আপনার পকেটে অথবা ব্যাগে একটা বই থাকা মানে আপনার অধিকারে আরও একটা জগত আছে। আপনার মনে যখন বিষণ্ণতা এসে ভর করবে তখন এই জগতে আপনি ডুবে যেতে পারেন সুখের সন্ধানে। আমার কৈশোরের অসুখী দিন গুলিতে এমন একটা বইয়ের ভাবনাই আমাকে সুখী করে তুলত। মনে পড়ে স্কুলে আমি ক্লাসরুমে হাইয়ের পর হাই তুলতাম। কিন্তু ব্যাগে থাকা একটা বইয়ের চিন্তা আমাকে সান্ত্বনা দিত। পরবর্তীতে জীবনের এই পর্যায়ে এসে অনুরোধের ঢেঁকি গিলতে যেসব বোরিং মিটিঙয়ে অংশ নিতে বাধ্য হই সেখানেও ব্যাগে থাকা একটা বইয়ের চিন্তা আমাকে সুখি করে তোলে।
আমি আনন্দের জন্যে পড়ি। আমি বিদ্বান হবার জন্য বা জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হবার জন্য পড়ি না। কিন্তু কেন আমি আনন্দের জন্য পড়ি? একটা তালিকা করা যাকঃ
১। সেই অন্য জগতের টান যার কথা আগেই উল্লেখ করেছি। এটাকে পলায়নপরতা (এস্কেপিজম) হিসেবে দেখা যায়। যদিও জগতটা কাল্পনিক তবু দৈনন্দিন জীবনের দুঃখ, জরা, পঙ্কিলতা থেকে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও লুকিয়ে থাকা ভালো।
২। ষোল থেকে ছাব্বিশ বছর বয়স পর্যন্ত আমার পড়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল নিজের জন্য কিছু করা, নিজের চেতনাকে উন্নীত করা আর নিজের অন্তরাত্মাকে একটা নির্দিষ্ট আকার দেওয়া। আমি কেমন মানুষ হব ? এই জগতের অর্থ কি ? আমার চিন্তা কত দূর অগ্রসর হতে পারে ? এইসব প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজেছি ওই সময়। আমি ভেবেছি আমার আগ্রহ, আমার স্বপ্ন আর আমার মনের চোখে দেখা দেশের কথা। আমি যাপন করেছি বইয়ে থাকা অন্যের জীবন, অন্যের স্বপ্ন, অন্যের চিন্তা। আমি জানি বইয়ে পড়া এইসব লেখকের স্বপ্ন, চিন্তা, অনুভব আমি কখনও ভুলবনা। এগুলো থেকে যাবে আমার স্মৃতির গভীরতম দূরবর্তী কোন এক স্থানে। যেমন করে একটা শিশু তার প্রথম দেখা গাছ, পাতা, বিড়াল কখনও বিস্মৃত হয়না। ওই সময়টাতে বই পড়ে যে জ্ঞান অর্জন করেছিলাম সেটা নিয়েই আমি বড় হয়ে উঠলাম। ওই বছরগুলোতে বই পড়ার পিছনে নিজের মানসিক একটা গড়ন অর্জন করার যে বালসুলভ আশাবাদ কাজ করত সেটাই মনে হয় বই পড়াটাকে একটা খেলার মত করে তুলেছিল। কিন্তু এখন আর আমি ওইরকম ভাবে পড়িনা। মনে হয় এই কারণেই বই পড়ার সংখ্যা ওই সময়ের তুলনায় অনেক কমে গেছে।
