওয়ার বছর ২০২২।
বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও সংকটের অভাব নেই। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধ তো আছেই। আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের গতিবিধিও সবার নজরে থাকবে। চীন ও তাইওয়ানের সম্পর্ক নিয়েও আছে নানা উত্তেজনা। এশিয়ার ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে আছে দুই প্রতিবেশী ভারত ও চীন। আগামী নভেম্বরে সিনেটের আসন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেনকেও বড় পরীক্ষা দিতে হবে।
সব মিলিয়ে নতুন বছরটি এখনো নানা অনিশ্চয়তায় ভরা। আপাতত অমিক্রনের ওপরই নির্ভর করছে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার। নতুন বছর ধরে যত আশা, আকাঙ্ক্ষা বা সম্ভাবনা—সবকিছুই নির্ভর করছে আপাতত এই অমিক্রনের ওপর। তবে নতুন বছরটি হোক মহামারি চলে যাওয়ার বছর, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের বছর, স্বাভাবিক জীবনযাপনের বছর। শান্তিবাদী নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের একটি উক্তি দিয়েই শেষ করা যাক। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা হয়তো অসংখ্যবার হতাশ হব, কিন্তু তারপরও অসংখ্যবার আমাদের আশা করতে হবে।’
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ জানুয়ারী ০১, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,