পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলা রাজনীতিতে বিশেষ এগিয়ে বহুকাল। এখানে জন্ম হয়েছে অনেক জাঁদরেল রাজনীতিবিদের। বাংলা ভাগের পরও বাংলাদেশে এবং পশ্চিমবঙ্গে সেই ধারাবাহিকতায় কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি।
আব্বাস সিদ্দিকি সেই পরম্পরায় প্রায় নগণ্য এবং একেবারে নবীন একজন। ৩৫ বয়সী সিদ্দিকির রাজনীতিতে আসা সবেমাত্র। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ ছাড়িয়ে ভারত-বাংলাদেশ সর্বত্র নজর কেড়েছেন তিনি ইতিমধ্যে। হঠাৎই রাজনীতির কেন্দ্রে নিজেকে স্থাপন করে একগুচ্ছ বিতর্কও পয়দা করেছেন।
সবাই বুঝতে চাইছে তাঁর ‘শক্তি’র জায়গা। কিন্তু বিত্ত, পেশি আর প্রচারশক্তি দিয়ে এত দিন যাঁরা রাজনীতিকে বিচার করতেন, তাঁরা আব্বাসের শক্তির খোঁজ পাচ্ছেন সামান্যই। দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনীতির ছক বদলাচ্ছে। আব্বাস তার সর্বশেষ লক্ষণ
পীরজাদা নন, ‘ভাইজান’
রাজনীতিতে আসতে না আসতেই আব্বাসের নাম হয়েছে ‘ভাইজান’। দক্ষিণ পশ্চিমবঙ্গের কিছু এলাকায় এখন বেশ জনপ্রিয় একটা স্লোগান শোনা যায়, ‘শিরায় শিরায় রক্তÑভাইজানের ভক্ত’। দক্ষিণের একেবারে প্রান্তিক কৃষি সমাজের হাটে দেখা গেল এই স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে ঘুরছে তরুণেরা। কারও কারও টি-শার্টে লেখা, ‘ভাইজান আমার জান।’ এদের কাছে আব্বাস স্লোগানের মতোই সরল-সোজা ভালোবাসার মানুষ। আব্বাসকে তারা ‘ভাইজান’ই ডাকে, ‘পীরজাদা’ নয়। সুদূর কলকাতার মোহামেডান ক্লাব বা মুসলিম ইনস্টিটিউটের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে এই ভাইজান ওদের বেশি কাছের মানুষ। তাদের কাছে তিনি মুজাদ্দেদ। এটাই হয়তো বঙ্গের আদি ইসলাম।
পীরের ছেলে এবং নাতিরা ‘পীর’ হবে এটা বাংলার রেওয়াজ। আব্বাস সেই ঐতিহ্যে ধর্ম ও আভিজাত্যের মিশ্রণে দিব্যি দিন কাটাতে পারতেন। হুগলির ফুরফুরাতে তেমন বড়সড় ঐতিহ্যই রেখে গেছেন হজরত আবু বকর সিদ্দিকি। স্থানীয় মুসলমানদের কাছে যিনি ছিলেন ‘দাদা হুজুর’। আজমির শরিফের পাশাপাশি ভারতে মুসলমানদের বড় আধ্যাত্মিক সাধনার জায়গা এই ‘ফুরফুরা’। বাংলাদেশের অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ফুরফুরার অনুসারী আছে। আব্বাসের রাজনীতির দিকে মনোযোগ রাখছে তারাও।
যে কওমে আছে অমুসলমানরাও: আব্বাসের বহুজনবাদ
