শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হয়েছেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তাকে এবং তার মন্ত্রিসভাকে কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। প্রথমেই ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার করতে গিয়ে যে ভুলগুলো করেছিল সেগুলো মনে রাখতে হবে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক নেতারা সেইসময়ে ভুলগুলোকে স্বীকৃতি দিয়েছিলো। আর তাই অতীতকে মনে রেখে, অধ্যাপক ইউনূস এবং তার সরকারকে বাংলাদেশকে আরও প্রতিশ্রুতিশীল ভবিষ্যতের পথে নিয়ে যাবার সুযোগটিকে সম্পূর্ণরূপে কাজে লাগাতে হবে।
প্রথম এবং সর্বাগ্রে বেসামরিক অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি পরামর্শ হলো, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর উপর তাদের আধিপত্য জাহির করা। যদি এটি সম্ভব না হয়, তাহলে সামরিক বাহিনী আবার দেশ শাসন করার চেষ্টা করতে পারে। ২০০৭-০৮ সালে বাংলাদেশে বা বিদেশে কেউ আসলে বিশ্বাস করেনি যে, প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দিন আহমেদ বা তার সহকর্মীরা গুলি চালাতে পারেন। যদিও কিছু উপদেষ্টা সেই প্রশাসনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত সেনাপ্রধান এবং ইউনিফর্ম পরা অধস্তনদের একটি ছোট বৃত্ত (যারা প্রায়শই তাকে পরস্পরবিরোধী পরামর্শ প্রদান করে এসেছেন) সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর কোনো ভূমিকা নেই। বরং সামরিক বাহিনীকে অবশ্যই বেসামরিক সরকারের অধীনস্থ হয়ে কাজ করতে হবে।
২০০৭-০৮ সালে হাইব্রিড সরকারের অংশ হিসাবে, সংস্কারের মূল (দুর্নীতি বিরোধী অভিযান এবং রাজনৈতিক দলের সংস্কার সহ) দায়িত্ব সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের কয়েকজন ব্রিগেডিয়ারকে দেয়া হয়েছিল। এর ফলে কুখ্যাত ‘মাইনাস টু’ নীতি তৈরি হয়েছিল যা ব্যর্থ হওয়ায় যারা সংস্কারে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী ছিল তাদের দুর্বল করে দেয়া হয়। আত্মবিশ্বাসের সাথে কাজে যোগ দিলেও শেষপর্যন্ত ব্রিগেডিয়াররা অনেক ধূর্ত রাজনীতিবিদদের দ্বারা চালিত হয়েছিলেন ।
আন্তর্জাতিক বিষয়ে বিদেশি কর্মকর্তাদের সাথে তার নিজের নাগরিকদের সম্পৃক্ত করতে অনিচ্ছুক ছিলেন অন্তর্মুখী প্রধান উপদেষ্টা। যদিও ২০০৭-০৮ সরকারের হাতে পররাষ্ট্র বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন, তবুও খুব শীর্ষস্তরে কূটনৈতিক সম্পৃক্ততার অভাব (কখনও কখনও প্রোটোকল উদ্বেগের কারণে) তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বোঝার বা সহায়তা করার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করেছিল। বিপরীতে সেনাপ্রধান অনেক বেশি অ্যাক্সেসযোগ্য ছিলেন এবং এই ধারণাটি আরও শক্তিশালী করেছিলেন যে তিনি একজন ‘সাধারণ মানুষ’।
সবশেষে বলতে হয়, ২০০৭-০৮ সালের সরকার খুব দ্রুত অন্তর্বর্তীকালীন সময়সীমার সমাপ্তি নির্ধারণ করে গুরুতর ভুল করেছিল। একটি শর্ত-ভিত্তিক সময়সূচীর উপর ফোকাস করার পরিবর্তে সেই সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উৎসাহে তার মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ ঘোষণা করেছিল। একবার এটি ঘটলে দেশের রাজনৈতিক শ্রেণি জানতো কী করতে হবে। তারা বুঝতে পেরেছিল যে, লিভারেজ সরকার থেকে সংস্কারহীন রাজনৈতিক শ্রেণির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়েছে, যারা জানে যে পরিবর্তনের দাবি মানে শুধু মুখের কথা।
তবে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।শেখ হাসিনা যেমন তার শাসনের অবসান ঘটতে পারে এমন পূর্বাভাস পাননি, তেমনি সব সরকারকে অবশ্যই জরুরি অবস্থা মোকাবেলা করতে হবে। বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও জ্বালানির দাম বেড়ে গেলেও ২০০৭-০৮ সালের সরকার এটি শক্ত হাতে মোকাবেলা করতে পারেনি। পৃথিবীর বুকে আজ এমন কিছু ঘটছে যা ইঙ্গিত দেয় যে আগামী মাস এবং বছরগুলো সাম্প্রতিক অতীতের চেয়ে স্থিতিশীল হবার সম্ভাবনা কম।
-লেখক জন ড্যানিলোভিজ সাউথ এশিয়া পার্সপেক্টিভের সম্পাদক এবং দক্ষিণ এশিয়ায় বিস্তৃত অভিজ্ঞতাসহ স্টেট ডিপার্টমেন্টের সাবেক সিনিয়র ফরেন সার্ভিস অফিসার।
সূত্র:মানবজমিন।
তারিখ: আগষ্ট ১৪, ২০২৪
রেটিং করুনঃ ,