লেখক: শওকত হোসেন, ঢাকা।
‘মানি হানি’ নামেই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটের একটি ওয়েব সিরিজ আছে। একবার মাটির নিচে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ব্যাংকের ভল্ট থেকে টাকা চুরির ঘটনা ঘটেছিল এই বাংলাদেশেই। সেই ঘটনাটি অবলম্বন করেই লেখা মানি হানির গল্প। তবে কাহিনিকার সামান্য একটা মোচড় বা টুইস্ট দিয়েছেন গল্পটিতে। ডাকাতেরা সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ব্যাংকের ভল্ট থেকে নিয়ে যায় ২১ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাংকটির পক্ষ থেকে করা মামলায় বলা হয় খোয়া গেছে সব মিলিয়ে ১২১ কোটি টাকা। তাহলে বাকি ১০০ কোটি টাকা কে নিল?
আজকের প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছে বেসরকারি খাতের ইউনিয়ন ব্যাংকের ভল্ট থেকে ১৯ কোটি টাকা উধাওয়ের একটি খবর। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল ব্যাংকটির গুলশান শাখায় হঠাৎ পরিদর্শন করে ভল্টে রাখা অর্থের হিসাবের এই গরমিল খুঁজে পায়। যদিও ব্যাংক থেকে টাকা উধাওয়ের ঘটনা এই প্রথম নয়। দেশে ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাৎ বা উধাও করার অসংখ্য উদাহরণ আছে। এমনিতে ৫০ বছর ধরেই দেশে নিত্যনতুন পথ বের করে ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
শুরু হয়েছিল সরাসরি ব্যাংক ডাকাতির মধ্য দিয়ে। ১৯৭২ সালের ১৮ জুন জনতা ব্যাংকের ঢাকা মেডিকেল কলেজ শাখা থেকে ৪৩ হাজার ৬০০ টাকা ডাকাতি হয়েছিল। দৈনিক বাংলার ১৯ জুন পত্রিকায় তা ফলাও করে ছাপা হয়েছিল। প্রকাশিত সংবাদটির শেষ কয়েকটি লাইন হচ্ছে, ‘সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের বয়স ২০ থেকে ২৫ বছর হবে বলে ব্যাংকের ম্যানেজার জানান। তাদের কাউকে দেখতে দুর্বৃত্ত মনে হয়নি। প্রত্যেকেই বেশ অবস্থাপন্ন পরিবারের ছেলে বলে মনে হচ্ছিল। এ ব্যাপারে থানায় ডায়েরি করা হয়। পুলিশ তদন্ত চালাচ্ছে।’
ঘটনাটি সে সময় যথেষ্ট আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। তবে যুগ পালটে গেছে। এখন আর সশস্ত্র ব্যাংক ডাকাতদের সেই রমরমা অবস্থা নেই। কেননা এখন ‘ব্যাংক ডাকাতি’র নতুন নতুন পদ্ধতি বের হয়েছে। এখন ব্যাংক ডাকাতির জন্য আগ্নেয়াস্ত্র লাগে না। যেমন, ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়াও কিন্তু একধরনের ব্যাংক ডাকাতি, যা প্রতিবছরই জ্যামিতিক হারে বাড়ে। এ জন্য দরকার কেবল কিছু নথিপত্র। এই পদ্ধতির ব্যাংক ডাকাতিতে সহায়তার জন্য ব্যাংক কর্মকর্তারা আছেন, সরকারের দেখেও না দেখার ভান আছে, প্রয়োজনীয় নমনীয় নীতি সহায়তা আছে, আর যদি কোনো ব্যাংকের মালিক হন, তাহলে তো অন্য ব্যাংকের মালিকদের সঙ্গে এ নিয়ে পারস্পরিক সমঝোতা আছে। ব্যাংক থেকে অর্থ নেওয়ার এত সহজ সহজ পথ থাকতে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ডাকাতি করার কী দরকার। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যেভাবে রিজার্ভের অর্থ চুরি হলো, তাতে তো কোথাও একটি টোকাও দিতে হয়নি।
আবার ১৯৯৯ সালের ২৬ আগস্ট ইউসিবিএল ব্যাংক দখল করতে আওয়ামী লীগের তৎকালীন শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক আখতারুজ্জামান বাবুকে কিন্তু অস্ত্র নিয়েই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে হামলা করতে হয়েছিল। এখন আর ব্যাংক দখল করতে অস্ত্রের কোনো দরকারই নেই। রাজধানীর র্যাডিসন হোটেলে ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারিতে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ইসলামী ব্যাংকের তখনকার চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদত্যাগ করেছিলেন। ওই দিন নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন সাবেক সচিব আরাস্তু খান ও এমডি পদে আসেন চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ইউনিয়ন ব্যাংকের এমডি আবদুল হামিদ মিঞা। এভাবে ব্যাংকের মালিকানা বদলে সরকারের সহায়তা ছিল, অনুমোদন দেওয়ার জন্য বসেই ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংক দখলের সেই পথ দেখানো শুরু।
