প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের চাপের কারণেই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে বলে প্রশ্ন তুলেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এ নিয়ে তৈরি হওয়া ধোঁয়াশা দূর করার দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি। আজ বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি জানানো হয়।
গতকাল বুধবার দুদক কর্মচারী চাকরি বিধিমালা ২০০৮-এর ৫৪(২) বিধি অনুযায়ী দুদক চেয়ারম্যান মো. মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণ করেন। তিনি সর্বশেষ পটুয়াখালী দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন।
টিআইবির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে কর্মরত অবস্থায় দক্ষতা ও সাহসের সঙ্গে কক্সবাজারে ভূমি অধিগ্রহণে বিশাল অঙ্কের দুর্নীতি, রোহিঙ্গা নাগরিকদের এনআইডি ও পাসপোর্ট জালিয়াতি, কর্ণফুলী গ্যাসে অনিয়মসহ বেশ কিছু আলোচিত দুর্নীতিবিরোধী অভিযান ও মামলা পরিচালনায় মূল ভূমিকায় ছিলেন শরীফ উদ্দিন। এসব অভিযান ও মামলায় সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের মধ্যে যাঁদের বিরাগভাজন হচ্ছিলেন এই কর্মকর্তা, তাঁদের চাপের কারণেই কি তাঁকে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালী বদলি করা এবং সবশেষ চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, এমন প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠেছে।
টিআইবি বলছে, চাকরিচ্যুতি নিয়ে সংস্থার অভ্যন্তরে ও বাইরে বেশ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। এর প্রতিবাদে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে দুদকের কর্মীদের অংশগ্রহণে মানববন্ধনের মতো ঘটনাও ঘটেছে। তা যেমন অভূতপূর্ব, তেমনি উদ্বেগজনক।
টিআইবি মনে করে, চাকরিবিধি অনুযায়ী কোনো কর্মীকে অপসারণের এখতিয়ার দুদকের হাতে থাকতেই পারে, কিন্তু দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের মতো জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন দক্ষ ও সাহসী কর্মকর্তার সুরক্ষা নিশ্চিতের পরিবর্তে কেন এভাবে অপসারণের পথ বেছে নিতে হলো, তা দুদকের নিকট থেকে জানার অধিকার জনগণের রয়েছে।
জনমনে তৈরি হওয়া এসব প্রশ্নের সদুত্তর দিতে ব্যর্থ হলে দুর্নীতি দমনে কাজ করা সংস্থাটির বিশ্বাসযোগ্যতা গভীরতর সংকটের মুখে পড়বে বলে উল্লেখ করে টিআইবি সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে দুদকের অবস্থান পরিষ্কার করার আহ্বান জানিয়েছে। তা না হলে দুর্নীতি দমনে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করা সৎ ও সাহসী কর্মকর্তারা উদ্যম হারিয়ে ফেলবেন, যা দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থানকেই দুর্বল করে ফেলবে, যেটি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। দুদক এ বিষয়ে নিজেদের প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে সৃষ্ট ধোঁয়াশা দূর করবেন, এমনটাই প্রত্যাশা করে টিআইবি।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করার ১৬ দিন আগে চট্টগ্রাম নগরের খুলশী এলাকার বাসায় গিয়ে তাঁকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। এ ঘটনার অভিযোগে থানায় করা সাধারণ ডায়েরিতে (জিডি) তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমি কীভাবে চাকরি করি, তিনি দেখে নেবেন। আমি চট্টগ্রামে কর্মরত থাকাকালীন অনেকের জীবন নষ্ট করে দিয়েছি, দুদক দিয়ে আমার জীবন নষ্ট করে দেবেন।’
জিডিটি এখনো তদন্ত করছে নগরের খুলশী থানা–পুলিশ। জানতে চাইলে খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সন্তোষ কুমার চাকমা আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, দুদক কর্মকর্তা শরীফের বাসায় অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) থাকা পেট্রোবাংলার পরিচালক (পরিকল্পনা) আইয়ুব খান চৌধুরী গত ৩০ জানুয়ারি গিয়েছেন, তার সত্যতা পাওয়া গেছে। এর আগে অভিযুক্ত আইয়ুব খান চৌধুরী কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (কেজিডিসিএল) এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজেও তা রয়েছে। কিন্তু কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না, যার কারণে শরীফকে কী হুমকি দেওয়া হয়েছিল, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বিষয়টি আরও যাচাই–বাছাই করা হচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে ওসি সন্তোষ কুমার বলেন, অভিযুক্ত আইয়ুবের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, শরীফকে অনুরোধ করতে গিয়েছিলেন, যাতে কেজিডিসিএলের কর্মকতা–কর্মচারীদের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ হওয়ার আগে যেন মিডিয়ায় তথ্য না দেন। মিডিয়া ট্রায়ালে যাতে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হন।
