চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে দেশকে আর্থিকভাবে বিপদে ফেলা হচ্ছে বলে মনে করেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, দেশে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান একটি গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে; যাদের হাতে জ্বালানি খাত ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে।
রেহমান সোবহান আরও বলেন, এই গোষ্ঠী অতি মুনাফার জন্য দেশের পরিবেশ ও জলবায়ুর ক্ষতি করে হলেও অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। এ গোষ্ঠীর হাত থেকে দেশের সাধারণ মানুষকে রক্ষা করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক প্রভাব সৃষ্টি করা।
আজ শনিবার ‘জ্বালানি, জলবায়ু ও টেকসই উন্নয়ন’ শীর্ষক দুই দিনের এক সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল নেটওয়ার্ক (বেন) আয়োজিত এ সম্মেলনে দেশ–বিদেশের পরিবেশবাদীরা অংশ নেন। রাজধানীর স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে দুই দিনের এ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের একটি অংশ ভার্চ্যুয়ালি যোগ দেন।
সভাপতির বক্তব্যে রেহমান সোবহান বলেন, দেশের শাসকগোষ্ঠীর বড় অংশ বৈশ্বিক নাগরিক হয়ে গেছে। তারা বছরের বড় সময় উন্নত দেশগুলোতে থাকে। ফলে পরিবেশের কী ক্ষতি হলো আর জলবায়ুর কী পরিবর্তন ঘটল, সেটি তাদের কাছে বড় বিষয় না। এটা তাদের কাছে একাডেমিক বিষয়। এগুলো তাদের স্পর্শ করে না।পরিবেশের ক্ষতি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের গরিব ও সাধারণ মানুষ। এসব মানুষ নদীভাঙন, দখল ও দূষণের বড় শিকার হচ্ছে। তাই পরিবেশ ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে এসব মানুষের কণ্ঠস্বর রাজনীতির মূলধারায় নিয়ে আসতে হবে।
দেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বেশি বলা হচ্ছে, কিন্তু পরিবেশের ক্ষতি ও সামাজিক ন্যায়বিচারের বিষয় সামনে আসছে না বলে উল্লেখ করেন রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা এবং জ্বালানি ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর এই সম্মেলনে আসা উচিত ছিল। কারণ, তাঁরা কীভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে আর এতে দেশের কী ক্ষতি হচ্ছে তা বুঝতে পারতেন।’
বর্তমান সরকারের আমলে দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের রূপান্তরের চিত্র সম্মেলনে তুলে ধরেন সিপিডির চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, এই সরকার ক্ষমতায় আসার সময় দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ফারাক ছিল। প্রধানমন্ত্রী ওই সময় কুইক রেন্টালসহ বিভিন্নভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন দ্রুত বাড়িয়েছেন। কিন্তু এখন দেশে বিদ্যুতের জোগানের সংকট নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোন খাত থেকে কী ধরনের বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে?
দেশে এখন যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে, তাতে সরকার আর্থিক ঝুঁকি নিচ্ছে আর বেসরকারি খাত মুনাফা নিচ্ছে বলে মন্তব্য করেন রেহমান সোবহান। আমাদের তৈরি পোশাক খাতও বৈশ্বিকভাবে প্রতিযোগিতা করে টিকে আছে। সেক্ষেত্রে বিদ্যুৎ খাতকে কেন এখনো এত সুবিধা দিতে হচ্ছে, সেই প্রশ্ন তোলেন তিনি।
বক্তব্যে রেহমান সোবহান বলেন, একসময় বলা হতো, দেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে। কিন্তু সেই গ্যাস কেন উত্তোলন করা হলো না? এখন জ্বালানি তেল, এলএনজিসহ এমন সব উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে; যা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কেনা হচ্ছে। কিন্তু এসব পণ্যের দাম এখন অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে, প্রায়ই অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। এসব উৎসের আন্তর্জাতিক বাজার নিয়ে ভূরাজনীতির হিসাব তৈরি হচ্ছে। জ্বালানির উৎসগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ তৈরি করে চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত এগোচ্ছে।
ভারতের বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী আদানির উদাহরণ টেনে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, কোম্পানিটি অস্ট্রেলিয়ার কয়লাশিল্প খাতে বিশাল বিনিয়োগ করেছে। সেসব কয়লা ভারতে আমদানি করে ঝাড়খন্ডে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাচ্ছে। সেই বিদ্যুৎ আবার বাংলাদেশে রপ্তানির পরিকল্পনা নিয়েছে ভারত। এ ধরনের অর্থনৈতিক হিসাব–নিকাশের মধ্যে বাংলাদেশ কীভাবে তার জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন করবে?
সম্মেলনে বেন–এর প্রধান সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশে লাগামহীন ও অনৈতিক পুঁজিবাদীব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। সরকার প্রচুর ভালো নীতি গ্রহণ করে। দেশে আইন ও নিয়মের অভাব নেই। কিন্তু এগুলো সব শুভঙ্করের ফাঁকি। কোনো কিছু মানা হয় না। তাই আমরা বলছি, নতুন করে আইন করে লাভ নেই। বাস্তবায়ন বেশি জরুরি। সুশাসন আর রাজনৈতিক অঙ্গীকার না থাকলে তা জনগণকে সুফল দেবে না।
‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী’ প্রবাদটি উল্লেখ করে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘যারা বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়ে যাচ্ছে, তারা তো আর আমাদের কোনো কথা শুনবে না। তাই সামনের নির্বাচনকে সামনে রেখে পরিবেশ ধংসকারী জলবায়ু বিপন্নকারীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে হবে আমাদের।’
বাপার সহসভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক খন্দকার বজলুল হক বলেন, রাজনীতি আর রাজনীতিকদের হাতে নেই। ব্যবসায়ী ও আমলারা রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছেন। এ কারণে তাঁরা নিজেদের স্বার্থে এমন সব কাজ করছেন, যাতে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে।
এ ছাড়া বেন–এর সহসভাপতি কামরুল আহসান খান বলেন, দেশে উন্নয়ন প্রকল্প আর শিল্পায়ন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি শুরু হয়েছে। জরুরিভিত্তিতে উদ্যোগ নিয়ে এগুলো থামানো না গেলে দেশের সর্বনাশ হয়ে যাবে।
সমাপনী অধিবেশন সঞ্চালনা করেন বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ ফেব্রুয়ারী ১২, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,