লেখা: সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়নয়া দিল্লি।
এতকাল যে কাজ করা হয়নি, হঠাৎ কেন তা-ই করল ভারতের কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার? বাংলাদেশে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সে দেশের সংখ্যালঘু নির্যাতন ঠেকিয়ে তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কেন বিএসএফের নেতৃত্বে কমিটি গড়া হলো? গত ১০ বছর কেন, আগেও এমন কমিটি গঠনের কথা শোনা যায়নি।
এই প্রশ্নের উত্তর রয়েছে বিজেপির চিরায়ত রাজনীতির মধ্যে। উগ্র হিন্দুত্ববাদের যে ধ্বজা উড়িয়ে দলটি রাজত্ব করছে, তা রক্ষার তাগিদই এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরাসহ পূর্ব ভারতের বিএসএফের ইস্টার্ন কমান্ড ও স্থলসীমান্ত কর্তৃপক্ষের কর্তাদের নিয়ে গঠিত ওই কমিটি গঠনের ফলে কাজের কাজ কতটা হবে, তা নিয়ে সংশয় থাকলেও এটা স্পষ্ট যে এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিজেপি হিন্দু মননে প্রলেপ দিতে চাইছে। আশ্বস্তও করতে চাইছে। এটা করা তাদের কাছে জরুরি ছিল; কারণ, পূর্ব ভারতে তাদের দল বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার বন্ধে সরকারকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে আসছে। এমনকি রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) সাধারণ সম্পাদক দত্তাত্রয়ে হোসাবলে বিবৃতি দিয়ে সরকারকে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এর আগেও হিন্দুত্ববাদী মূল ভোট ব্যাংককে এভাবে আশ্বস্ত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু সেটা হয়তো পর্যাপ্ত ছিল না। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে শপথ গ্রহণের পর নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পাঠানো শুভকামনা জানানোর বার্তায়ও মোদি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। এর আগে অবশ্য ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উদ্বেগ প্রকাশ করার পাশাপাশি হিন্দু স্বার্থ রক্ষায় বাংলাদেশের মুসলমান সমাজের এগিয়ে আসা, হিন্দু পরিবার ও উপাসনালয় পাহারা দেওয়ার প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানিয়েছিল। ভারতের শশী থারুর, জয়রাম রমেশসহ বহু রাজনৈতিক নেতা উদ্বেগ প্রকাশ করার পাশাপাশি এই উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকারের কমিটি গঠনের উদ্যোগ বুঝিয়ে দিচ্ছে, বিজেপি বেজায় অস্বস্তিতে রয়েছে।
‘ইন্ডিয়া’ জোট জগদীপ ধনখড়ের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার উদ্যোগ নেয়। সেই প্রস্তাবে ৮৭ জন সদস্য সই করেন। এই সময়েই বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব ঠিক করেন, সংসদ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হবে।
বিজেপির অস্বস্তির অবশ্য অন্য কারণও রয়েছে। প্রধান কারণ সংসদে একার সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকা। শরিকি নির্ভরতায় সরকার চালানো। নির্ভরশীল হলেও সরকার যে দুর্বল নয়, শুরু থেকেই বিজেপি নেতৃত্ব তার প্রমাণ রাখতে চেয়েছে। বিভিন্নভাবে বোঝাতে চেয়েছে, ১০ বছর যে প্রতাপ ও প্রতিপত্তিতে তারা সরকার চালিয়েছে, তা থেকে বিচ্যুত হবে না। সেই দাপট চালিয়ে যাবে। তার প্রমাণ দিতে তারা সব গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় নিজেদের কাছে রেখেছে। শীর্ষ নেতারা যে যে দপ্তরের দায়িত্বে ছিলেন, সেগুলো তাঁদের