শ্রীলঙ্কায় ক্রমবর্ধমান গণবিক্ষোভ রুখতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। সহিংসতা দমনের কারফিউর জারির পরদিন শুক্রবার জরুরি অবস্থা জারি করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট গোটাবায়ে রাজাপাকসে। এর ফলে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী সন্দেহভাজনদের আটক করার অবাধ ক্ষমতা পেতে যাচ্ছে। খবর বিবিসি, এএফপি ও আলজাজিরার।
বেশ কয়েক মাস ধরে খাবার, অর্থ, তেল ও বিদ্যুতের ভয়াবহ সংকটে জর্জরিত শ্রীলঙ্কা। ক্রমেই এ পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। এর প্রতিবাদে গত মাস থেকে বিক্ষোভ হচ্ছে। এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতে দেশটির প্রেসিডেন্ট মাহিন্দ্রা রাজাপাকসের বাসভবনের বাইরে তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ে সাধারণ মানুষ। ক্রমেই বিক্ষোভ মিছিল বড় হতে থাকে। রাজধানীর উত্তর, দক্ষিণ, মধ্যাঞ্চল ছাড়িয়ে নুগেগোডা, মাউন্ট লাভানিয়াসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চললেও রাতে সহিংসতা ছড়ায়। এমনকি প্রেসিডেন্টের বাসভবনের বাইরে অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া পুলিশ ও সেনাবাহিনীর গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। এদিন বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে নিতে সাংবাদিকসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বিক্ষোভকালে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। পরে কারফিউ জারি করতে বাধ্য হয় প্রশাসন। তবে শুক্রবার ভোরে এ বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে পুলিশ। এদিন অন্তত ৫৪ জনকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় নিরাপত্তা বাহিনী।
এ বিক্ষোভের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে দেখা যায়, রাজভবনের সামনে প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসেকে পাগল বলে চিৎকার করে তার পদত্যাগের দাবিতে স্লোগান দিচ্ছেন বিক্ষোভকারীরা। তাদের দাবি, রাজাপাকসে এবং তার পরিবারের দুর্নীতির কারণে এ দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য তার পরিবারের যেসব সদস্য বিভিন্ন পদ আঁকড়ে আছেন, তাদের পদত্যাগ করতে হবে। প্রেসিডেন্ট এ ঘটনাকে ‘চরমপন্থিদের কাজ’ বলে মন্তব্য করেছেন।
শ্রীলঙ্কায় বিদ্যুৎ নেই, জ্বালানি নেই। বাড়িতে খাবার ফুরিয়ে যাচ্ছে। শিশুখাদ্য আগেই শেষ। দোকানের তাক ফাঁকা। ব্যাংকও খালি। হচ্ছে না আমদানি। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে যৎসামান্য যা পাওয়া যাচ্ছে, তার দাম আকাশছোঁয়া। স্থানীয় বাজারে যা আসছে, মুদ্রাস্ম্ফীতির জেরে তাতে হাত দিতে পারছে না সাধারণ মানুষ। ভাঙছে ধৈর্যের বাঁধ। ছড়াচ্ছে বিক্ষোভ, উত্তেজনা। বাড়ছে সহিংসতা, জ্বলছে আগুন। এই হলো ‘জুয়েল অব দ্য ক্রাউন’খ্যাত শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতি।
দেশটিতে এখন বৈদেশিক মুদ্রার চরম সংকট চলছে, যা অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলেছে। দিনে ১৩ ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ না থাকা, তেল, খাদ্যপণ্য ও ওষুধ সংকটের কারণে দেশটিতে জনঅসন্তোষ চরমে উঠেছে। এ বিক্ষোভকে একটি বড় ধরনের সরকারবিরোধী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই দেখা হচ্ছে। যদিও ২০১৯ সালে বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন রাজাপাকসে। তিনি তখন স্থিতিশীলতা ও দৃঢ়ভাবে দেশ পরিচালনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তবে সমালোচকরা এ সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির অভিযোগ করেছেন। কারণ প্রেসিডেন্টের ভাই ও ভাতিজারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের আছেন। এটিকেই দেশটির বর্তমান অবস্থার জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে বলছেন অনেকে। এ কারণে রোষানলে পড়েছেন রাজাপাকসে ও তার পরিবার।
