বিলেতে গণপরিবহনে, বিশেষ করে ট্রেনে যাতায়াতকারীদের একটা বড় অংশ ভ্রমণের সময়ে বই পড়ে। উপন্যাস, ভ্রমণসাহিত্য, কল্পবিজ্ঞান, জীবনী থেকে শুরু করে রান্নার বই বা সোশ্যাল মিডিয়াতে লাইক বাড়ানোর কায়দাকানুন–সংক্রান্ত বই—সব ধরনের বই তারা পড়ে। অনেক সময়ে লুকিয়ে বইয়ের নামটা দেখে নিই। গরমের দিনে পার্কে বা কফি শপে একই দৃশ্য। বই পড়ার এ চিত্র ইউরোপের সব দেশে প্রায় একই রকম।
করোনার কারণে গণপরিবহনে চড়া এবং বাইরে যাওয়া অনেকটাই সীমিত। লকডাউনে বিশ্বব্যাপী মানুষের বই পড়া বেড়ে গেছে প্রায় ৩৫ শতাংশ। সবচেয়ে চেয়ে বেশি বেড়েছে ভারতে, তারপর থাইল্যান্ড ও চীনে। বইয়ের তালিকার শীর্ষে রয়েছে উপন্যাস, বিশেষ করে প্রেমের উপন্যাস। নিয়েলসেন নামের এক সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, ৪১ শতাংশ ব্রিটিশ নাগরিক লকডাউনের আগে সপ্তাহে গড়ে সাড়ে তিন ঘণ্টা বই পড়তেন। এখন পড়েন ছয় ঘণ্টার মতো। জরিপে প্রকাশ, ডিজিটাল বইয়ের জনপ্রিয়তা বাড়লেও কাগজের বই বিক্রি করেই প্রকাশকদের মূল রোজগারটা আসে।
দেশে-বিদেশে বই পড়া এখন অনেক সহজ। অনলাইনে চাইলেই যেকোনো বই অর্ডার দেওয়া যায়। এক বা দুই দিনে বাড়িতে হাজির হয় বই। আর ডিজিটাল বই হলে তো চলে আসে নিমেষেই। আমাদের শৈশব বা কৈশোরে ভালো বইয়ের নাম জানার জন্য বন্ধু, শিক্ষক, আত্মীয়স্বজন আর লাইব্রেরিয়ান ছিল ভরসা।
আমাদের শহরে একটা লাইব্রেরি ছিল। বেশ পুরোনো। ছিল রাশিয়ান বইয়ের অনুবাদ, হুমায়ূন আহমেদ, জাফর ইকবাল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, বুদ্ধদেব গুহ—আরও কত কবি–সাহিত্যিকের বই। এ বইগুলোই আমাদের হঠাৎ করে কিশোর থেকে যুবককে পরিণত করেছিল। ওই লেখকদের লেখা দৃশ্যকল্পের মধ্য দিয়ে কত জায়গায় ঘুরেছি, কতজনের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, তার ঠিক নেই। নিউইয়র্ক থেকে প্যারিস বা ডুয়ার্সের জঙ্গল। সুনীল পরিচয় করালেন আমেরিকার কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের সঙ্গে, নিয়ে গেলেন রবীন্দ্রনাথের পড়ার ঘরে। জাফর ইকবাল নিলেন আমেরিকার বেল ল্যাবরেটরিতে—আবিষ্কারের নানা গল্প শোনাতে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবির দেশে কবিতার দেশে কিনতে গেলে দোকানি বলেছিলেন, ‘এ বয়সে কবিতার বই না পড়ে জীবনী পড়া উচিত।’ আমার আর বলা হয়নি, ‘এটা কবিতার বই না, ভ্রমণকাহিনি।’ আমাদের বেড়ে ওঠার সময়ে বই ছিল বিনোদনের একটা বড় মাধ্যম। অনুষ্ঠানে, উৎসবে পুরস্কার বা উপহার হিসেবে দেওয়া হতো বই। যদিও অধিকাংশই একাধিকবার পড়া শরৎ বা বঙ্কিমচন্দ্রের রচনাসমগ্র, যার একাধিক কপি প্রায় সবার আলমারিতেই থাকত। পাশ্চাত্যের দেশগুলোয় বইয়ের দোকানের সংখ্যা কমে গেলেও বইয়ের প্রতি তাদের ভালোবাসা বা মুগ্ধতা কমেনি। কাজের সুবাদে নামকরা বিজ্ঞানী থেকে বড় কোম্পানির কর্তাদের সংস্পর্শে আসতে হয় নিয়মিত। তাঁদের বেড়ে ওঠা, ভাষা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা কাজ করার ধরন ভিন্ন। কিন্তু একটা বিষয়ে তাঁদের সবারই দারুণ মিল। সবাই নিয়ম করে পড়েন। কেউ পড়েন শখের বশে, জানার তাগিদে, আবার কেউবা পড়েন শুধু আনন্দের জন্য।
