#আমার মার বাপের বাড়ি
রানী চন্দর লেখা আমি আগে কখনো পড়িনি । আমার সরল স্বীকারোক্তি শুনে হায় হায় করে ওঠে বান্ধবীদ্বয় । আমার নাকি জীবনের বারো আনাই বৃথা ! ভারি রেগেমেগে একলা ঘুরতে চলে যাই কলেজস্ট্রিট , কিনে ফেলি গোটা দুয়েক রানী চন্দর বই । তারই একটি হল ” আমার মা’র বাপের বাড়ি ( আজ্ঞে হ্যাঁ , শিরোনামে ভুল আছে , হাইলাইটের স্বার্থে ) ।
নাহ কোনো গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ নয় । মামাবাড়ির গ্রামে বালিকা লেখিকার কয়েকবছর থাকার বর্ণনা । সাদামাটা , সহজসরল , ঝরঝরে ভাষায় যেন মা ঠাকুমার গল্প বলার ওম লেখায় প্রতি পরতে জড়িয়ে । স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লেখিকাকে বলেছিলেন তার ছোটোবেলার গ্রামের স্মৃতি গুলি লিখে ফেলতে। বলেছিলেন ,
” গ্রামে ভালোর দিকটা যেমন আছে খারাপ দিকও আছে। খারাপ দিকটা বাদ দিয়ে যা সুন্দর—- সেইটুকুই শুধু ছবির মতো ফুটিয়ে তুলবি। গ্রামের জীবন তো আর পাবি না ফিরে। লেখ্— লিখে ফেল্ ।”
গুরুদেবের কথা অমান্য করেননি লেখিকা । শুরু থেকে শুরু করেছেন। বিক্রমপুরের গঙ্গাধরপুরে লেখিকার মামাবাড়ি । বাবার বাড়ি ঢাকা। স্বামীর মৃত্যুর পর পূর্ণশশীদেবী পাঁচ নাবালক পুত্রকন্যা নিয়ে কয়েকবছর থাকেন তার বাপের বাড়িতে । সেই সময়ের গ্রামীন যাপনের দিনলিপি এই বই ।প্রথম প্রথম বছরে দুইবার বেড়াতে যাওয়া হত লেখিকার মামাবাড়ি । মামারা এসে তিনমাল্লাই নৌকায় করে নিয়ে যেতেন তাদের বুড়িগঙ্গা , ধলেশ্বরী পেরিয়ে ইছামতীতে। লেখিকার মা আট ভাইয়ের একমাত্র বোন তাই আদর যত্ন খুব।
প্রথম পর্বে গ্রামের বাড়ির কাঠামোর বর্ণনা দিয়েছেন লেখিকা । চালের নীচে কার , মুলিথাম , তাক , শিকা , পৈঠা , মধুখাম , নিরিমিষ রান্নাঘর , পুব- পশ্চিম- উত্তর- দক্ষিণ বারোঘর এক উঠোনের বিবরণ , সঙ্গে প্রতিবেশী ও গ্রামের সব বাড়ির বর্ণনা , মানুষজনের বৈশিষ্ট্য ছুঁয়ে গেছেন । মানুষের সুখ , দুঃখ , শোক , মুদ্রাদোষ , স্বভাব , বাতিক , কাজের ধরন , আর্থিক অবস্হা , সন্তানাদি সমস্তই বিবৃত করেছেন সুচারুভাবে। একজায়গায় লিখেছেন ,
” এই কান্নার মধ্যেও আছে কত রকমের সুর। সুর শুনে বোঝা যায় কিসের কান্না ।
শশধর চৌধুরী বউকে ধরে মারে , সেই কান্নার সুর আর – এক রকমের। আর শোকের যে কান্না— তার সুর একেবারে আলাদা । ”
দ্বিতীয় পর্যায়ে তুলে ধরেছেন গ্রামের সংস্কৃতি , উৎসব , বারব্রত । প্রতি মুহুর্তে ছড়া কেটে বা পাঁচালী উদ্ধৃত করে বর্ণনা করেছেন আরাইলের বিল বা নদী পুকুরে সুবচনীর ব্রত , বালিকাদের লালুব্রত , তারাব্রত , মাঘমন্ডল ব্রত , পুণ্যিপুকুর ব্রত , নাটাইমঙ্গলচন্ডীর ব্রত। গ্রামের বিয়ে , পাটিপত্র , অধিবাস , জলভরা ,বউবরণ , রাম সীতাকে নিয়ে বিয়ের গান কত বর্ণনা । গ্রামের কীর্তন , হরিরলুঠ , দিদিমার ফুল ফল দেখে মরশুম বা সময়ের হিসাব রাখা , নিরুদ্দেশ বড়মামা , বড়মামীমার পাঠশালা কত কত নতুন দিক গ্রামীন জীবনের ।
