মা আমার মা,
তোমার জন্য সব সময়ে আমি তোমার জন্য মোনাজাত করি মা, কিন্তু মা, আমি আর কখনই লেখাপড়া করার জন্য অধর চন্দ্র বিদ্যালয়ে আর যাব না, সাত ক্লাস থেকে আমার লেখার পড়ার ইতি টেনে নিলাম। তোমার খুব ইচ্ছা ছিল আমি যেন অধর চন্দ্র বিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র হই। শরীরে বিশ্রাম না দিয়ে আমাকে মিথ্যা বলে আমার প্রাইভেটের টাকার জন্য তুমি তোমার পোশাক কারখানায় বেশি বেশি ওভার টাইমের ডিউটি করতে। বেতন পেয়ে সবার আগে আমার লেখাপড়ার টাকা আলাদ করে রাখতে তারপরে বাসা ভাড়া, খাবারের টাকা, সংসারের টাকা আলাদা করে ভাগ ভাগ করে রাখতে।
অধর চন্দ্র বিদ্যালয় তোমার শেষ ঠিকানার একটি বিশ্রাম ঘরের মত হয়েছিল আমি আর সেখানে যাব না, তবে তোমায় কথা দিলাম তুমি যে আমাকে টাংগাইলের রণদা প্রসাদ সাহার গল্প শুনাতে মায়ের চিকিৎসার জন্যে শূন্য হাতে শুধু পরিশ্রম করে যেন মানুষের মহা-মানুষ হয়েছিলেন, ভারতশ্বরী হোম, কুমোদিনী হাসপাতাল, নানান ট্রাষ্ট গড়ে তুলেছিলেন, আমিও সেই চেতনা মনে ধারণ করে মহা মানুষ না হলেও তুমি যেমন করে আমাকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলে তেমনটাই আমি হতে পারব, গাড়ীর ম্যাকানিক হয়ে, মুদির দোকান করে বা বই বিক্রি করে।,কিন্তু আমি আর কখনই লেখাপড়া করার জন্য অধর চন্দ্র বিদ্যালয়ে আর যাব না।
পাশের বাসার আন্টিরা কারখানা থেকে কত কাপড়ের টুকরা, সুতা, বোতাম, নানান রকমের ফিতা বাসায় নিয়ে আসত তুমি কোন দিন একটা সুতার টুকরাও বাসায় আনো নি। আমাকে বুক ফুলিয়ে অনেক গর্ব করে বলতে দেখ বাবু হাজার চষ্টা করেও আমাকে দিয়ে কেউ একটি পয়সা অবৈধ অর্থের উপার্জন করাতে পারবে না। আমাদের বাসার সব আয়ই বৈধ্য শ্রমের পয়সায়, শ্রমের ঘামের পয়সায়, আল্লাহ তালাকে আমাদের কম হিসাব দিতে হবে। মহা পুন্তকের মত এই কথাগুলি আমি ধারণ করে বাকি জীবন কাটিযে দিব মা।
বাবা আর ঘর থেকে বের হয় না, কারো সাথে কথা বলে না সারা ক্ষণ ঝিম ধরে থাকে, দোকানে বসে না, শুধু বলে কি হবে দোকান করে !! তোর মা কি আর আসবে !! খালা মনি আমাদের রান্না করে দেয়।
শুনেছি সরকার অথবা বি জি এম ই এ নাকি কারা আমাদেরকে কয়েক লক্ষ টাকা দিবে, তোমার জীবনের মূল্যের বিনিময়েই হোক আর দান খয়রাতই হোক টাকাটা আমাদের এখন খুব জরুরী, বাবা বলে ঐ টাকা পেলে এই পাথরের শহর ছেড়ে মানুষ মারা কলের এই শহর থেকে আমাদের গ্রামে চলে যাবে যেখানে কোন দালান নেই, সবুজ ঘাস আর ঘাস, মাঠের পরে মাঠ সেখানে কুঁড়ে ঘর তুলে বাকি জীবন কাটিয়ে দিবে।
তুমি আমাকে শুনাতে যারা মহা প্লাবনে, মহা দূর্যোগে বা আগুনে পুড়ে পৃথিবী থেকে চলে যায় আল্লাহ তাঁকে তাঁর বেহেস্তের বাগানে নিজে নিয়ে যায় আর কাল রাতে স্বপনে দেখিছি তুমি একটি ফুলের বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছ।
আমিও বাবার সাথে গ্রামে চলে যাব এখানে খুব ডর করে মা, রাতে ঘুম আসে না,কি সব আবোল-তাবোল দেখি। তোমার অফিসে হাজিরা বোনাসের টাকা দিয়ে তুমি আমাকে সবকুলের টিফিনের টাকা দিতে, মার্চ মাসে তুমি দুইদিন অফিসে যাও নি বলে তুমি হাজিরা বোনাসের টাকা পাও নি, সে জন্য কত্ত যে কান্না করেছ আমাকে টিফিনের টাকা দিতে পারবে না বলে। মাগো আর তো আমাদের ঘরে ঈদের বোনাসের টাকাও আসবে না, আমাদের আর সারা মার্কেট ঘুরে ঘুরে ঈদের জামা কাপড় কেনা হবে না, দাদীর জন্য ঈদের শাড়ি কেনা হবে না। আকাশ থেকে আমাদের সুখের ঘরটা পড়ে গেল, ভেংগে খান খান হয়ে গেল সব চৌচির, কাঠ কাটা করাত দিয়ে আমার কলিজাটা দুই ভাগে ভাগ করে ওরা তোমাকে নিয়ে গেল।
এইটুকু বয়সে বুঝে গেলাম, কোন কিছু থেমে থাকে না, সবই চলে আগের মত কিন্তু তুমি আর আসবে না মা, আমারও আর যাওয়া হবে না অধর চন্দ্র বিদ্যালয়ে। অন্যকে মা হারানোর দুঃখ বুঝাতে চাইলে তাকে আমার মত মা হারা হতে হবে, বড় হয়েও তখন সে বুঝবে আশ্রয় কাকে বলে, মানুষহীন পৃথিবী কাকে বলে !! আমি এখন মানুষহীন পৃথিবীর বাসিন্দা।
তোমার জন্য সব সময়ে আমি তোমার জন্য মোনাজাত করি আল্লাহের কাছে মা, তুমি বেহেস্তবাশী হও।
প্রথম আলো ব্লগ প্রিয় চিঠি আয়োজন ২০১৩
রেটিং করুনঃ ,