গতকাল বুধবার দুদক পটুয়াখালী কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়। দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর সই করা এক চিঠিতে শরীফ উদ্দিনকে অপসারণ করা হয়। তবে কী কারণে শরীফ উদ্দিনকে অপসারণ করা হয়েছে, তা চিঠিতে উল্লেখ নেই। তাঁকে অপসারণের প্রতিবাদে আজ ঢাকায় মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন তাঁর সহকর্মীরা। চট্টগ্রাম দুদক কার্যালয়েও কর্মকর্তা–কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে।
জিডিতে যা রয়েছে
গত ৩০ জানুয়ারি তিন দিনের ছুটিতে চট্টগ্রাম নগরের খুলশীর ভুইয়া গলিতে নিজের ভাড়া বাসায় আসেন শরীফ উদ্দিন। যেখানে শরীফের দুই সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের বাস। ঘটনার বিবরণ দিয়ে দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন জিডিতে উল্লেখ করেন, ‘৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় বাসার নিচতলায় একজন অতিথির সঙ্গে আলাপকালে দারোয়ানের অনুমতি ছাড়াই হুট করে আইয়ুব খান চৌধুরীসহ এলজিইডির লোক পরিচয়ে আরেকজন ঢুকে পড়েন। এ সময় আইয়ুব খান জানতে চান, আমি কেন তাঁর বিরুদ্ধে নিউজ করিয়েছি, আমার কারণে তাঁর জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে, আমি কীভাবে চাকরি করি, তিনি দেখে নেবেন। আমি চট্টগ্রামে কর্মরত থাকাকালীন অনেকের জীবন নষ্ট করে দিয়েছি, দুদক দিয়ে আমার জীবন নষ্ট করে দেবেন।’
‘একপর্যায়ে তাঁরা ফোন করে বাইরে থেকে লোক নিয়ে আসেন। তখন আমাকে ও আমার পরিবারের সদস্যদের মেরে ফেলার হুমকিও দেন। আমি গেইটে তালা দিয়ে তাঁদের বের হয়ে যেতে বলি। পরে আইয়ুব খান চৌধুরীকে শান্ত হয়ে আমি জিজ্ঞাসা করি, কেন তিনি এই ধরনের অশোভন আচরণ করলেন? তখন আইয়ুব খান সরি বলেন। কিন্তু তাঁর গতিবিধি ও উদ্দেশ্যে সন্দেহজনক। আমার যেকোনো ক্ষতি করতে পারেন তাঁরা। তাই আইনগত সহায়তা পেতে থানায় জিডি করেছি।’
দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিনকে বাসায় গিয়ে প্রাণনাশ ও চাকরির হুমকির অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে আইয়ুব খানকে কয়েক দফায় ফোন করা হয়। ফোনের রিং বাজলেও রিসিভ করেননি কেউ। এ জন্য তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামে দায়িত্বপালনকালে হালনাগাদ ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের পরিচালকসহ ইসির চার কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করেন শরীফ উদ্দিন।
রোহিঙ্গা নাগরিকদের অবৈধ উপায়ে জন্মনিবন্ধন সনদ প্রদান ও ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তকরণের ঘটনায় ৩৯ নম্বর দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর সরফরাজ কাদের রাসেলসহ ৬ জন, ৩৪ নম্বর পাথরঘাটা ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ ইসমাইল বালিসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি।
একইভাবে অবৈধ গ্যাস–সংযোগ প্রদান করায় সাবেক প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলামের (বিএসসি) বড় ছেলে আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক উপকমিটির সদস্য মো. মুজিবুর রহমান, কেজিডিসিএলের ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. সারওয়ার হোসেন, সাবেক ব্যবস্থাপক মো. মজিবুর রহমান, সাবেক মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, সার্ভেয়ার মো. দিদারুল আলমের বিরুদ্ধেও মামলা করেন শরীফ উদ্দিন। এ মামলায় সারওয়ার, মজিবুর ও দিদারুলকে গ্রেপ্তার করে দুদক।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইওয়ে–সংলগ্ন কলাতলী বাইপাস রোড এলাকায় পিবিআই অফিস তৈরির জন্য এক একর জমি অধিগ্রহণে জালিয়াতি, রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে খালাসি পদে ৮৬৩ জনকে নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ১ কোটি ২ লাখ ৪৪ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের সাবেক মহাব্যবস্থাপকসহ চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেন শরীফ উদ্দিন। এর মধ্যেই শরীফ উদ্দিনকে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালীতে বদলি করা হয়।
দুদক কর্মকর্তা শরীফের জিডি
‘আমি কীভাবে চাকরি করি, তিনি দেখে নেবেন’
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ ফেব্রুয়ারী ১৭, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,