জলের দেশ । গাবের আঠা দিয়ে নৌকা মাজার গল্প , চাড়ি বাওয়ার গল্প আর ওহ মাছধরার গল্প । বিলের জলে লম্বা দড়িতে সারি সারি বড়শিতে জ্যন্ত কই শিঙির টোপ দিয়ে জিলা পাতেন লেখিকার মামারা । জল নড়লে নৌকায় করে এসে মাছ তুলে নিয়ে যান । ঢাইনমাছ , সাদা বোয়াল , কালো বোয়াল। শীতকালে পলো দিয়ে ধরা কইমাছ । কচুরিপানার শিকড়ে কানকো আটকে শীতকালে ঝোলে কই মাছ , বুক লাল তেলে ভরা স্বাদের কই। জল জমলে শিঙি মাগুর বেলে , নদীর ধার থেকে কাছিম , কালি কাউঠঠা , উবা কাউঠঠা । পুকুর গাবিয়ে উঠলে বাতাসী , চেলা , মেনী , ট্যাংরা ,চাঁদা ।
পরের পর্যায়ে গ্রামের মেয়েদের দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি সবরকমের কাজের বিবরণ । আহা আলপনা দেওয়াও এক কাজ । বিয়ের আলপনায় সব জোড়ে , লক্ষ্মী পুজোর আলপনা হবে উঠোনে , পদ্মফুল , অষ্টদল , শতদল , সহস্রদল । তারপর পদ্ম ঘিরে লতা — শঙ্খলতা , চালতেলতা ,কলমীলতা , খুন্তিলতা , চিরুনিলতা , কলালতা , অনন্তনাগ । শেষ হয় যাত্রাকলস দিয়ে । বাচ্চারা দেয় লক্ষ্মীর পাড়া ( জোড়া পায়ের ছাপ ), ধানছড়া ।
সম্বৎসরের মুড়িভাজা , চিড়েকোটা , গুড় জ্বাল , ছাঁচের সন্দেশ , কাসুন্দি , আমসত্ত্ব বানানো — কাজ কিছু কম নয় বৌ ঝি দের । গুড়েরই কত রকমফের । ক্ষীরপাটালি , এলাচ কর্পূর দিয়ে পোশাকি গুড় , নারকেলি গুড় , মুছিগুড় । অবসরে পলতে কাটা , জোত বানানো , রঙিন সুতোর শিকা বানানো , কাঁথা বোনা , ছাঁচ কাটা , গুছি বানানো — কাজ বড় কম নয় গাঁ ঘরে ।
গ্রামের গাছপালা , শাকসবজি , ফলপাকুড় , ছেলেদের কাজ , মেলা মোচ্ছব সব ছুঁয়ে গেছেন লেখিকা সহজ সরল ভাবে , কলমে তার অসাধারণ গল্প বলার মায়া বুলিয়ে । আমরা যারা অতি সাধারণ , মধ্যমেধার , যারা কঠিন জীবনদর্শণ বুঝিনে তেমন করে , যারা ইন্দুবালা ভাতের হোটেল পড়ে মুগ্ধ হয়ে যাই , সেইসময় বা প্রথম আলোর সাথে তুলনা করতে যাইনে , যারা জগন্নাথদেব মন্ডল বা সায়ন্তন ঠাকুরের মায়ার লেখায় বুঁদ হয়ে থাকি তাদের বোধকরি এ বই ভালো লাগবে । জীবনের নেতিবাচকতা , অবসাদ , চাতুর্য , হিসেব , শোক পেরিয়ে যারা একটু মায়া খুঁজি , তাদের ভালো লাগতে পারে এই বই ।
©স্বাতী ব্যানার্জ্জী ।
” আমার মা’র বাপের বাড়ি ”
লেখিকা : রানী চন্দ ।
প্রকাশক : বিশ্বভারতী।
মুদ্রিত মূল্য : ₹ 120/-
সূত্র:সংগৃহিত।
তারিখ: মার্চ ১৬, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,