প্রিয় আমার বাবা,
কিছু দিন হলো তোমার বড় ভাইয়ের ( আমাদের বড় চাচা) ধানমন্ডির বাসায় একটি পুরানা ট্রাংকে তোমার হাতের লেখা এই চিঠিটি পেলাম, এখন ২০১৩ সাল, তুমি চিঠিটি লিখেছিলে ১৯৬৭ সালে, সৈয়দপুর থেকে, আজ থেকে ৪৬ বছর আগে, সে সময় কালটা কেমন ছিল আমার জানা নেই তবে বুঝি ওটা পাকিস্থান সরকারের শাসন কাল ছিল । চিঠির রঙ, চিঠির বর্তমান অবস্থা বলে দেয় যে চিঠিটি সত্যই প্রায় অর্ধ শতক আগের লেখা। তোমার একটি বড় স্মুতি আমাদের কাছে এই চিঠিটি।
নানান কারণে চিঠিটি বার বার পড়তে হল, তোমার হাতের লেখা চিঠিটিতে কোন লেখায় কাটাকাটি দেখলাম না, সাদা কাগজের উপর লেখা, কোন লাইন টানা ছিল না, কিন্তু তোমার লেখার মধ্যে কোন লেখার লাইন আঁকা বাঁকা দেখলাম না, অক্ষর, শব্দ বাক্যগুলি স্পষ্ট ও কোন ভুল বানান খুঁজে পেলাম না, মাঝে মাঝে ইংলিশ শব্দগুলি ব্যবহারের কারণে ইংলিশ লেখার প্যটার্নটা কেমন ছিল তাও জানা হল।
চিঠিতে জমি-জমা সংক্রান্ত বিয়য়ে সরকারের Requisition এই সব বিষয়ে তোমার বড় ভাই অর্থাৎ আমাদের বড় চাচা যেন একজন Superintended Engineer এর নজরে আনেন এই সব বিষয়ে লিখেছে।
আমি বেশ স্পষ্ট করে বলতে পারি চিঠি লেখায় তোমার যে দক্ষতা, হাতের লেখার যে দক্ষতা প্রকাশ পেয়েছে তাতে আমি নিজে কিছু লেখা-পড়া করে আমার কিছু সার্টিফিকেট থাকলেও আমার লেখা পড়ার মান তোমার লেখা-পড়ার মানের ধারের কাছেও না। বর্তমানে আমার হাতের লেখার যে প্যাটার্ন তা আমার কোন যোগ্যতা প্রকাশ করে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমার অর্জিত সার্টিফিকেটগুলি একে একে কাউকে দেখানো না হয়।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের ডামাডোলে তোমার অর্জিত, সাজানো-গোছানো অনেক কিছু হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে তোমার ব্রিটিশ পিরিয়ডের লেখা পড়ার অর্জিত সনদ পত্রগুলিও হারিয়ে গেছে তবে অন্ততঃ আমাদের যে শুনা কথা ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষা ব্যবস্থায় তুমি যে মেট্রিকুলেশনে প্রথম বিভাগ পেয়েছিলে কথাটি সত্য তা তোমার এই চিঠিটি প্রমান করে। সে যুগে তুমি ও তোমার বড় ভাই দুই জনেই মেধাবী ছিলে ভাবতে অবাক লাগে ঐ সময়ে মনে হয় ১৯৩০ সালের দিকে তোমার বড় ভাই কি ভাবে সৈয়দপুর থেকে কোলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র হয়েছিলেন!!
আমা বা আমরা লেখা পড়া করেছি বৈদ্যুতিক বাতিতে, তাও আবার নানান ধরণের বৈদ্যুতিক বাতিতে, গরমে চালিয়ে দিয়েছি বৈদ্যুতিক পাখা, আর তোমাদের লেখাপড়া ছিল কেরোসিনের আলোতে আর এটাও বুঝি দিনের আলোকে কাজে লাগিয়ে বেশি সময় ব্যয় করেছ লেখাপড়ার কাজে। সেই তুলনায় আমার বা আমাদের লেখাপড়ার মান আরও অনেক অনেক উন্নত হওয়া উচিত ছিল। লেখাপড়ার ভালো একটা ভিত্তি থাকা উচিত ছিল। এটা আমার কাছে দিবা লোকের মত সত্য যে, তোমার লেখা পড়ার মানের সাথে কখনই আমার মান সন্মত লেখা পড়া করা হয় নাই।
নানান উপকরণের সাহায়্য নিয়ে আমাদের লেখা পড়া, কালির কলম ব্যবহার করি নি বললেই হয়, নানান ঢং এর জ্যামিতি বক্স, ক্যালকুলেটর আর এখন তো কম্পিউটার না থাকলে, ইন্টারনেট না থাকলে লেখা পড়াই হচ্ছে না। আমরা এগিয়েছি অনেক, জেনেছি অনেক, জানিছিও অনেক কিন্তু মনে হয় লেখাপড়ার যে ভিত্তি থাকা উচিত ছিল আমার তা নেই, লেখাপড়ার ভিত্তি আরও মজবুত হওয়া উচিত ছিল। অহরহ ভুল বানানে লেখা; ভাষায়, ব্যকারণে নানান ভুল। হাতের লেখায়, উপস্থপনায় কোথায় আমার যোগ্যতা তোমার লেখাপড়ার তুলনায় !!
আমার মেয়ের অর্থাৎ তোমার নাতনী এবার ক্লাস ওয়ানে, ও তোমাকে দেখি নি, তোমার নাতনীর লেখার সময় লেখার লাইন খুব বাঁকা হয়, সব সময় লাইন সোজা করে লিখতে বলি, বলি যে তোমার দাদুর লেখার লাইন কখনও বাঁকা হত না, বানানে কখনো ভুল হত না, তখন সে বলে ” দেখাও তো আমার দাদুর হাতের লেখা !! ” তখন তোমার এই চিঠিটা দেখাই, দেখে ওয়াও…. বলে মাথায় হাত দিয়ে বলে এত্ত সুন্দর দাদুর হাতে লেখা !!
এখন লেখাপড়ার ধরণে অনেক পরিবর্তন এসেছে, ক্লাস ওয়ানের বাচ্চারাও কোচিং করে, কোন কোন বিষয়গুলি পড়লে ভালো স্কুলে ভর্তি হওয়া যায়, পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া যায় লেখাপড়ার লক্ষ্য এখন এগুলি। লেখাপড়ার ভিত্তি, জানার ভিত্তি কতখানি মজবুত হওয়া প্রয়োজন এখন এ সব নিয়ে ভাবা হয় না।
মহান আল্লাহ তালার কাছে প্রার্থনা করি তোমাকে যেন বেহেন্তবাসী করেন।
ইতি
তোমার ছোট ছেলে।
তারিখ – জুন ২১, ২০১৪
রেটিং করুনঃ ,