ফুরফুরার ‘দাদা হুজুর’ আবু বকর সিদ্দিকির পাঁচ পুত্রের কেউ এখন জীবিত নেই। নাতিরাই খানদানের তরফ থেকে ইসলামের সেবা করছে। বিশাল সেই বংশেরই একজন ‘পীরজাদা’ আব্বাস সিদ্দিকি। তাঁর রাজনৈতিক বিশেষত্বের অনেকখানি ইতিমধ্যে বাংলাভাষীদের জানা হয়ে গেছে। আব্বাসের বলার ভঙ্গি, শব্দচয়ন, বিষয়বস্তু এলিট রাজনীতিবিদদের মতো নয়। চারপাশের ‘হুজুর’দের চিরচেনা ওয়াজেও লিপ্ত হন না তিনি। বরং প্রতিদিনকার বাস্তব জীবনের বিষয় নিয়েই আলাপ জুড়েন। জগৎ-জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুরিদদের হেদায়েত তাঁর লক্ষ্য থাকে না। ‘ইহুদি-নাসারা’দের নিয়েও মত্ত হন না তিনি। নারী বা অপর ধর্ম নিয়ে তাঁর ওয়াজে দীর্ঘ বিবরণ অতি বিরল।
আব্বাসের বয়ান চলমান ভারত নিয়ে। সেখানে দরিদ্ররা কীভাবে রুটি-রুজির সংগ্রামে আত্মসম্মান নিয়ে নাগরিক অধিকারসহ বাঁচতে পারে সেই চিন্তার চর্চায় প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে তাঁর জলসা। তিনি মুরিদদের আফগানিস্তানে যেতে বলেন না। ভারতকে আফগানিস্তান বানানোও তাঁর প্রকল্প নয়। তিনি প্রজাতন্ত্রই চাইছেন, যেখানে মজলুমের সামাজিক ন্যায়বিচার থাকবে। ভারত তার কাছে দারুল আমান। ফুরফুরার দাদা হুজুর হজরত আবু বকর সিদ্দিকিও এটাই বলতেন।
যে কাফেলা পৌঁছতে চায় সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার দেশে
নির্বাচনী রাজনীতিতে ‘জনসভা’ মানেই একদল শহুরে ‘নেতা’ এসে উত্তেজক কিছু কথা আর অনিশ্চিত কিছু প্রতিশ্রুতি শুনিয়ে চলে যাওয়া। আব্বাসের স্টাইল এই রেওয়াজের বাইরে। উপস্থিত মানুষদের সঙ্গে দীর্ঘ সময়ের এক জলসায় বসেন তিনি। তাদের সঙ্গে সংলাপে লিপ্ত হন। প্রশ্ন করেন। উত্তর দেন। উত্তর শোনেন।
তাঁর মুরিদদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠই প্রায় তাঁর সমবয়সী। তাতে আছেন আদিবাসী ও নমশূদ্ররাও। আব্বাস সিদ্দিকির ‘কওম’ কেবল মুসলমানদের নিয়ে নয়। জলসায় তিনি সবার ‘ভাইজান’ হয়ে যান। বাঙালিত্ব ও মুসলমান পরিচয়ের মধ্যে তিনি ও তাঁর মুরিদেরা ব্যবধান দেখেন না। হুগলি ও চারপাশের এই মুসলমান সমাজে ইসলামের সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির সামান্যতম টানাপোড়েন নেই। তাঁদের কাফেলা কেবল পৌঁছাতে চায় সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার এক দেশে।
এই আব্বাসকে দেখেই হয়তো কারও কারও স্মরণে আসবে ফুরফুরার ‘দাদা’ আবু বকর সিদ্দিকির সহায়তায় প্রকাশিত নবনূর কাগজের কথা। বাঙালি মুসলমানের ভাষা হিসেবে বাংলার ন্যায্যতার পক্ষে লড়াইয়ে নেমেছিল একদা ওই কাগজ।
যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের পুনর্জন্ম?
