লেখক:সজীব আহমেদ।
সাড়ে তিন মাস ধরে সামিট গ্রুপের একটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এতে জাতীয় গ্রিডে এলএনজি সরবরাহ প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো কমে গেছে। ফলে দীর্ঘদিন ধরে শিল্প-কারখানায়, বিদ্যুৎকেন্দ্রে, সিএনজি স্টেশন ও আবাসিকে তীব্র গ্যাসসংকট চলছে। দেশে বিদ্যমান গ্যাসসংকটের মধ্যে এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ থাকায় গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে পেট্রোবাংলাকে।
সামিট গ্রুপ একাধিকবার ঘোষণা দিয়েও টার্মিনালটি সচল করতে পারেনি। এমনকি বন্ধ সময়ের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ সামিট গ্রুপ ২৭০ কোটি টাকা দাবি করেছে জ্বালানি বিভাগের কাছে। এই পরিস্থিতিতে সামিটের এলএনজি টার্মিনাল নিয়ে বিপাকে পড়েছে সরকার।
এদিকে আগামী ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে টার্মিনালটি চালু করতে সামিটকে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, এর আগে টার্মিনাল কবে চালু হবে, তা এক দিনের মধ্যে জানাতে সামিটকে চিঠি দিয়েছিল রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কম্পানি (আরপিজিসিএল)।
চিঠিতে বলা হয়েছে, বিকল টার্মিনাল সচল করার বিষয়ে সামিট গ্রুপ অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। টার্মিনাল দীর্ঘ সময় বিকল থাকায় দেশের ক্ষতি হচ্ছে। বিদ্যুৎ, সার এবং শিল্প খাতে চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না।
ফলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সামিট গ্রুপের কর্মকর্তারা কালের কণ্ঠকে বলেন, জ্বালানি উপদেষ্টার বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই টার্মিনালটি চালু করা সম্ভব হবে। টার্মিনালটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কয়েক মিলিয়ন মার্কিন ডলার লোকসানে সামিট গ্রুপ।
সামিট গ্রুপের দাবি, চুক্তি অনুযায়ী এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ থাকলেও তাদের মাসে ৯০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়ার কথা। তিন মাস ধরে বন্ধ থাকায় ২৭০ কোটি টাকা চার্জ ধরা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, টার্মিনালটি বন্ধ থাকায় গ্যাসসংকটে দেশের শিল্প-কলকারখানাগুলো ধ্বংস হওয়ার পথে। এর পরও সামিট গ্রুপ ২৭০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দাবি করছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
দেশে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রূপান্তর করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহের জন্য কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনাল রয়েছে। একটি স্থাপন করেছে সামিট গ্রুপ। আরেকটি স্থাপন করেছে মার্কিন প্রতিষ্ঠান এক্সিলারেট এনার্জি। দুটি এলএনজি টার্মিনালের সক্ষমতা এক হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। গত ২৭ মে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে সামিটের টার্মিনালটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে এটি মেরামতের জন্য সিঙ্গাপুর নেওয়া হয়। মেরামত শেষে দেশে ফেরার পর গ্যাস সরবরাহ চালুর আগেই আবার দুর্ঘটনায় পড়ে এই টার্মিনালটি। সেটি এখন পর্যন্ত চালু না হওয়ায় এটি থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সামিটের এলএনজি টার্মিনালটি থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় দীর্ঘদিন ধরেই গ্যাস সরবরাহে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। এরই মধ্যে টার্মিনালটির মেরামতকাজ শেষ হয়েছে। আশা করছি, শিগগির টার্মিনালটি থেকে পুনরায় জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ শুরু হবে। তখন গ্যাসসংকট অনেকটাই কেটে যাবে।’
সামিটের টার্মিনাল চালুর তারিখ কয়েক দফা পেছানো হয়। গত ১১ জুলাই এটি চালুর কথা ছিল। এরপর বলা হয়, জুলাইয়ের শেষ দিকে চালু হতে পারে। পরে আগস্টের শুরুতে এবং আগস্টের শেষে চালুর কথা বলা হয়েছিল জ্বালানি বিভাগ ও সামিট গ্রুপ থেকে।
শিল্প-কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুতের সরবরাহ পেতে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আশরাফ আহমেদের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল গত বুধবার জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
এ সময় প্রতিনিধিদল জ্বালানি উপদেষ্টাকে জানায়, বেশ কয়েক মাস ধরে তাঁরা তাঁদের কারখানার জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সরবরাহ পাচ্ছেন না, ফলে তাঁদের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এ সময় তাঁরা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের দাবি জানান।
প্রতিনিধিদলের অভিযোগের জবাবে জ্বালানি উপদেষ্টা জানান, সামিটের এলএনজি টার্মিনালটি গত তিন মাসেরও বেশি দিন যাবৎ বন্ধ থাকায় গ্যাস সরবরাহে বিদ্যুৎ, সার ও শিল্প উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটছে। খুলনার রূপসায় ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি গ্যাসের জন্য চালু করা যাচ্ছে না। টার্মিনালটি ১৫ তারিখ থেকে চালুর চেষ্টা করা হচ্ছে।
পেট্রোবাংলার তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা প্রায় চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এখন সরবরাহ করা হচ্ছে দুই হাজার ৬০৯ মিলিয়ন ঘনফুট। ঘাটতি থাকছে এক হাজার ৩৯১ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। স্বাভাবিক সময়ে দুটি টার্মিনাল থেকে এলএনজি রূপান্তরের মাধ্যমে এক হাজার ৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ হতো। গতকাল একটি টার্মিনাল থেকে এলএনজি সরবরাহ করা হয় মাত্র ৫৯০ মিলিয়ন ঘনফুট। এলএনজি সরবরাহ কমে যাওয়ায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রেও গ্যাসের সরবরাহ কমে গেছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা পিজিসিবি। প্রতিষ্ঠানটির সূত্রে জানা গেছে, গতকাল বিকেল ৩টায় গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় চার হাজার ৯১৮ মেগাওয়াট। যদিও স্বাভাবিক সময়ে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হতো ছয় হাজার ৫০০ মেগাওয়াটের বেশি।
জ্বালানি বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে টার্মিনালটি বিকল হয়ে থাকা অত্যন্ত অস্বস্তিকর। স্পট মার্কেট থেকে কেনা বেশ কয়েকটি এলএনজি কার্গোর সরবরাহ আদেশও বাতিল করতে হয়েছে। জ্বালানি বিভাগ থেকে সামিট গ্রুপকে দ্রুত টার্মিনালটি সচল করতে কয়েকবার বলা হলেও তারা চালু করেনি। এরপর পেট্রোবাংলাকে নির্দেশ দেওয়া হয় সামিটকে চুক্তির বিভিন্ন ধারা ও উপধারা উল্লেখ করে চিঠি দিতে। যাতে খামখেয়ালি করার সুযোগ না পায়।’
সূত্র:কালের কন্ঠ।
তারিখ: সেপ্টম্বর ১০, ২০২৪
রেটিং করুনঃ ,