একটি স্মুতির কথা ভাবতে গিয়ে অন্য একটি স্মুতি আমাদের মাথায় প্রায়ই ভর করে। বেশ ছোট্ট বেলার কথা আমরা তিন বান্ধবি এক সাথে খেলা, স্কুলে যাওয়া গল্পে মেতে থাকতাম। আমার, পেখম ও মৃদুর বয়স তখন প্রায় বারো বছর আর আমরা তখন থাকতাম দিনাজপুরে। মৃদুকে আজ বেশ মনে পড়ছিল ঐ বারো বছর বয়সে ছিপ ছিপে লম্বা আর শ্যামলা বর্ণের, মুখোমন্ডল যেন একটা হাসির থালা, নানান স্মুতি আমার স্মুতি বাড়িতে ঘুরঘুর করতে লাগলো, মৃদুদের বাড়ি, হৈ হৈ, রৈ রৈ করে ওদের সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ানো, বাগানে ঘুরে বেড়ানো নানান রঙের ফুল তোলার স্মৃতি এইসব। পুরোনো দিনের মৃদুর নানান স্মৃতি নানান কথায় আমার স্মৃতি বাড়ি ভরপুর হয়ে উঠলো, বন্যার স্রোতের মত স্মৃতি বাড়ি ভরে উঠলো মৃদুর স্মুতিতে, কয়েকটা গোলাপ ফুলের কথা মনে হতেই মৃদুর স্মুতির স্রোত হঠাৎ থেমে পেখমের স্মুতি স্রোতে আমার স্মৃতি বাড়ি ভরপুর হতে থাকলো, মানুষের স্মুতি যে অনেকটাই নিয়ন্ত্রন হীন ভাবে মনে খেলা করে তা আজ বেশ স্পষ্ট হল।
বেশ অদ্ভুদ একটি বিষয় – আমার ছোট্ট বেলার দুই বান্ধবি আমার স্মৃতি বাড়িতে আজ বেশ আলোকিত হয়ে আছে তবে সঠিক জানা নেই যে মৃদু ও পেখম কোথায় থাকে ওরা !! প্রায় আড়াই বছর আগে জেনেছিলাম মৃদু থাকে ঢাকায় , পেখম থাকে দিল্লিতে আর আমি এখন থাকি কুষ্টিয়া সরকারী কলেজের পাশে।
পেখম ছিল বেশ শান্ত স্বভাবের, স্বাস্থ্য ভালো। আমরা প্রায় দেড় যুগ আগে যখন মৃদুদের বাসায়, বাগানে ঘুরে বেড়াতাম তখন বেশ যত্ব করে পেখম কিছু সদ্য ফোটা ফুল সংগ্রহ করে রাখত। সন্ধ্যার আগে ফুলগুলি সে বাসায় নিয়ে যেত।
একদিন স্কুলে আমরা যখন মাঠে বসা টিফিনের সময় তখন পেখম বলল – ‘ কাল শুক্রবার আম্মু তোমাদের দুইজন কে আমাদের বাসায় দাওয়াত করেছে মানে কাল আমরা তিন বান্ধবি এক সাথে গল্প করব, খাব, ছাদে ঘুরব।’ পেখমের কথাটা শেষ না হতেই আমি ও মৃদু ইয়াহু ইয়াহু বলে চিৎকার করতে থাকলাম।
বেশ মনে আছে দিনাজপুর শহরে কালিতলার পাশে আমাদের দাদা বাড়ির পাশেই মৃদুদেরও দাদা বাড়ি, বিরাট বাড়ি, বিরাট বাগান বাড়ি। আমার ও মৃদুর বয়স যখন প্রায় এগারো তখন পেখমরা আমাদের বাসার পাশে আসলো এক ভাড়া বাসায় পরে ক্লাস থ্রীতে তিন জনেই, খেলা, ঘুরে বেড়ানো সবই এক সাথে।
আমার বড় দুই ভাই, বোন হিসাবে আমি একা, আর মৃদুও একা বোন, আরও দুই ভাই, পেখম একাই ওর বাবা মার সাথে থাকে, শুনেছি ওর দাদা বাড়ি পাবনায়।
সেদিন শুক্রবার পেখমদের বাসায় পেখম দরজা খুলে দিতে আমাদেরকে জড়িয়ে ধরল, শান্ত মেয়েটা বেশ চন্চল হয়ে ওর আব্বু ও আম্মুর সাথে পরিচয় করে দিল। আন্টি বলল ‘যাও তোমরা সবাই পেখমের ঘরে গিয়ে গল্প কর, আমি রান্না করি, তারপরে আজ সবাই মিলে দুপুরে খাব।’
আমরা নানান গল্প আর পরিকল্পনা করতে থাকলাম, বললাম- চল সামনের শুক্রবার আমরা মৃদুতের বাড়িতে সত্যি সত্যি রান্না করে বনভোজন করি। সবাই রাজিও হলাম। পেখমের ঘরে বেশ কয়েটা পুতুল ছিল ওগুলি দিয়ে আমরা খেলা শুরু করলাম, আমি আর একটা পুতুল ধরতেই পখম ওটা ধরো না ওটা ধরো না বলেই বলল – ” ও পুতুল টা নিয়ে কেউ খেলে না ওটা আমার আপুর পুতুল। ”
আমরা কিছু না বলতেই পেখম বলল “চল – তোদেরকে আপুর ঘরে নিয়ে যাই”
পেখমের পিছে পিছে আমরা আর একটা বেড রুমে প্রবেশ করলাম, ঘরে লাইট জ্বলা, গোছানো বিছানা, পড়ার টেবিলে সাজানো বই, খাতা পত্র, টেবিলে টেবিল লাইট, কাঁচের দরজার ওয়ার ড্রপে ঝুলানো নানান রঙের ড্রেস, কতকগুলি ছোট্ট বেলার পারিবারিক ছবি, ছোট আকারের পাথরের তাজ-মহল। সবই আছে রুমটাতে। বিছানার ঠিক মাঝখানে একটি বড় কাঁচের বাটিতে টলটল পানিতে সদ্য ফোটা লাল রঙের ফুলের পাপড়ি।
আমাদেরকে ঐ ছোট্ট বয়সেও বুঝাতে হল না ফুলের পাপড়িগুলি কিভাবে পেখমের আপুকে জীবন্ত করে রেখেছে রুমের মধ্যে, সারা বাড়িতে, এই পৃথিবীতে। বুঝাতে হলো না কেন পেখম খুব যত্ন করে ফুল তুলে বাসায় নিয়ে যেত।
পেখমের চোখ থেকে টপ টপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছিল আর বলল ” আজ আপুর জন্মদিন, কিন্তু কেক কাটা হবে না, মগরবের নামাজ শেষে আম্মু ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠবেন। ”
কেমন করে যেন ঐ বারো বছর বয়সে বুঝতে পেরেছিলাম -মানুষের নিশ্বাসগুলি সব সময় একই রকমের হয় না।
তারিখ: ফেব্রুয়ারী ১৬, ২০১৩
রেটিং করুনঃ ,