আব্বাসের বেশভূষা একটা বিশেষ সম্প্রদায়কে ধারণ করে। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার অতি পুরোনো ছাঁচে আব্বাস সিদ্দিকির রাজনীতি বোঝা দুষ্কর। তিনি কেবল হিন্দুত্ববাদের বিপক্ষে নন। মুসলমান তোষণের লোকদেখানো রাজনীতিরও বিপক্ষে। তাঁর মতে, যেকোনো সম্প্রদায়কে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া হলে সমাজে ধর্মীয় বিভাজন বাড়ে। বিজেপির ‘হিন্দুত্ব’ যদি তেমনটি করে, অন্য দলের মুসলমান তোষণও তা করতে বাধ্য।
আব্বাস তাই চান মুসলমান, হিন্দু, আদিবাসী, দলিতরা নাগরিক হিসেবে যে যার পাওনা সমানভাবে পাক। পশ্চিমবঙ্গে বহু জনবান্ধব সরকার থাকার পরও ৩০ ভাগ মুসলমান নাগরিক সরকারি চাকরিতে মাত্র ৪-৫ ভাগ বরাদ্দ পেয়েছে এতকাল। দলিতরাও একই রকম পদ্ধতিগত বঞ্চনায় পড়ে আছে। আব্বাস মনে করছেন, এসব নিয়ে কথা বলা জরুরি। ওয়াজ কেবল শরিয়ত আর পরকালের আলাপে সীমিত থাকলে এই সামাজিক বঞ্চনা কমবে না। এভাবেই আব্বাস ‘ইসলামির রাজনীতি’র গৎবাঁধা ছকে নতুন তরঙ্গ তোলেন।
আব্বাসের আদর্শ, বক্তব্য ও কৌশল বাংলার আরেক প্রয়াত রাজনীতিবিদের কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনি বরিশালের যোগেন্দ্র নাথ মণ্ডল। আব্বাস তাঁর রাজনীতি এগিয়ে নিতে কংগ্রেস ও বামদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। যোগেন ভরসা করেছিলেন মুসলিম লিগকে। যোগেন মনে করতেন, নমশূদ্র চাষির জমির আল রয়েছে যে মুসলমান চাষির সঙ্গে তাঁর সঙ্গেই রাজনৈতিক মৈত্রী করতে হবে। এ রকম মৈত্রীই কেবল বাংলায় শান্তি ও ঐক্যের রক্ষাকবচ। আর আব্বাস মনে করেন, বাংলায় সমন্বয়ের রাজনীতি দরকার। কারণ, মুসলমান-হিন্দু-শিখ-দলিত হলো ‘উপমহাদেশ’ নামের একই বৃক্ষের শিকড়।
আব্বাসের এ রকম ভাবনা তৈরি হয়েছে পীর আবু বকর সিদ্দিকি থেকে। আবু বকরের এই ভাবনা আবার বৃহত্তর বাংলার সুফিদেরই মৌলিক দর্শন। এই ভাবুকতার ওপর দাঁড়িয়েই বাংলায় ইসলামের বিস্তার ঘটিয়েছিলেন সুফিরা। এ রকম পীরদের কাছে প্রায় সব ধর্মের মানুষ যে বিপদে-আপদে আসতেন, তার রেশ আজও একেবারে হারিয়ে যায়নি। যতটুকু তাঁদের ধর্ম প্রচারে ভূমিকা, প্রায় ততটুকুই ভূমিকা সমাজসেবায়, স্থানীয় সমাজের উন্নয়নে।
আবু বকর সিদ্দিকির জীবনের দিকে তাকালে স্পষ্টই দেখা যায়,Ñতাহফুজে দ্বীনের দিকে যতটা মনোযোগ ছিল, ততটাই ছিল সৃষ্টির সেবা বা ‘খিদমত-ই-খালক’-এর দিকেও। মধ্যযুগ থেকে বাংলার কৃষিসমাজ এ রকম সেবা পাচ্ছে আউলিয়াদের কাছ থেকে। এদের কারণেই রিচার্ড ইটনের মতো গবেষক লিখে গেছেন, ইসলাম তলোয়ারের ডগায় নয়, লাঙলের ফলায় বাংলা জয় করেছে। হুগলিতে ফুরফুরা শরিফও সেই তরিকারই জের। সেই পরিবারের আব্বাস সিদ্দিকি যে নতুন ধারার সমন্বয়বাদী রাজনৈতিক আলাপে লিপ্ত হবেন, সেটা তাই অভাবনীয় নয়। আব্বাসের হাত ধরে বাংলার আতরাফরা আবার একবার মঞ্চে উঠেছে বলা যায়। তাঁর পরিণতি যোগেন মণ্ডলের মতো হয় কি না সেটাই এখন দেখতে হবে।
মুসলমান ঘরানা থেকে সব জনজাতির জন্য রাজনীতি নির্মাণ
