ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরো উষ্ণ সম্পর্কের প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়ায়। গতকাল রবিবার ঢাকার একটি হোটেলে বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন (বিওবিসি) সম্মেলনের এক আলোচনায় বিশ্লেষকরা এ ধরনের মন্তব্য করেন।
আলোচনার বিষয় ছিল ‘স্রোতের পরিবর্তন : দক্ষিণ এশিয়া ও গ্লোবাল সাউথে ট্রাম্পের আমেরিকার প্রভাব’। সঞ্চালনা করেন টাইম ম্যাগাজিনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক চার্লি ক্যাম্পবেল।
আলোচনায় অংশ নেন পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও ইসলামাবাদের সানোবার ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান আইজাজ আহমেদ চৌধুরী, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান ও যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিঙ্গুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ, ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও ইনস্টিটিউট অব গ্লোবাল স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট অশোক সজ্জনহার, যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির সিকিউরিটি স্টাডিজের অধ্যাপক ক্রিস্টিন সি ফেয়ার এবং চায়না ফরেন অ্যাফেয়ার্স ইউনিভার্সিটির ডিপ্লোমেটিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক লিপিং শিয়া।
যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্লেষক ক্রিস্টিন সি ফেয়ার বলেন, ‘ট্রাম্প প্রশাসন কর্তৃত্ববাদী হবে। ট্রাম্প যা বলেছেন, তাতে সম্পর্ক অনেক বদলাবে। এই অঞ্চলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্ব পাবে।
ক্রিস্টিন ফেয়ার আরো বলেন, ‘ট্রাম্পের এবারের নিয়োগগুলোর মধ্যে কেবল জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদে নিয়োগকে যথার্থ মনে হয়েছে। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলো হয়তো ট্রাম্পের সরাসরি রাডারের বাইরে থাকবে।’
সঞ্চালক ক্যাম্পবেল জানতে চান, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের বড় সমালোচক ছিল বাইডেন প্রশাসন।
ট্রাম্পের বিজয় কি আওয়ামী লীগের জন্য সুখবর?’
জবাবে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অটোক্রেটিক (স্বৈরাচারী বা স্বেচ্ছাচারী) আমল শুরু হচ্ছে। স্বৈরাচাররা আবেগতাড়িত পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়া ও ইন্দো প্যাসিফিকে ট্রানজেকশনাল (লেনদেনভিত্তিক) নীতি অনুসরণ করলেও আমি বিস্মিত হব না। ট্রাম্পের বিষয়ে অনুমান করা যায় না। তবে দক্ষিণ এশিয়ার নীতির কিছুটা ধারাবাহিকতা থাকবে।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে জোর দেবেন ট্রাম্প।’
আলী রীয়াজ বলেন, ‘একদিকে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক, অন্যদিকে কর্তৃত্ববাদী শাসন।’
ট্রাম্প-মোদির সঙ্গে সম্পর্ক কেমন তা পুতিন বা অন্যদের প্রতি ট্রাম্পের সম্পর্কের ধারা দেখে ধারণা করা যায় উল্লেখ করে আলী রীয়াজ আরো বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার পালাবদল বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য লাভজনক বা কারো চাপের হবে বলে আমি মনে করি না। তবে ভারতের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক এবং মোদি-ট্রাম্প আরো উষ্ণ সম্পর্কের কিছু প্রভাব বাংলাদেশের ওপর পড়বে। এটা ভারত কিভাবে প্রতিবেশীদের ওপর কাজে লাগায় তার ওপর নির্ভর করবে। তবে এটি আওয়ামী লীগ বা কারো জন্য লাভ হবে বলে আমি মনে করি।’
আলী রীয়াজ বলেন, ‘ট্রাম্প যদি প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে জলবায়ু ইস্যুতে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে জলবায়ু ইস্যু বড় ধাক্কা খাবে। ট্রাম্পের নীতিগুলো ধাক্কা খাওয়ার মতোই। বাইডেন প্রশাসন কিছুটা ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছিল।’
আলী রীয়াজ মনে করেন, ট্রাম্পের সময় যুক্তরাষ্ট্রের চীন নীতি আরো আগ্রাসী হতে পারে।
পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব আইজাজ চৌধুরী বলেন, ‘২০১৮ সালে পাকিস্তান নিয়ে ট্রাম্পের টুইট ছিল হতাশার প্রতীক। কারণ আফগানিস্তান থেকে তিনি ইতিবাচক কিছু পাচ্ছিলেন না।’ তিনি মনে করেন, পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক অপরিবর্তিত থাকবে। ট্রাম্প প্রশাসন পাকিস্তান নয়, বরং ভারতকে অংশীদার মনে করবে। পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট সম্পর্ক উষ্ণ হবে না, আবার শীতলও থাকবে না।
তিনি বলেন, ‘ইমরান খানের সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্ক উষ্ণ ছিল। তবে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হয়তো যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে না। যুক্তরাষ্ট্র ক্ষমতাসীন যেকোনো দলের সঙ্গে কাজ করে।’
