বাংলাদেশে বিনিয়োগ পেতে হলে নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন। অন্তর্বর্তী সরকারের সময় বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না। গতকাল রবিবার ঢাকায় বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন (বিওবিসি) সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের এক আলোচনা পর্বে আলোচক, বিশ্লেষকদের বক্তব্যে এই অভিমত উঠে আসে। নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আন্তর্জাতিক এই সম্মেলন আয়োজন করে।
‘ক্ষমতার পরিবর্তন : একটি খণ্ডিত বিশ্বে ভূ-রাজনৈতিক দাবা বোর্ড’ শীর্ষক ওই আলোচনা পর্বের সঞ্চালক ছিলেন সিজিএসের জ্যেষ্ঠ রিসার্চ ফেলো পারভেজ করিম আব্বাসী। আলোচক ছিলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিপস) প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান, চীনের জিলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি শিক্ষার্থী আমনা খান, লাটভিয়ার টুরিবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক গ্রেগরি সিমন্স, এশিয়া ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ কাজী ফয়সাল বিন সেরাজ ও ভারতের ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত।
আলোচনা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের সম্ভাবনা প্রসঙ্গে আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, ‘নির্বাচিত সরকার ছাড়া এখানে কেউ বিনিয়োগ করবে না। অস্থায়ী ব্যবস্থায় কোনো বিনিয়োগ আসবে না।
’
বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ার ওপর জোর দিয়ে আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, ‘বড় শক্তিগুলোর কৌশলগত প্রতিযোগিতায় এখন এশিয়া। এর কারণ চীন।’
তিনি আরো বলেন, ‘চার দেশের নিরাপত্তা জোট কোয়াড গঠিত হয়েছে। কোয়াড প্লাস, কোয়াড ডায়ালগ পার্টনার নিয়েও কথা হচ্ছে।
আকুস গঠিত হয়েছে। এসব কিছুর লক্ষ্য চীনকে মোকাবেলা করা।’
আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, “পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের জোরালো পদচিহ্ন রয়েছে। ভারতে এটি নেই। তবে ভারতের বড় বাণিজ্য চীনের সঙ্গে।
এই অঞ্চলে চীনের ‘চেকবুক কূটনীতি’ খুব কার্যকর প্রমাণ হয়েছে।”
যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর ইউরোপে এর প্রভাব বিষয়ে লাটভিয়ার টুরিবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক গ্রেগরি সিমন্স বলেন, ‘ইউরোপ হতাশ। ইউরোপের অনেক নেতা কমলা হ্যারিসকে সমর্থন করেছিলেন। ২০১৬ সালেও এমন হয়েছিল। তখন তারা হিলারী ক্লিনটনকে সমর্থন করেছিলেন।’
গ্রেগরি সিমন্স বলেন, ‘ইউরোপ অনেক বিষয়ে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করে। যুক্তরাষ্ট্রে যখন পরিবর্তন আসছে তখন তার পরিণতি নিয়ে ইউরোপীয় নেতারা হতাশায় ভুগছেন।’
সিমন্স বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফিরে আসার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর ইউরোপের নেতারা চীনের দিকে ছুটছে। কারণ ইউরোপের দেশগুলোর অর্থনীতির অবস্থা খারাপ। সেগুলো বাঁচাতে চীনের সহযোগিতা প্রয়োজন হবে।’
ভারতের ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বলেন, ‘সবাই ভারতের সঙ্গে কাজ করতে চায়। ভারত বলছে, এটি বহু পক্ষ, বহু মেরুর বিশ্ব। রাশিয়া ভারতের খুব কাছের বন্ধু। চীন এখন ভারতের সবচেয়ে বড় অংশীদার। ভারত সবার সঙ্গে কাজ করতে চায়। বন্ধু খোঁজার ক্ষেত্রে ভারত স্বাধীন।’
শ্রীরাধা দত্ত স্বীকার করেন, দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের পদচিহ্ন স্পষ্ট। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো ভারতকে অপছন্দ করে আবার সহযোগিতাও নেয়। তিনি বলেন, ‘শ্রীলঙ্কা যখন বিপদে পড়েছে তখন ভারতই সহযোগিতায় এগিয়ে গেছে। ভারতবিরোধী হিসেবে পরিচিত প্রার্থী মালদ্বীপে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরও ভারত সহযোগিতা করছে।’
ভারতবিরোধী মনোভাবের পেছনে দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ কিছু সমীকরণও আছে বলে মনে করেন শ্রীরাধা দত্ত। তবে ভারত ‘ওপ্রেসিভ’ (নিপীড়ক) নয়।
প্রশ্নোত্তর পর্বে বাংলাদেশের একজন সাবেক রাষ্ট্রদূত প্রশ্ন করেন, ভারত যদি নিপীড়ক নাই হয়, তাহলে বাকি দেশগুলো কেন ভারতের ওপর অসন্তুষ্ট? বাংলাদেশের জনগণ কেন ভোট দিতে পারেনি? ভারত কেন বিগত সরকারকে সমর্থন করেছে?