‘পীর’ বা ‘পীরজাদা’ হিসেবে রাজনীতিতে আসার দৃষ্টান্ত আব্বাসই দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম নন। তবে এ রকম পীর-কাম-রাজনীতিবিদদের সফলতা বেশি নয়। বাংলাদেশে জাকের পার্টি বা চরমোনাইর অনুসারীদের নির্বাচনী সফলতা সামান্যই। প্রশ্ন উঠেছে, আব্বাস সেই ঐতিহ্যে নতুন কী সংযোজন করতে চাইছেন। এর কিছু উত্তর ইতিমধ্যে দেওয়া হয়েছে।
আব্বাসের ‘রাজনীতি’ কেবল মুসলমানদের লক্ষ্য করে নয়, ন্যায়বিচারের যুদ্ধে পিছিয়ে থাকা সবার জন্য ইসলামকে দাঁড় করাতে চান তিনি। খান জাহান আলী থেকে ফুরফুরা পর্যন্ত আউলিয়াদের লোকজ রাজনীতির সেই ধারারই পুনর্জন্ম ঘটাতে আগ্রহী আব্বাসের ‘ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট’। এই দলের প্রধান করা হয়েছে একজন আদিবাসী শিমুল সরেনকে। একই কথা খাটে এখানকার বামপন্থীদের নিয়েও। আব্বাস সিদ্দিকির মতো কারও সঙ্গে একই মঞ্চে ওঠার জন্য সাহস সঞ্চয় করতে হয়তো আরও সময় দিতে হবে তাঁদের। নতুন ধারার এ রকম বহুজনবাদী রাজনৈতিক-সাংগঠনিক চিন্তার কারণেই পশ্চিমবঙ্গে আব্বাস সিদ্দিকি ও বামপন্থীরা আপাতত আলোচনায়।
ইসলামি ঘরানা থেকে সব ধর্ম ও বর্ণের মজলুমের জন্য রাজনীতি নির্মাণের একই কৌশল দেখি আমরা আসামের বদরুদ্দিন আজমলের ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের মধ্যে। এই উভয় নেতার নির্বাচনী প্রার্থী তালিকার বড় অংশ অমুসলিম অন্যান্য জনজাতির মানুষ। আসামে মাওলানা আজমলের ইউডিএফ গত ১৫ বছরের পথচলায় বেশ সফল। পশ্চিমবঙ্গে আব্বাসের ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট কতটা সফলতা পাবে, সেটা আর এক-দেড় মাস পরই বোঝা যাবে। কিন্তু যেসব মতাদর্শ ও কৌশল তিনি রাজনীতির ময়দানে এনেছেন, সেগুলোর রেশ সামনের দিনগুলোতেও প্রবলভাবে থাকবে। যেভাবে যোগেন মণ্ডল না থাকার পরও নমশূদ্রদের অ্যাজেন্ডাগুলো আজ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির অন্যতম ফ্যাক্টর।
আব্বাসের বহুজনবাদে ইসলামি রাজনীতির মুরব্বিরা অনেকেই যে একমত নন, সেটা না বললেও চলে। খোদ ফুরফুরা শরিফেও তাঁর প্রভাবশালী দুই চাচা তোহা সিদ্দিকি ও ইউসুফ সিদ্দিকিকে আব্বাসের পাশে দেখা যায়নি। ফলে আব্বাস ফুরফুরার শক্তিতে রাজনীতিতে নেমেছেন এবং সেই সূত্রেই যা কিছু সফলতা পাবেন, এমন বলা যায় না। বরং তাঁর রাজনীতির সফলতা-বিফলতার পরীক্ষা হবে বাংলার নিপীড়িত জাতিসত্তাসমূহের সঙ্গে মুসলমানদের ঐক্য গড়ার দীর্ঘ পথচলায়। পশ্চিমবঙ্গে সেই কাফেলার যাত্রা হলো কেবল। আব্বাস সফল হলে বাংলাদেশের আলেম, ওলামা, পীর ও পীরজাদারাও নিশ্চয়ই বেহেশত-দোজখের বয়ান শেষ করে হিম্মতের সঙ্গে সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্যও দু-চার কথা বলতে উৎসাহবোধ করবেন কোনো একদিন।
লেখক: আলতাফ পারভেজ গবেষক
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: মার্চ ২৪, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,