লেখক: আনোয়ার হোসেন ঢাকা
চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমানের লাশ নেই—প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন বক্তব্যের পর দলের শীর্ষ নেতারাও একই সুরে কথা বলছেন। তবে চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে জিয়ার কবর সরিয়ে ফেলার বিষয়টি এ মুহূর্তে সরকারের অগ্রাধিকারের মধ্যে
নেই বলেই মনে করেন আওয়ামী লীগের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা। তাঁরা বলছেন, বিষয়টি বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে জিয়ার কবর সরানোর কোনো পরিকল্পনার কথা না থাকলেও এর পেছনে রাজনৈতিক লক্ষ্য থাকার কথা জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির পাঁচজন জ্যেষ্ঠ নেতা। তাঁদের কেউ কেউ মনে করেন, কবর সরানোর প্রতিক্রিয়া সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে নেতিবাচক হতে পারে। এ জন্য চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার লাশ আছে কি না, সেই প্রশ্ন আগে তোলা হয়েছে। কবরে জিয়ার লাশ নেই—এটা মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করা গেলে সেখানে কবর থাকা না থাকার গুরুত্ব আর বহন করে না। এর মাধ্যমে বিএনপির ওপর রাজনৈতিক চাপও বাড়ে।
সংসদ ভবন এলাকায় জিয়াউর রহমান ছাড়াও সাতজন রাজনীতিকের কবর আছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান ও আতাউর রহমান খান, সাবেক মন্ত্রী মশিউর রহমান যাদু মিয়া, মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার তমিজউদ্দীন খানের কবর রয়েছে সংসদ ভবন এলাকায়। নকশাবহির্ভূত বলে জিয়ার কবর সরানো হলে অন্য সাতজনের কবর সরানোর বিষয়টিও আসবে। একসঙ্গে এতজনের কবর সরানোর প্রতিক্রিয়া নেতিবাচক হবে বলেই মনে করছেন আওয়ামী লীগের অনেক নেতা।
দলের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, কোনো বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিলে কিংবা এর পেছনে কোনো পরিকল্পনা থাকলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি তাঁর বক্তৃতায় তুলে ধরেন। কখনো বক্তব্য দেওয়ার আগে বা পরে তাঁর ঘনিষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনাতেও সে সম্পর্কে ইঙ্গিত দেন। আবার কখনো কয়েকজন নেতা নিজ থেকে বিষয়টি সম্পর্কে দলীয় প্রধানের মনোভাব জানার চেষ্টা করেন। এসব নেতা ‘প্রচার মেশিন’ হিসেবে পরিচিত। তাঁরা দলীয় প্রধানের সংকেত পেয়ে একই বিষয়ে লাগাতার বক্তৃতা দিতে থাকেন। জিয়ার কবর ইস্যুতে এমন পরিকল্পিত কোনো বিষয় আছে বলে তাঁরা মনে করছেন না।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, জিয়ার কবর সরানোর বিষয়টি সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের বিবেচনায় দীর্ঘদিন ধরেই আছে। এ জন্য ২০১৬ সালে লুই আই কানের নকশার (সংসদ ভবন) কপি সংগ্রহ করা হয়। তবে সামাজিক ও ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়টি মাথায় রেখে সরকার কবর সরানোর উদ্যোগ নিয়ে আর এগোয়নি। চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার কবর থাকবে কি থাকবে না, তা নিয়ে ২০১৪ সালে এক বৈঠকে প্রসঙ্গটি তোলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর নানা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার লাশ এখানে আছে কি না, সে প্রশ্ন তুলেছেন। এবার জোরালোভাবে বলেছেন যে খালেদা জিয়াও বিষয়টি জানেন। এ জন্য বেশি আলোচিত হচ্ছে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার কবরে লাশ নেই—এতে সন্দেহ নেই। মানুষকে সত্য জানানো তাঁদের দায়িত্ব। এ জন্যই আওয়ামী লীগ নেতারা বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন। এর সঙ্গে জিয়ার কবর সরানোর বিষয় আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা সরকার বলতে পারবে। তবে লাশই যদি না থাকে, তাহলে কবরের কি মূল্য আছে?
