লেখক:সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় নয়াদিল্লি।
২১ জুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিউইয়র্ক পৌঁছাচ্ছেন। পরের দিন হোয়াইট হাউসে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাবেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আসন্ন যুক্তরাষ্ট্র সফর দুই দেশের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে চলেছে। সই হতে চলেছে অন্তত দুটি বড় চুক্তি, যার একটি ৩০০ কোটি ডলারের অত্যাধুনিক ‘এমকিউ-৯বি সি গার্ডিয়ান’ সশস্ত্র ড্রোনসংক্রান্ত, অন্যটি ভারতে তৈরি ‘তেজস’ যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন নিয়ে, যা প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে জেনারেল ইলেকট্রিকের সহায়তায় তৈরি হবে কর্ণাটকের রাষ্ট্রায়ত্ত হিন্দুস্তান অ্যারোনটিকস লিমিটেডে (হ্যাল)।
দিল্লি ও ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, এই চুক্তির দিকে দুই দেশের নজর যতটা নিবদ্ধ, ততটাই আগ্রহে এই সফরের দিকে তাকিয়ে আছে বাংলাদেশ। সে দেশের জাতীয় সংসদের নির্বাচন ‘সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ’ করে তুলতে যুক্তরাষ্ট্র তাদের নতুন যে ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে, যা নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি এই মুহূর্তে সরগরম, সে বিষয়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের নিরন্তর চাপ, নতুন ভিসা নীতির মধ্য দিয়ে যা প্রতিফলিত, বাংলাদেশ তো বটেই, ভারতকেও তা খানিকটা অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছে। ওই নীতির রূপায়ণ, দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে তার সম্ভাব্য প্রভাব এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রশ্ন ভারতের অস্বস্তি ও চিন্তার কারণ। যুক্তরাষ্ট্রের এই নয়া ফরমান নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহল পরস্পরের সঙ্গে একাধিকবার কথা বলেছে। বাংলাদেশকে এই বিষয়ে আশ্বস্তও করা হয়েছে যে আসন্ন সফরে এ নিয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদি অবশ্যই মতবিনিময় করবেন।
দিল্লি ও ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, এই চুক্তির দিকে দুই দেশের নজর যতটা নিবদ্ধ, ততটাই আগ্রহে এই সফরের দিকে তাকিয়ে আছে বাংলাদেশ।
সম্প্রতি ভারতের উত্তর প্রদেশের বারানসিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। সেখানে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে তাঁর একান্ত বৈঠক হয়। নির্বাচন, নতুন ভিসা নীতি, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও যুক্তরাষ্ট্রের ‘চাপ’ নিয়ে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে বিস্তারিত কথা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানের সঙ্গে গত সপ্তাহে নয়াদিল্লিতে বৈঠক করেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। ওই বৈঠকে তাঁকে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের এমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া ঠিক হবে না, যাতে ভারতের স্বার্থ বিনষ্ট হয় ও আঞ্চলিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। ভারতের এই স্পষ্ট অভিমত বাংলাদেশকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে দুই দেশের কূটনৈতিক মহলের খবর। এরও আগে জয়শঙ্করের সঙ্গে দিল্লিতে বৈঠক করেছিলেন ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মুস্তাফিজুর রহমান। সেই বৈঠকেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, নতুন ভিসা নীতি এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও স্থিতিশীলতা নিয়ে আলোচিত হয়েছিল। গত মে মাসের শেষে নতুন ভিসা নীতি ঘোষণার পর বাংলাদেশকে ভারতের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহল বারবার আশ্বস্ত করে বলেছে যে যুক্তরাষ্ট্র সফর চলাকালে প্রধানমন্ত্রী মোদি সর্বোচ্চ স্তরে অবশ্যই বিষয়টি উত্থাপন করবেন।
মোদির এই সফরের দিকে বাংলাদেশের দৃষ্টি স্বাভাবিক কারণে তাই এত স্থির। ২১ জুন মোদি নিউইয়র্ক পৌঁছাচ্ছেন। পরের দিন হোয়াইট হাউসে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভ্যর্থনা জানাবেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। দুই নেতার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনাও ওই দিনেই। এই সফর ও বাংলাদেশের নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সক্রিয়তা’ নিয়ে আলোচনার সম্ভাবনা কতখানি, সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ভারত সরকারের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা গত শুক্রবার বলেন, প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে প্রতিটি বৈঠকেই প্রধানমন্ত্রী মোদি প্রতিবেশীদের নিয়ে আলোচনা করেন। প্রতিবেশীদের নিয়ে দুই নেতারই আগ্রহ যথেষ্ট।