তারপরও মালিকানা বদলের (পড়ুন, ব্যাংক দখল) এ রকম বেশ কয়েকটি উদাহরণ তৈরি হয়ে আছে। সব মিলিয়েই বলা যায়, সব পদ্ধতিই এখন সহজ হয়ে যাচ্ছে।
তবে ভল্ট থেকে টাকা গায়েবের ঘটনাটি সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে। টাকা নেওয়ার সবচেয়ে সহজ পথ বের করার জন্য ইউনিয়ন ব্যাংককে অবশ্যই ধন্যবাদ জানাতে হয়। ব্যাংকঋণের অর্থ আত্মসাৎ করতে হলে কোম্পানি তৈরি করতে হয়, প্রকল্প বানাতে হয়, তারপর বানাতে হয় নানা ধরনের দলিলপত্র। ঝামেলা আরও আছে। ঋণের প্রস্তাব ব্যাংকের পর্ষদে অনুমোদন হতে হয়, তারপরই পাওয়া যাবে ঋণ। সেই ফেরত না দেওয়ার জন্যও নানা ধরনের কৌশল করতে হয়। বিভিন্ন ধরনের মানুষকে খুশি রাখতে হয়। এর চেয়ে সহজ পথ হচ্ছে ভল্ট থেকে সরাসরি অর্থ নিয়ে যাওয়া।
ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের ব্যাংক ডাকাতির সঙ্গে তুলনা করে একসময় সংবাদ সম্মেলন করেছিল বেসরকারির খাতের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। যদিও ব্যাংক ডাকাতদের বিরুদ্ধে, অর্থাৎ খেলাপি ঋণ আদায়ে কোনো সরকারই কঠোর কোনো অবস্থান নেয়নি। এ কারণে কেবলই বেড়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। আর এখন তো ঋণখেলাপিদেরই রাজত্ব। সর্বকালের নমনীয় নীতি কাঠামোর মধ্যেই তাঁরা আছেন। তবে এত দিন সবার ধারণা ছিল, গ্রাহক সেজে ব্যাংক ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়াটাই বোধ হয় একমাত্র রীতি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সেই ঝামেলাতেও অনেকে যাচ্ছেন না। এখন ভল্ট থেকেই সরাসরি অর্থ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে ভল্ট খুলে অর্থ নেওয়ার ঘটনা জানাজানি হলো এই প্রথম। এটি যেকোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থার জন্য স্মরণীয় একটি দিন। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক কতটা কঠোর অবস্থান নিতে পারে সেটাই দেখার বিষয়। যদিও ব্যাংক এখন বলছে, ভল্ট থেকে অর্থ নেওয়ার সুযোগ সবার জন্য নয়, কেবল ভিআইপিদের জন্যই এই সুযোগ তারা দিয়েছে, তা–ও নির্ধারিত ব্যাংক লেনদেনের সময়ের পরে। এই ভিআইপি হতে কী কী শর্ত পূরণ করতে হবে, সেটা এখন ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে জানালেই হয়।
মানি হানি নামের ওয়েব সিরিজ দিয়ে শুরু করেছিলাম। সেই প্রসঙ্গে আবার। তার আগে প্রথম আলোয় প্রকাশিত ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক মঈনউদ্দীনের একটি মন্তব্য এখানে প্রাসঙ্গিক হবে। তিনি বলেছেন, ‘নথিতে থাকার হিসাব বা ঘোষণার এক পয়সাও ভল্টে কম থাকার কোনো সুযোগ নেই। যদি কোনো গরমিল হয়, তাহলে বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশকে অবহিত করতে হয়। যদি কোনো ব্যাংক সেটি না করে, তবে বুঝতে হবে সেখানে কোনো সমস্যা আছে।’
মানি হানি সিরিজেও ডাকাতি হওয়া ব্যাংক শাখার ম্যানেজার পুলিশকে সবকিছু জানান ঘটনার অনেক পরে। কারণ, আসলেই সেখানে সমস্যা বা ঝামেলা ছিল। সিরিজটিতে যথেষ্ট ইঙ্গিত দেওয়া আছে যে ভল্ট থেকে ২১ কোটি টাকা ডাকাতি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বাকি ১০০ কোটি টাকা সরিয়ে ফেলার সঙ্গে ম্যানেজার নিজেই জড়িত। তবে তিনি একা কাজটি করেননি। মালিকপক্ষের একটি অংশই ভল্ট থেকে অর্থটা সরিয়েছে, ম্যানেজার ছিলেন সহায়ক মাত্র। মানি হানি সিরিজে ভল্ট থেকে মালিকপক্ষ ১০০ কোটি টাকা কীভাবে সরিয়েছে, তা জানা যাবে এর দ্বিতীয় পর্ব মুক্তি পেলে। আর ইউনিয়ন ব্যাংকের ভল্ট থেকে কীভাবে ১৯ কোটি টাকা গায়েব হলো সেটিও জানা যাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তের পরে (যদি করে)।
দুটি ঘটনারই শেষ জানার অপেক্ষায় থাকলাম।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ সেপ্টম্বর ২৩, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,