হাতেই রাখা হয়েছে। এমনকি লোকসভা ও রাজ্যসভার দুই অধ্যক্ষকেও তারা বদল করেনি। বর্ষাকালীন অধিবেশন শেষ হয়ে গেলেও এখনো লোকসভার ডেপুটি স্পিকার পদে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়নি। পাঁচ বছরের বেশি এই পদ শূন্য। সংসদের কক্ষে বিরোধীদের সঙ্গে আগে যে ব্যবহার করা হয়েছে, এখনো তেমনই চলছে। কিন্তু তবু বিজেপি স্বস্তিতে থাকতে পারছে না। পারছে না বলেই তৃতীয় দফার রাজত্বের শুরুতেই বিতর্কিত ওয়াক্ফ সংশোধনী বিল যুগ্ম সংসদীয় কমিটির বিবেচনার জন্য পাঠানো হলো। গত ১০ বছরে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (২০১৬) ও তথ্য সুরক্ষা বিল (২০১৯) দুটি ছাড়া একটি বিলও বিজেপি যুগ্ম সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠায়নি। এবার করল, যেহেতু শরিক দলের মধ্যেই এই নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সংসদে সম্মিলিত বিরোধী শক্তির প্রতিরোধের মুখে বিজেপির অস্বস্তি আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। সংসদ পরিচালনার ক্ষেত্রে তারা দৃশ্যত বিব্রত। লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা ও রাজ্যসভার চেয়ারম্যান জগদীপ ধনখড় আগের মতো এবারও পর্যাপ্ত সুযোগ দিচ্ছেন না বলে বিরোধীদের অভিযোগ। নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে সভার অধিকার ভঙ্গের অভিযোগ জানানো হয়, কিন্তু বর্ষাকালীন অধিবেশন শেষ হয়ে গেলেও লোকসভার স্পিকার সে বিষয়ে মতামত জানাননি। অথচ গত লোকসভায় কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী ও তৃণমূল কংগ্রেসের মহুয়া মৈত্রর সংসদ সদস্য পদ খারিজ করতে তিনি দেরি করেননি। বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী বারবার তাঁর মাইক বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ জানিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য সভার কার্যবিবরণী থেকে অন্যায়ভাবে বাদ দেওয়ার অভিযোগ এনেছেন। বলতে না দেওয়ার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। নতুন সংসদের দুই অধিবেশন হয়ে গেল অথচ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনার জন্য একটিও মুলতবি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়নি। এর প্রতিবাদে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ যেভাবে সংসদের অভ্যন্তরে ও বাইরে সরব, তা বিজেপির অস্বস্তি আরও বাড়িয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উদ্বেগ প্রকাশ করার পাশাপাশি হিন্দু স্বার্থ রক্ষায় বাংলাদেশের মুসলমান সমাজের এগিয়ে আসা, হিন্দু পরিবার ও উপাসনালয় পাহারা দেওয়ার প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানিয়েছিল।
এই অস্বস্তির কারণেই তিন দিন আগে বন্ধ করে দেওয়া হলো সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশন। যে অধিবেশন আগামী সোমবার পর্যন্ত চলার কথা ছিল, তা গত শুক্রবারই শেষ করে দেওয়া হয়। যে কারণে এটা করা, তা কার্যকর হলে সেটা হবে ভারতের সংসদীয় ইতিহাসের অভূতপূর্ব ঘটনা। স্পষ্টতই বিজেপি সেই বিড়ম্বনা এড়াতে চেয়েছে।
বিরোধীদের ক্ষোভ রাজ্যসভার চেয়ারম্যান উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়কে নিয়ে।
শাহবাগে বাংলাদেশ সচেতন সনাতনী নাগরিকের ব্যানারে বিক্ষোভ হয়েছে। ঢাকা, ৯ আগস্ট
শাহবাগে বাংলাদেশ সচেতন সনাতনী নাগরিকের ব্যানারে বিক্ষোভ হয়েছে। ঢাকা, ৯ আগস্টছবি: সংগৃহীত