দুই স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের পারস্পরিক মতবিনিময়ে তৃতীয় দেশ হিসেবে ভারতের কোনো ভূমিকা নেই। সেই নিরিখে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের যা কিছু হচ্ছে, তা ওই দুই দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে ভারত মনে করে। ফলে নতুন ভিসা নীতি ও নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ প্রসঙ্গে ভারত আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করছে না। ভারত বারবার বলেছে, বাংলাদেশের মানুষ কাকে ভোট দেবেন, কোন দলকে সমর্থন করবেন, তা তাঁদের বিষয়। এ বিষয়ে ভারত অনধিকার চর্চা করে না, করবেও না। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে বলে ভারত সেই সব ঘটনা থেকে চোখ ফিরিয়েও থাকতে পারে না। আঞ্চলিক ও ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ভারত তাই স্বাভাবিক কারণেই আগ্রহী।
যুক্তরাষ্ট্রকে ভারত বোঝাবে, সেই ভারসাম্য কিংবা আঞ্চলিক সুস্থিতি নষ্ট হয় এমন কিছুর জন্য বাংলাদেশকে জোরাজুরি করাটা ঠিক হবে না। চীনের দিকে বাংলাদেশের বেশি মাত্রায় ঝুঁকে পড়া যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত কারও পক্ষে মঙ্গলজনক নয়, সে কথাও বোঝানো হবে।
তা ছাড়া ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা ও সুস্থিতির প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র যতটা উদ্বিগ্ন, ভারতও ততটাই এবং এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গুরুত্ব অসীম। সেই গুরুত্ব অনুধাবন করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সম্প্রতি এই বিষয়ে তাঁর দেশের নীতি ঘোষণা করেছেন। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, সংগত কারণেই প্রধানমন্ত্রী মোদি যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাবেন আঞ্চলিক স্বার্থে হাসিনার ক্ষমতাসীন থাকার অর্থ কী। তাঁর ক্ষমতাসীন থাকা না-থাকার ওপর আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তির মাথাচাড়া দেওয়া না-দেওয়ার প্রশ্নটি যে গভীর সম্পর্কযুক্ত, সে কথা বাইডেনকে মোদি জানাবেন বলে বিভিন্ন সূত্রের খবর। বোঝাবেন, এমন কিছু করা উচিত হবে না, যাতে আঞ্চলিক অপশক্তি উৎসাহ পায়।
ভারতের দ্বিতীয় চিন্তা চীনকে নিয়ে। এশিয়ার এই বৃহৎ শক্তিকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রও চিন্তিত। বাংলাদেশের ওপর চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব যথেষ্ট। যদিও রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দিক থেকে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশ ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে ভারত বোঝাবে, সেই ভারসাম্য কিংবা আঞ্চলিক সুস্থিতি নষ্ট হয় এমন কিছুর জন্য বাংলাদেশকে জোরাজুরি করাটা ঠিক হবে না। চীনের দিকে বাংলাদেশের বেশি মাত্রায় ঝুঁকে পড়া যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত কারও পক্ষে মঙ্গলজনক নয়, সে কথাও বোঝানো হবে।
দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রগুলো মনে করছে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র স্বাভাবিকভাবে প্রসারিত হবে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে না এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের স্বার্থ রক্ষিত হবে, এমন একটা বাতাবরণ সৃষ্টি হওয়া জরুরি। এই মহলের মতে, এর আগে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের দুটি নির্বাচন যেভাবে হয়েছে এবং ভারত যেভাবে শেখ হাসিনা সরকারকে সমর্থন জানিয়েছে, তার পুনরাবৃত্তি মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়। বাংলাদেশকে ভারত সে কথা জানিয়ে দিয়েছে বলেও এই মহলের দাবি। তাঁরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি ঘোষণার পর সে দেশের স্থানীয় নির্বাচনগুলো নির্বিঘ্ন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এটা সুলক্ষণ। জাতীয় নির্বাচনও এমন সুষ্ঠুভাবে ও শান্তিতে হওয়া দরকার।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:জুন ১৮, ২০২৩
রেটিং করুনঃ ,