চীনা বিশ্লেষক লিপিং শিয়া বলেন, ‘ট্রাম্পের আগের মেয়াদে চীনা পণ্যের ওপর ৬০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল। এবারও এমন উদ্যোগ নিলে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে প্রভাব পড়তে পারে। এতে চীনের প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। তাই চীনা পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ শুধু দ্বিপক্ষীয় নয়, বৈশ্বিক ইস্যু।’ ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত অশোক সজ্জনহার বলেন, ‘ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বরাবরই উষ্ণ। কৌশলগত কারণে ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন। ট্রাম্প-মোদি রসায়ন বেশ ভালো। এটি সম্পর্ক আরো এগিয়ে নিতে সহযোগিতা করবে।’
টাইম ম্যাগাজিনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক চার্লি ক্যাম্পবেল বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতিগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে বৈশ্বিক দায়িত্ব, দায়বদ্ধতা থেকে গুটিয়ে নেওয়ার।’
ট্রাম্প প্রশাসনের মায়ানমার নীতি কী হবে জানতে চাইলে আলী রীয়াজ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত মায়ানমারে তার সম্পৃক্ততা কমাবে। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইস্যু গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্পের কাছে সেগুলো তত গুরুত্বপূর্ণ নয়। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র পিছু হটবে এটি আঁচ করা যায়।’
আলী রীয়াজ আরো বলেন, ‘জলবায়ু ইস্যুতে কথা বলা ছাড়া উন্নত দেশগুলো কোনো কাজই করেনি। মালদ্বীপ ডুবলে ইউরোপের দেশগুলোর কী আসে যায়?’
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ট্রাম্পের এক্স বার্তার বিষয়ে দর্শক সারি থেকে একজন জানতে চান। জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্লেষক ক্রিস্টিন বলেন, ‘ট্রাম্প নিজেই একজন রেসিস্ট। পুরুষ শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের ওপর ভর করে তিনি ভোটে জিতেছেন।’
ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে অপপ্রচারের অভিযোগ প্রসঙ্গে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত অশোক সজ্জনহার বলেন, ‘ভারতের গণমাধ্যম স্বাধীন। এখানে কী হচ্ছে তা নিয়েও অনেক মত আছে। যদি কারো মনে হয় সঠিক খবর, তথ্য আসছে না তাহলে এ নিয়ে আলোচনা হতে পারে।’
চীনা বিশ্লেষক লিপিং বলেন, ‘এক চীন নীতি’ চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাইওয়ান স্পর্শকাতর ইস্যু। তাই খুব সতর্কতার সঙ্গে এ বিষয়ে চীনের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশ থেকে কিছু রোহিঙ্গা যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আশ্রয় দিয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন এমনটি করবে কি না জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্লেষক ক্রিস্টিন বলেন, ‘আপনাদের যদি মনে হয় ট্রাম্প রোহিঙ্গা নেবেন তাহলে আপনারা অবাস্তব চিন্তা করছেন।’
বিদেশি শিক্ষার্থীদের যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সুযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে ক্রিস্টিন বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের দুশ্চিন্তার কারণ নেই। কারণ তাঁরা টাকা দিয়ে পড়েন। এটি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম।’
ট্রাম্প আগের নীতিই কেন অনুসরণ করবেন, আর তা কেন ক্ষতিকর হবে—এমন প্রশ্ন উঠেছিল দর্শক সারি থেকে। জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্লেষক ক্রিস্টিন বলেন, ‘সম্ভাব্য প্রশাসন দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে নজিরবিহীন দুর্নীতি আসছে আমেরিকার রাজনীতিতে। এটি একনায়কতন্ত্র। যিনি যা জানেন না, তাঁকে কেবল আনুগত্যের ভিত্তিতে ওই পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।’
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘স্বৈরাচারের দ্বিতীয় মেয়াদ খুব ধ্বংসাত্মক হয়। ইলন মাস্ক আর যার কথাই বলুন না কেন, দিন শেষে ট্রাম্পই সিদ্ধান্ত নেবেন। একনায়করা তাই করেন।’
ভারতে অবস্থানরত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রসঙ্গে একজন প্রশ্ন করেন, ভারত কেন একজন খুনিকে আশ্রয় দিয়েছে?
এ সময় অন্য দর্শক শ্রোতারা করতালি দিয়ে এই প্রশ্নকে স্বাগত জানান।
জবাবে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত অশোক সজ্জনহার বলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক দুই দেশের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ। ভারত তার ‘প্রতিবেশীই প্রথম’, ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ দৃষ্টিতে বাংলাদেশকে দেখে। বাংলাদেশে যে সরকার থাকে তার সঙ্গে ভারত কাজ করে।’
সূত্র:কালের কন্ঠ।
তারিখ: নভেম্বর ১৭, ২০২৪
রেটিং করুনঃ ,