কিছুদিন ধরেই ধনখড়ের আচরণ ‘মাত্রাছাড়া’ হয়ে যাচ্ছিল বলে বিরোধীদের অভিযোগ। কথায় কথায় তিনি বিরোধীদের বলতে বাধা দিচ্ছিলেন। কথায় কথায় সভার শালীনতা রক্ষার বিষয়টা মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন। বিরোধীদের বক্তব্য কার্যবিবরণী থেকে বাদ দিচ্ছিলেন। মাইক বন্ধ করে দিচ্ছিলেন। অহেতুক কারণে সদস্যদের নাম করে ভর্ৎসনা করছিলেন। শুক্রবার তা চরমে ওঠে। বিরোধীদের দিকে আঙুল তুলে স্পিকার বলেন, ‘আপনারা সংবিধান ও গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন। আপনারা দেশকে অস্থির করে তুলতে চাইছেন।’ ধনখড়ের আচরণে বিরক্ত হয়ে সমাজবাদী পার্টির সদস্য জয়া বচ্চন একসময় বলেন, ‘আমি একজন অভিনয়শিল্পী। শরীরী ভাষা ও বাচনভঙ্গি আমার চেনা। আমি তা পড়তে পারি। আপনি যে ভঙ্গিতে কথা বলছেন, তা গ্রহণযোগ্য নয়।’ জয়া বচ্চন আরও বলেন, ‘এখানে আমরা সবাই এক। কেউ স্কুলপড়ুয়া নই। আপনি সভার পরিচালক ঠিকই, কিন্তু আপনিও আমাদের মতো একজন।’
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে শপথ গ্রহণের পর নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পাঠানো শুভকামনা জানানোর বার্তায়ও মোদি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন।
জয়াকে আর কিছু বলতে না দিয়ে ধনখড় তাঁর ক্ষোভ উগরে দেন। জয়ার উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘অভিনেতারা কিন্তু পরিচালকের নির্দেশ মেনে অভিনয় করেন। আমাকে শেখানোর দরকার নেই। আপনি আমার স্বরক্ষেপণের ভঙ্গিমা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন?’ এই বিতর্কের মধ্যে বিরোধীরা সবাই কক্ষ ত্যাগ করেন। ওয়াকআউটের নেতৃত্ব দেন কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী। সভার বাইরে জয়া সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ধনখড় সংসদ সদস্যদের অপমান করেছেন। তাঁকে ক্ষমা চাইতে হবে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ওপর নজর রাখতে কমিটি করেছে ভারত
০৯ আগস্ট ২০২৪
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ওপর নজর রাখতে কমিটি করেছে ভারত
এই ঘটনার পর ইন্ডিয়া জোট ধনখড়ের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার উদ্যোগ নেয়। সেই প্রস্তাবে ৮৭ জন সদস্য সই করেন। এই সময়েই বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব ঠিক করেন, সংসদ শুক্রবারেই অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হবে। বিজেপি চায়নি, সোমবার বিরোধীরা রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের অপসারণের নোটিশ জমা দিক। সেটা হলে তা হতো ভারতের সংসদীয় ইতিহাসে প্রথম।
দৃশ্যত তো বটেই, বাস্তবিকই নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় দফার রাজত্বে বিজেপি ও সরকার প্রবল চাপে আছে। সেই চাপ কাটাতেই বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের রক্ষায় কমিটি গঠন। সেই চাপের দরুনই তড়িঘড়ি সংসদের অধিবেশন মুলতবি করে দেওয়া। সেই চাপের জন্যই এত দিন ধরে বলে আসা আর্থিক সংস্কারের পথ থেকে সরকারের সরে আসা। ব্যাংক বেসরকারীকরণের কথা এত দিন ধরে বলে এসেও শুক্রবার তা থেকে সরকার পিছিয়ে এল। ব্যাংক আইনে সংশোধনী বিল পেশ করলেও তাতে বেসরকারীকরণের কথা রাখা হলো না।
এভাবে কত দিন চালাতে পারবেন নরেন্দ্র মোদি? প্রশ্নটি রাজনৈতিক মহল ও সামাজিক মাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: আগষ্ট ১০, ২০২৪
রেটিং করুনঃ ,