১৯৩৪ সালের ১৯ শে জানুয়ারী। রবীন্দ্রনাথ তখন জীবিত। একদিন ভোরবেলা এলাহাবাদ থেকে পন্ডিত জওহরলাল নেহরু ও স্ত্রী কমলা নেহরু নিয়ে এলেন তাঁদের সপ্তদশী কন্যাকে। নাম ইন্দিরা।জওহরলাল আদর করে ডাকেন ইন্দু।লাজুক,মিষ্টি চেহারা।
নেহরু দম্পতি জানেন রবীন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে আশ্রমের অতি সাধারণ জীবনযাপনের মধ্যে দিয়েই বিশ্বভারতীর নিজস্ব ঘরানায় তাঁদের একমাত্র কন্যা ইন্দুর প্রকৃত বিদ্যার্জন সম্ভব।ইন্দিরাকে দেখেই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নাম দিয়েছিলেন ‘প্রিয়দর্শিনী’।
শিল্পাচার্য নন্দলাল বসুর বয়স তখন মাত্র ৫২। নন্দলাল হচ্ছেন সেই সুদর্শনার ‘মাষ্টারমশায়’ ও ‘লোকাল গার্জেন’।জওহরলাল বিশেষভাবে চেয়েছিলেন, ইন্দিরা যেন আশ্রমের আর–পাঁচজন ছাত্রীর মতোই সাদামাঠা জীবনযাপন করে, তার জন্য যেন স্বতন্ত্র ব্যবস্থা না করা হয়।
তখনকার দিনের একমাত্র ছাত্রীনিবাস শ্রীসদনে প্রিয়দর্শীনির জায়গা হল। লাজুক, সহজসরল ইন্দিরাকে কাছে টেনে নিলেন সহপাঠিনীরা, যাঁদের মধ্যে ছিলেন অশোকা সিংহ, জয়া আপ্পাস্বামী, সোমা যোশি, সুশীলা বাদকারের মতো আরও অনেকে। প্রত্যক্ষভাবে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য লাভ, শিক্ষক ও বন্ধুবান্ধবীদের সাহচর্যে, বিশ্বপ্রকৃতির কোলে ইন্দিরা যেন জীবনের নবমন্ত্রে দীক্ষিত হলেন। তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করলেন গুরুদেবের তত্ত্বাবধানে শান্তিনিকেতনের আকাশ–বাতাসে প্রবাহিত সেকালের উন্মেষশালিনী প্রতিভার প্রাণস্পন্দনকে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও শিক্ষক হিসেবে ইন্দিরা পেয়েছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন, নন্দলাল বসু, প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের মতো জ্ঞানীগুণী মানুষদের। ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে চর্চা ছাড়াও তিনি গভীর অধ্যবসায়ের সঙ্গে শিল্পকলা, নৃত্য ও রবীন্দ্রসংগীতে তালিম নিতেন।
শান্তিনিকেতনে তখন দুবেলা ক্লাস হত। বিকেলে আম্রকুঞ্জের কারমাইকেল বেদিতে অবাঙালি ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ইন্দিরাও প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের কাছে বাংলা শিখতেন।
ভোর সাড়ে চারটের সময় শান্তিনিকেতনে ঘুম ভাঙত ইন্দুর। শ্রী-সদনে ফ্যান ঘুরত না মাথার ওপর। গরম সয়ে গিয়েছিল একটু একটু করে। ইন্দু মায়ের কাছে আনন্দভবনে থাকলে ব্রাউন ব্রেড, মাখন, টাটকা ফল খেত সকালে। শান্তিনিকেতনে খেতে হত ডাল আর পুরী। ভোর৬টার সময় সেই পুরী আর ডাল যে অসহ্য তা জওহরলালও খানিকটা মেনে নিয়েছেন। তবে আগের একটা চিঠিতে মেয়েকে বেশ বকুনিই দিয়েছিলেন বাবা।জওহরলাল মেয়েকে চিঠিতে বুঝিয়েছেন এমন ব্যবস্থা করলে কোনও সহপাঠীই ইন্দিরার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে না। শান্তিনিকেতনের অধ্যাপকেরাও অপমানিত বোধ করবেন। যে কোনও পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া চাই, মিশে যাওয়া চাই সেখানকার মানুষজনের সঙ্গে।
আশ্রমের বিভিন্ন কাজে নিজেকে সানন্দে যুক্ত করেছিলেন ইন্দিরা। প্রতি বুধবার মন্দিরের উপাসনায় যোগ দেওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে পাশের গ্রামগুলি ঘুরে দেখার পাশাপাশি দেশ–বিদেশ থেকে আগত বিদগ্ধ পণ্ডিত মানুষদের আলাপ–আলোচনা, সভা–সমিতিতে অল্পবয়সি ইন্দিরার উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। তখন ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের ঘর পরিষ্কার, কাপড় কাচা, খাওয়ার পর বাসন মাজা, সবই নিজেদের হাতে করতে হত। ইন্দিরা নেহরুও ব্যতিক্রম ছিলেন না। বাংলা–হিন্দি মিশিয়ে কথা বলতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। কোপাই নদীর তীরে কাশের বনে বনভোজন, পৌষ উৎসব, বসন্তোৎসব, সব কিছুতেই অংশ নিতেন বিপুল উৎসাহে। বসন্তোৎসবে আম্রকুঞ্জের মঞ্চে সমবেত নৃত্য ছাড়াও আশ্রম প্রাঙ্গণে প্রদক্ষিণরত নাচের মিছিলে ইন্দিরার সঙ্গী হতেন কলাভবনের ছাত্রীরা।
শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ইন্দিরার শিক্ষামূলক বাঁশবেড়িয়া ভ্রমণও বেশ স্মরণীয়। ১৯৩৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ইন্দিরা ও রামকিংকর বেইজ–সহ তিরিশ জনের একটি দল নিয়ে নন্দলাল বসু যান বাঁশবেড়িয়ার জমিদারের পোড়ো বাড়ির উঠোনে। তঁাবু ফেলে আস্তানা তৈরি হয় ঐতিহাসিক হংসেশ্বরী মন্দিরের সামনে। নন্দলাল বসু ও রামকিংকর বেইজ মন্দিরের কিছু টেরাকোটা কাজের ছাঁচ সংগ্রহ করেছিলেন। সেই কাজে ইন্দিরাও তঁাদের সাহায্য করেছিলেন। তিনিই সযত্নে সেগুলো শান্তিনিকেতন পর্যন্ত নিয়ে এসেছিলেন। রাত্রে ক্যাম্প ফায়ারের সামনে আড্ডা জমে উঠেছিল। ছাত্রছাত্রীরা হঠাৎ করেই পরস্পরের হাত দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। লাজুক ইন্দিরাও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন নিজের হাত।
আচমকা সব বাঁধন ছিঁড়ে গেল!! কমলা নেহরু গুরুতর অসুস্থ।অসহায় অবস্থায় জওহরলাল রবীন্দ্রনাথকে ১০ এপ্রিল ১৯৩৫ সালে এক পত্রে লিখলেন ‘…As I am incapacitated from accompanying her, it has become all the more necessary that Indira should go with her’। শেষে লিখলেন ‘…I had been fortunate enough to choose Santiniketan for her education at this stage of her life…’
ইন্দিরা তাঁর নিজ স্বভাবগুণে যে আশ্রমের সকলের মন জয় করেছিলেন। প্রত্যুত্তরে ২০ এপ্রিল রবীন্দ্রনাথ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে জওহরলালকে লিখলেন— ‘It is with a heavy heart we bade farewell to Indira for she was such an asset in our place’।
১৯৩৫ সালের মে মাসে কিশোরী ইন্দিরাকে শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে যেতে হয়। কিন্তু শান্তিনিকেতনের সঙ্গে অকৃত্রিম প্রণয়বন্ধন আজীবন থেকে যায়। কবির জীবদ্দশায় প্রিয়দর্শিনী আরো দুবার শান্তিনিকেতনে আসেন।১৯৩৭ সালে বাংলার নববর্ষের দিনে চীনা ভবনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে পিতার প্রতিনিধি হিসেবে ও ১৯৩৯ সালের ৩১ জানুয়ারি হিন্দি ভবনের উদ্বোধনে।প্রিয়দর্শিনীর কাছে কবিগুরু সারাজীবনে গুরুদেব হিসেবেই ছিলেন।তিনি তাঁকে সারাজীবন এ নামেই সম্বোধন করে গেছেন।
প্রিয়দর্শিনীর শেষবার শান্তিনিকেতনে আসা ১৭ ডিসেম্বর,১৯৮৩। দৃষ্টিনন্দিত কেশবিন্যাস, উজ্জ্বল গায়ের রং, ঝলমলে হাসি, স্পষ্ট উচ্চারণে, সুমধুর কণ্ঠে ওজস্বী বক্তৃতা। হাঁটাচলা আভিজাত্যে ভরপুর। সর্বোপরি তাঁর মোহময়ী রূপ, তাঁকে সকলের থেকে আলাদা করে দিয়েছিল।শান্তিনিকেতনে পা দিয়ে তঁার মমতামাখা গভীর দৃষ্টি ঘুরে বেড়াত আমলকীর ডালে, বাদামগাছের পাতায়, আম্রকুঞ্জের কোনায় কোনায়। সস্নেহে তাকাতেন ছাত্রছাত্রীদের দিকে। যেন ফিরে পেতেন নিজের অতীতে ফেলে আসা আশ্রমজীবনকে। সারাজীবন নানা সমস্যায় বিদ্ধ ইন্দিরা গান্ধীর কাছে শান্তিনিকেতন আশ্রমচত্বর যেন একটুকরো সুখী গৃহকোণ ছিল। আশ্রমবাসীদের চোখে তিনি ঘরের মেয়ে। ছাত্রছাত্রীদের ইন্দিরাদি।
আচার্য হিসেবে আম্রকুঞ্জে তাঁর শেষ সমাবর্তনের দীক্ষান্ত ভাষণে বেশ উদ্বেগের সঙ্গে বলেন— ‘In this peaceful atmosphere it is difficult to imagine how full of tensions and conflict, of bitterness and hatred, the world of today is!
তথ্যসূত্রঃ
১/ ইন্দিরা গান্ধী অটোবায়োগ্রাফি,পুপুল জয়কার (অনুবাদঃ লিয়াকত আলী খান),নালন্দা প্রকাশন,ঢাকা,২০০৮,(পৃষ্ঠাঃ ৯৩৯৪,১১৬-১১৮)।
২/ আনন্দবাজার পত্রিকা,১৯ নভেম্বর,২০১৭।
সূত্র: সংগৃহিত।
তারিখ: মার্চ ০৩, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,