এখন প্রতিদিনই প্রকাশ করা হয় বেস্টসেলার বইয়ের তালিকা। প্রেসিডেন্ট থেকে সফল উদ্যোক্তা বা গুণী ব্যক্তিরা কে কোন বই পড়ছেন, সেগুলোর সাম্প্রতিক তালিকাও প্রতিনিয়ত বের হচ্ছে। বারাক ওবামার কথাই ধরুন। বইয়ের পোকা। প্রেসিডেন্ট থাকাকালে প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে অন্তত এক ঘণ্টা বই পড়তেন তিনি। কী নেই সেই বইয়ের তালিকায়? ধ্রুপদি আমেরিকান সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন থেকে শুরু করে রম্য রচনা। ওবামার চিন্তাচেতনার একটা বড় অংশই প্রভাবিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে তাঁর পড়া বইগুলো থেকে। বলা হয়ে থাকে, লিংকনের পরে এখন পর্যন্ত ওবামাই সবচেয়ে পড়ুয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
ওয়ারেন বাফেট বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী বিনিয়োগকারী। শেয়ারে বিনিয়োগ করে ব্যবসার শুরুতে দিনে মাত্র ২০ ডলার লাভ করেছিলেন, গত বছরে লাভের পরিমাণ ছিল ৪৫ বিলিয়ন ডলার। দিনের পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা বই পড়েন তিনি। তাঁর সাফল্যের মূলমন্ত্র কী—এমন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনবিসির এক সাক্ষাৎকারে। পাশে থাকা আলমারিতে থরে থরে সাজানো বই দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘প্রতিদিন গড়ে ৫০০ পাতা পড়ি। প্রতিদিন-বছরের পর বছর। আমার জানার পরিধি এভাবে বাড়তে থাকে। সুদের চক্রবৃদ্ধির মতো।’ এত পড়ার কারণেই বাজার অর্থনীতির ভবিষ্যৎ গতি–প্রকৃতি তাঁর চেয়ে ভালো আর কেউ হয়তো অনুমান করতে পারেন না।
মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের বই পড়ার ব্যাপ্তি ও গতি—দুটোই অবিশ্বাস্য। গেটস বছরে গড়ে ৫০টি বই পড়েন। অর্থাৎ প্রতি সপ্তাহে প্রায় একটা নতুন বই। ঘণ্টায় গড়ে ১৫০ পাতা পড়তে পারেন তিনি। ডিজিটাল বইয়র চেয়ে কাগজের বই তাঁর প্রিয়। পড়ার সময় নোট নেওয়াও তাঁর স্বভাব। গেটস নিয়মিত তাঁর সাম্প্রতিক পড়া বইয়ের তালিকা প্রকাশ করেন। একালের অন্যতম সেরা প্রতিভাবান প্রযুক্তিবিদ ও বিনিয়োগকারী হলেন ইলন মাস্ক; শীর্ষ ধনীও বটে। রকেট থেকে গাড়ি—সবই তিনি বানান। মাস্ক এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, বইয়ের মাধ্যমে তিনি বড় হয়েছেন। ছাত্রাবস্থায় কোনো কোনো দিন একটানা ১০ ঘণ্টা কল্পবিজ্ঞান পড়েছেন। আইজ্যাক আসিমভের কল্পবিজ্ঞান তাঁর কল্পনাকে সমৃদ্ধ করেছে।
অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবসও অনেক পড়তেন। শিল্প-সাহিত্য থেকে শুরু করে প্রাচ্যের সভ্যতা, বৌদ্ধদর্শন, ডিজাইন বা টাইপোগ্রাফি—সবই ছিল তালিকায়। জবসের জীবনীতে জানা যায়, তাঁর এই বিস্তর পড়াশোনার প্রভাব পড়েছিল অ্যাপলের বিভিন্ন প্রোডাক্টের কল্পনা আর ডিজাইনে।
জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হলো কল্পনা। কল্পনা থেকেই তৈরি হয় নতুন পণ্যের ধারণা। বই পড়া ছাড়া কল্পনার ব্যাপ্তি বা গভীরতা—কোনোটাই বাড়ে না। বই মানুষকে করে তোলে মানবিক আর সহনশীল। জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির এই নতুন বিশ্বে টিকে থাকতে হলে ‘পড়ার বইয়ের’ বাইরে পড়ার অভ্যাসটা বাড়াতে হবে।
লেখক: ড. সুব্রত বোস প্রবাসী বাংলাদেশি এবং বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের ভাইস
প্রেসিডেন্ট
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: জুন ০২, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,