৩। আরেকটা বিষয় আমার পাঠ অভ্যাসকে খুব বেশি আনন্দময় করে তোলে। সেটা হল আত্মসচেতনতা। আমরা যখন পড়ি তখন আমাদের মনের একটা অংশ টেক্সটের ভিতরে পুরোপুরি ডুবে যেতে প্রতিরোধ করে এবং আমাদেরকে অভিনন্দিত করে এরকম একটা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে ব্যাপৃত হবার জন্য। মার্সেল প্রুস্ত এই ব্যাপারটা ভালোভাবে বুঝেছিলেন। প্রুস্ত বলেছিলেন-“ বই পড়ার সময় আমাদের মনের একটা অংশ বাইরে থেকে যায়, যেটা নিবিষ্ট থাকে যে টেবিলে আমরা বসেছি সেটাতে, যে ল্যাম্প টা আলো দিচ্ছে সেটাতে, জানালার বাইরে বাগানে অথবা আরও দূরে কোথাও”। যখন আমরা এইরকম একটা ব্যাপার খেয়াল করি তখন আমারা একই সাথে উপভোগ করি আমাদের একাকিত্ব আর আমাদের কল্পনাশক্তিকে এবং যারা পড়েনা তাদের থেকে উচ্চতর স্থানে নিজেকে বসিয়ে নিজেকে অভিনন্দিত করি। আমি আমার নিজেকে দিয়েই বুঝি একজন বই পড়ুয়া কিভাবে নিজেকে অভিনন্দিত করতে চায়। তবে যারা নিজের পড়ুয়া সত্বাকে নিয়ে অহংকার করে আমি তাদের দুচোখে দেখতে পারিনা।
আমি যখন আমি আমার পড়ুয়া জীবন নিয়ে কথা বলি আমাকে বলতেই হবে যে- ১ আর ২ এ যে আনন্দের কথা আমি বলেছি সেটা যদি ফিল্ম, টেলিভিশন অথবা অন্য কোন মাধ্যমে আমি পেতাম তবে মনে হয় আমি খুব কম বইই পড়তাম। হয়ত এটা কোন একদিন সম্ভভ হবে। কিন্তু এটা খুব কঠিন। কারণ শব্দ হল জলের মত অথবা পিঁপড়ার মত। জীবনের ফাঁক ফোঁকর, গর্ত অথবা অদৃশ্য শূন্য স্থানে শব্দের মত আর কোনকিছুই এত দ্রুত এত সর্বগ্রাসী হয়ে ঢুকতে পারেনা। জীবনের এইসব ফাঁকফোকরই জীবন সম্পর্কে পৃথিবী সম্পর্কে আমাদের কৌতূহলী করে তোলে আর ভালো সাহিত্য এই সব ফাঁক ফোঁকর উন্মোচন করে। ভালো সাহিত্য মন্ত্রের মত কাজ করে, এটা ঠিক সাম্প্রতিক খবরের মতই দরকারি। আমি এর উপরে তাই এখনও আস্থাবান।
তবে আমি মনে করি দেখার যে আনন্দ সেটাকে পড়ার আনন্দের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাড় করানো উচিত হবেনা। এটা আমি বলছি কারণ সাত থেকে বাইশ বছর বয়স পর্যন্ত আমি চিত্রকর হতে চেয়েছিলাম এবং এই সময়টাতে মোহাচ্ছন্নের মত ছবি এঁকে গিয়েছিলাম।
আমার কাছে পড়া হল কারোর মনের একটা ফিল্মি ভার্সন তৈরি করা। আমরা হয়ত বই থেকে চোখ তুলে দেয়ালে ঝুলানো একটা ছবির দিকে তাকাতে পারি, দেখতে পারি জানালার বাইরের দৃশ্যাবলী কিংবা তাকাতে পারি আরও দূরে কোথাও, কিন্তু আমাদের মন এইসব গ্রহণ করেনা যতক্ষণ আমরা পড়ি, আমাদের মন তখনও চিত্রায়িত করতে থাকে বইয়ের কল্পনার জগতটাকে। লেখকের কল্পিত জগতকে দেখতে, অন্যভুবনের আনন্দ অনুভব করতে আমাদেরকে অবশ্যই কল্পনার লাগাম ছেড়ে দিতে হবে। বইয়ের কল্পিত জগতে শুধুমাত্র একজন দর্শক নয়, ওই জগতের অংশ করে নিতে বই আমাদেরকে তার স্রষ্টা লেখকের নিমগ্নতায় নিমজ্জিত করে। এই সেই নিমগ্নতা যা আমাদের বই পড়তে, চিরায়াত সাহিত্য পড়তে মুগ্ধকরের কাজ করে।
অরহান পামুকের আদার কালারস বইয়ের On Reading: Words Or Images থেকে অনুবাদকৃত।
সূত্র: সংগৃহিত।
তারিখ: জুন ০৬, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,