অনুষ্ঠানে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের মধ্য থেকে আরো প্রশ্ন ছিল, ভারতের প্রতিবেশীই প্রথম নীতি কি ব্যর্থ হয়েছে?
আরো পড়ুন
আজ ১৮ নভেম্বর, দিনটি কেমন যাবে আপনার?
আজ ১৮ নভেম্বর, দিনটি কেমন যাবে আপনার?
জবাবে শ্রীরাধা দত্ত বলেন, ‘ভারত তার নীতিতে ব্যর্থ হয়েছে এটি আমি মনে করি না। প্রতিবেশীদের জিজ্ঞাসা করুন—নেপাল, শ্রীলঙ্কায় ব্যর্থতা কোথায়?’
শ্রীরাধা বলেন, ‘ভারত রাজনৈতিক সমঝোতা করেছে, কোনো ডেবিট, ক্রেডিটের চুক্তি করেনি। বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতাও ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।’
এশিয়া ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ কাজী ফয়সাল বিন সেরাজ বলেন, “নেপালের ওপর ভারত ‘অবরোধ’ দেওয়ার পর নেপাল চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের নতুন রুট খুলেছে। চাপের মধ্যে থেকে অনেক ছোট দেশ বিকশিতও হয়েছে।”
তিনি বলেন, ‘সহযোগিতার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো নিজের প্রয়োজনীয়তার নিরিখে সিদ্ধান্ত নেওয়া।’
চীনের জিলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি শিক্ষার্থী আমনা খান বলেন, ‘পাকিস্তানের সব সময় কারো না কারো সমর্থন, সহযোগিতা দরকার। চীন সব সময় পাকিস্তানের পাশে আছে।’
তিনি বলেন, ‘চীন-পাকিস্তান সস্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। চীন, দক্ষিণ এশিয়া পরস্পরকে প্রয়োজন। পাকিস্তান যখন খুব বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল তখন চীন এগিয়ে এসেছে।’
আমনা খান বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কে ভারসাম্য রাখতে পারছে না। বহু দূরের দেশের দিকে না তাকিয়ে থেকে আমাদের উচিত কাছের দেশের দিকে তাকানো। আঞ্চলিক সম্পৃক্ততা বাড়ানো উচিত।’
এর আগে ইন্দো-প্যাসিফিকে সমুদ্র এলাকার নিরাপত্তাবিষয়ক আলোচনায় ঢাকায় অস্ট্রেলিয়ার ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার নাদিরা সিম্পসন বলেন, অস্ট্রেলিয়ার দৃষ্টিতে বঙ্গোপসাগর অঞ্চল তাদের প্রতিবেশী। বিরোধিতা, মতপার্থক্য সত্ত্বেও সদস্য দেশগুলো কিভাবে ইন্দো-প্যাসিফিকের নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখতে পারে, তা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। আঞ্চলিক শান্তি, স্থিতিশীলতা, আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলাকে অস্ট্রেলিয়া সমর্থন করে।
ভারতের জওয়াহেরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঞ্জয় কুমার ভরধাজ বলেন, ‘মায়ানমার দিয়ে বঙ্গোপসাগরে চীনের প্রবেশাধিকার খুব স্পর্শকাতর ইস্যু। এটি বাংলাদেশ, ভারতের মতো দেশগুলোর জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে। মালাক্কা প্রণালী খুব গুরুত্বপূর্ণ। সবাই বিকল্প পথ খুঁজছে।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিটাইম রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের মহাপরিচালক সৈয়দ মিসবাহ উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক নতুন করে লেখার ওপর জোর দেন।
গতকাল একাধিক আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর পর্বে বাংলাদেশের নির্বাচনে ভারতের ভূমিকা, বিগত নির্বাচনগুলোর সময় গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তিন দিনব্যাপী সম্মেলন আজ সোমবার শেষ হচ্ছে।
সূত্র:কালের কন্ঠ।
তারিখ: নভেম্বর ১৮, ২০২৪
রেটিং করুনঃ ,