ব্রিটেনের প্রভাবশালী ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘দ্য ইকোনমিস্ট’-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভিন্ন ইস্যুর প্রাধান্য থাকলেও, শেষ বিচারে তা দিশাহীন। পত্রিকাটির অনলাইনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সম্প্রতি বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে এটা এক অপরিবর্তনীয় ঐতিহ্য যে, যখন কোনো দল ক্ষমতায় যায় সে বিরোধীদের যেকোনো দাবিদাওয়াকে ভিত্তিহীন প্রতিপন্ন করে।’
দ্য ব্যাটেলিং বেগমস’ শিরোনামের নিবন্ধটি পত্রিকার এ সপ্তাহের ছাপা সংস্করণেও প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়, ‘ঈদুল ফিতরের আগে বাংলাদেশের প্রধান দুই “কলহমুখর” নেত্রী শুভেচ্ছাসূচক ঈদকার্ড বিনিময় করেছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দল বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়ার মধ্যে শান্তির ন্যূনতম আভাস দৃশ্যত নেই।’
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাপ্তাহিকটি এ দেশে অবস্থানকারী বিদেশি কূটনীতিকদের উদ্ধৃত করেছে। পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘একজন ইউরোপীয় কূটনীতিক বলেছেন, তিনি তাঁর (দেশের) রাজধানীতে দুটি তারবার্তা পাঠিয়েছেন। প্রথম চিঠিতে তিনি আগামী জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের ক্রমবর্ধমান সম্ভাবনার কথা আলোচনা করেছেন। দ্বিতীয়টিতে “রাজত্বের উত্তরাধিকার” নির্ধারণ নিয়ে “লড়াইরত দুই বেগমের” পরিকল্পনার কথা আলোচনা করা হয়েছে।’
নির্বাচন কমিশনের জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন আদালত কর্তৃক ‘অবৈধ’ ঘোষিত হওয়ার পর আসছে নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ লিখেছে, ‘নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে দেওয়া আদালতের এই রায় হয়তো আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়কে নিশ্চিত করেছে; কারণ বিএনপির ভোটে জেতার ক্ষেত্রে জামায়াত তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মিত্র।’
তবে এরপরও বাংলাদেশের অনেক মানুষের মধ্যে আওয়ামী লীগের পুনর্নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছে পত্রিকাটি। ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ বলছে, ‘এ সন্দেহ শুধু এ কারণে নয় যে বাংলাদেশে একই দলের পরপর দুবার ক্ষমতা গ্রহণের নজির নেই। বরং যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে গিয়ে দলটি বিরোধীদের দারুণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে।’ এ জন্য পত্রিকাটি জামায়াতের পাশাপাশি হেফাজতে ইসলামের উপস্থিতিকে প্রাধান্য দিয়েছে। পত্রিকাটি লিখেছে, ‘হেফাজতে ইসলাম দ্বিতীয়বার ঢাকায় সমাবেশ করার সময় তাদের অন্তত ৫০ জন নিরাপত্তাকর্মীদের হাতে নিহত হন। হেফাজতের তরুণ সদস্যরা গ্রামে ফিরে গিয়ে প্রচার চালান, ঢাকায় তাঁদের হাজার হাজার কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। সারা দেশে সরকারের জনপ্রিয়তার ওপর এর ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়ে। এর সুফল যায় বিএনপির ঘরে। গত জুন ও জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে সুরক্ষিত নির্বাচনী এলাকা গাজীপুরেও আওয়ামী লীগ হেরে যায়।’
সরকারের নির্বাচনী কৌশলের একধরনের আভাসও দিয়েছে পত্রিকাটি। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে সরকার পোশাককর্মীদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। গত মে মাসে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় ১১০০ লোক নিহত হওয়ার পর নিহত লোকজনের পরিবারগুলোকে সহায়তা ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় সরকারের ওপর এই খাতের শ্রমিকেরা ক্ষেপে আছে। বেতন বাড়ানোয় অনেক ভোটারের মধ্যে প্রণোদনা আসবে, যদিও কারখানার মালিকেরা সরকারের এই উদ্যোগের বিরোধিতা করবে বলেও মনে হচ্ছে।’
এ ছাড়া রাজনৈতিক ময়দানে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদকে উপস্থিত করানোকেও অন্যতম কৌশল বলে বর্ণনা করেছে ‘দ্য ইকোনমিস্ট’। পত্রিকাটি বলছে, জুলাইয়ে তিন সপ্তাহের জন্য সজীব ওয়াজেদকে ‘প্রদর্শন’ করে আওয়ামী লীগ। এর পরই তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত যান। ‘এ সময়ে মনে হয়েছে, রাজনীতিতে তিনি যেন একজন নবাগত নন।’
বাংলাদেশের উত্তরাধিকারভিত্তিক রাজনীতিতে সজীবের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তারেক রহমানকে উল্লেখ করেছে পত্রিকাটি। যদিও তারেক এখন দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের জন্য বিচারাধীন, তবুও সজীবকে মোকাবিলায় তিনি যে যেকোনো সময় লন্ডন থেকে বাংলাদেশে উড়ে আসতে পারেন, সে সম্ভাবনার কথাও বলেছে পত্রিকাটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকার যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে একমত না হয় এবং এর পরও তারেক যদি বাংলাদেশে ফিরে আসেন, তবে হয়তো তাঁকে সরাসরি কারাগারে যেতে হবে। তবে আওয়ামী লীগের ওই সিদ্ধান্ত যে ‘সাংবিধানিক সংকট’ তৈরি করতে পারে, তা-ও বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
‘দ্য ইকোনমিস্ট’ বলছে, সামনের নির্বাচনে ‘আওয়ামী লীগ মরিয়া হয়ে লড়বে। তবে দলটি যদি নির্বাচনে হেরে যায়, তবে বিএনপি তার “খ্যাতি হারানো” উত্তরাধিকার ও মিত্র জামায়াতকে পুনর্বাসিত করবে।’ এ ছাড়া বিএনপি যে বাংলাদেশের ‘অপরিবর্তনীয় ঐতিহ্য’কে যথাযথভাবে লালন করবে, তা-ও উল্লেখ করেছে পত্রিকাটি।
সূত্র: প্রথম আলো, ০৯ আগস্ট ২০১৩
রেটিং করুনঃ ,