গত ১৭ আগস্ট রাজধানীর চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার কবরে শ্রদ্ধা জানাতে যাওয়া বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এর এক সপ্তাহ পর ২৬ আগস্ট ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে শোক দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, চন্দ্রিমা উদ্যানে বিএনপি (পুলিশের সঙ্গে) মারামারি করল। বিএনপি কি জানে না যে সেখানে জিয়ার কবর নাই বা কবরে জিয়ার লাশ নেই। খালেদা জিয়া তা ভালো করেই জানেন। সেখানে বাক্স আনা হয়েছিল, সে বাক্সের মধ্যে কেউ জিয়ার লাশ দেখতে পায়নি। বাক্সের মধ্যে যে লাশটি ছিল, তা সামরিক পোশাক পরিহিত অবস্থায় ছিল। কিন্তু জিয়া সে সময় রাষ্ট্রপতি ছিলেন। আর রাষ্ট্রপতি সামরিক পোশাকে থাকেন না। তাহলে এত নাটক কেন।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর ২৮ আগস্ট আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার বক্তব্যকে সমর্থন করে চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার লাশ থাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এরপর জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী ও দলের দায়িত্বশীল নেতারাও এ বিষয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার কৃষক লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় ওবায়দুল কাদের আবারও এ প্রসঙ্গ তোলেন। তিনি বলেন, চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমানের কবর থাকবে কি থাকবে না, এ নিয়ে সরকারের এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। কিন্তু জিয়ার লাশ বলে যে কফিনে আনা হয়েছিল, তাতে জিয়ার লাশ ছিল কি না, সেই প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, এরশাদ ওই কফিন বহন করে এনেছিলেন—এটাকে বিএনপি প্রমাণ হিসেবে দাবি করছে। ভেতরে কিছু নেই, কফিন কে বহন করল, এতে কি প্রমাণ হয় সেখানে কার লাশ ছিল?
১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি শেরেবাংলা নগরের উদ্যানের নাম দেয় জিয়া উদ্যান। এর পাঁচ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আগের নাম ‘চন্দ্রিমা উদ্যান’ ফিরিয়ে আনে। পাশাপাশি জিয়ার কবরে যাওয়ার জন্য ক্রিসেন্ট লেকের ওপর যে বেইলি সেতু স্থাপন করা হয়েছিল, তা অপসারণ করা হয়। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে সেখানে কংক্রিটের ঝুলন্ত সেতু নির্মাণের পাশাপাশি একটি কমপ্লেক্স গড়ে তোলে। কমপ্লেক্সের চারদিকে চারটি প্রবেশপথের মধ্যে রয়েছে ঝুলন্ত সেতু, সম্মেলন কেন্দ্র, মসজিদসহ চারটি স্থাপনা।
২০১৪ সালে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় জিয়াউর রহমানের কবরসহ জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় নকশাবহির্ভূত সব স্থাপনা অপসারণের পক্ষে মত দেয়। তখন জাতীয় সংসদে বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার আওয়ামী লীগের সাংসদেরা বক্তব্য দেন। এরপর গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও জাতীয় সংসদ সচিবালয় উদ্যোগী হয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে লুই কানের মূল নকশা সংগ্রহ করে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে। তবে জিয়ার কবর কিংবা নকশাবহির্ভূত স্থাপনা সরানোর আর কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার কবর নিয়ে সাম্প্রতিক আলোচনার বিষয়ে আওয়ামী লীগের আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ইদানীং বিএনপির লোকজন কারণে-অকারণে চন্দ্রিমা উদ্যানে যাচ্ছে। মারামারিও করছে। সে জন্যই সেখানে লাশ না থাকার সত্যটা প্রকাশ করছে আওয়ামী লীগ।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ সেপ্টম্বর ০২, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,