বিবিসি জানায়, শ্রীলঙ্কাজুড়ে এখন ১৩ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ থাকছে না। অথচ প্রেসিডেন্ট আর তার মন্ত্রীরা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাচ্ছেন। তাদের পরিবারের সদস্যরাও সম্পদশালী, যা মানুষের মধ্যে ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
বিবিসির এক বিশ্নেষণে বলা হয়েছে, উচ্চভিলাষী অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প, অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ, পরিশোধে বেহাল অবস্থা, আকস্মিকভাবে কর হ্রাস, করোনায় পর্যটন ও রেমিট্যান্স খাতে বিপর্যয়, অর্গানিক চাষাবাদে বাধ্যকরণ, সংকট সমাধানে অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি এবং পরিবারতন্ত্রের কারণে এ সংকটের সৃষ্টি হয়েছে।
সরকার অবশ্য বলছে, করোনা মহামারির কারণে পর্যটন খাত বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণেই এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৯ সালে চার্চগুলোতে সিরিজ হামলার ঘটনাও পর্যটন খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সংকটের শুরু অনেক আগে থেকেই।
বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে ও তার ভাই প্রেসিডেন্ট গোটাবায়ে রাজাপাকসে মিলে দীর্ঘদিন ধরে দেশ পরিচালনা করছেন। তারা অর্থমন্ত্রী করেছেন মাহিন্দার ছেলে বাসিল রাজাপাকসেকে। চামাল রাজাপাকসে, নমাল রাজাপাকসেসহ নিজেদের ছেলে ও ভাতিজাদের মন্ত্রীসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে দুর্নীতি করে যাচ্ছেন। তাদের পরিবারতন্ত্রই সংকটের কারণ।
রাজনৈতিক বিশ্নেষক জায়াদেবা উয়ানগোদা বলেন, ‘কয়েক দশক ধরেই ধীরে ধীরে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তবে কেউ এর দায় নেয়নি। অবশ্যই বর্তমান সরকারের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, অদক্ষতাই এর জন্য সরাসরি দায়ী।’
শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ভিএ ভিজেওয়ার্দানা বলেন, ২০০৯ সালে গৃহযুদ্ধের অবসানের পর শ্রীলঙ্কা কিছু মৌলিক ভুল করেছে। ২০০০ সালে জিডিপির ৩৩ শতাংশ আসত রপ্তানি থেকে। যেটা এখন ১২ শতাংশে নেমে এসেছে। সম্প্রতি লঙ্কান রুপির অবনমন না করাতেও বৈদেশিক মুদ্রার ওপর ব্যাপক চাপ পড়ে যায়। ২০১৯ সালের শেষের দিকে বৈদেশিক মুদ্রা সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলারের মতো থাকলেও এখন তা দুই বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এর মধ্যে ব্যবহারযোগ্য আছে মাত্র ৩০০ মিলিয়ন ডলার। এমনকি আমদানিনির্ভর দেশটির জন্য এখন বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতিশীল প্রবাহও নেই।
শ্রীলঙ্কার হাতে এখন আর তেলের মতো জরুরি দরকারি পণ্য কেনার মতো পর্যাপ্ত ডলার নেই। এর ফলে আরও বেশি সময় ধরেই সেখানকার মানুষজনকে বিদ্যুৎ ছাড়া থাকতে হচ্ছে। বৃহস্পতিবার ১৩ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। সামনের দিনগুলোতে এটি ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত হতে পারে। এতে বিঘ্নিত হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও দৈনন্দিন জীবনযাত্রা। এমনকি কাগজের অভাবে সেখানে পরীক্ষা স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ। একই কারণে দুটি পত্রিকা তাদের প্রিন্ট ভার্সন বন্ধ করেছে। অর্থের অভাবে আমদানি বন্ধ করায় ভয়াবহ খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। তেল সংকট চরমে পৌঁছেছে। তেলের পাম্পগুলোতে মাইলের পর মাইল মানুষের লাইন দীর্ঘ হচ্ছে। রান্নার তেল পাওয়া যাচ্ছে না। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে এ পর্যন্ত অন্তত পাঁচজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। বিশ্নেষকদের আশঙ্কা, সহসা এ পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। সামনে সংকট আরও ঘনীভূত হবে। খবর আলজাজিরা, রয়টার্স ও এনডিটিভির।
সূত্র: সমকাল।
তারিখ: এপ্রিল ০২, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,