আমাদের স্কুল জীবনের ছোট্ট বেলার বন্ধু, জালাল। ইতিহাস বিখ্যাত সম্রাট আকবরের নাম পড়েছি স্কুল জীবনের শুরুতেই, আর জালালকে স্কুলে দেখলেই সবাই মিলে চিৎকার করে উঠতাম, এক সাথে বলতাম ” জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর” সে খুব খুশি হত, কিছুতেই বিরক্ত হত না।
মনে আছে স্কুলে টিফিনের সময় আমাদের সবাইকে নিয়ে সে আমাদের নানান রকমের গল্প শুনাত। আমরা মন দিয়ে শুনতাম। অবাক হয়ে শুনতাম। অবাক হয়ে যেতাম, এতো গল্প সে কোথায় পায়!! কোথায় পেত এত গল্পের বই !!
আমরা জানতে চাইলে আমাদের শুধু বলত “মন দিয়ে শোন”। নিজে নিজে বলত, ” বড় ভাইদের কাছে গল্পের বই পাই। ”
বড় হ্ওয়ার পর জালালের কাছ থেকে গল্পের বই পড়ার একটা আগ্রহ চলে আসে, নানান ধরণের গল্পের বই কিনে বা ধার করে পড়া শুরু করলাম, গল্পের উপর একটা দক্ষতা চলে আসলো আর বুঝতে পারলাম যে, জালাল যে গল্পগুলি আমাদের শুনাত ওগুলি কোন বইয়ের বা লেখকের লেখা গল্প না, সবই ছিল জালালের বানানো গল্প।
আর তখনই বুঝেছি প্রতিটি মানুষের ভিন্ন ভিন্ন চাহিদা থাকে, সখ থাকে, কারো চাওয়া বা পাওয়ার সাথে মিল থাকে না। চাওয়া বা পাওয়া গুলি ভিন্ন। সবার চাওয়া- পাওয়া কখনই এক নয়। তবে জালালের বানানো গল্প আর তা মিথ্যা বলে আমাদের শুনানো, নিজে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা সেজে গল্প শুনানোর জন্য সবাইকে একখানে জড়ো করানোটা আমার কাছে প্রচন্ড রকমের বিরক্ত লেগেছে, মনে হয়েছে ওটা জালালের একটি অন্যায় আচরণ ছিল।
ধীরে ধীরে লেখা পড়া শিখেছি, লেখা পড়ার পাশাপাশি গল্পের বই পড়েছি, কিছু গল্পও লিখেছি, মাথায় এখনো অনেক গল্পের প্লট ঘুরাঘুরি করছে, নিয়মিত গল্প লিখেও যাচ্ছি, প্রিয় পাঠকদের কাছ থেকে উৎসাহও পাচ্ছি।
একদিন গ্রামে গেলাম, সেল ফোনে জালালের সাথে কথা বললাম, দেখা করতে চাইলে বেশ খুশি হয়ে রাজি হল। কিন্তু আমার মনে একটি প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছা, অনেক গুলি গল্পের প্লট মাথায় সাজানো আছে, গল্প শুনিয়ে জালালের প্রতি দীর্ঘ দিনের জমে থাকা প্রতিশোধের আগুন নিভাব। মনে মনে ভাবলাম আমার লেখা গল্প জালালকে শুনিয়ে এতো দিনের পুষিয়ে রাখা প্রতিশোধের জ্বালা মিঠাবো।
শহর থেকে একটু দূরে গ্রামেই থাকে জালাল, আমরা একটা ফাঁকা জায়গায় বাজার থেকে দুইটা চেয়ার নিয়ে পাশাপাশি বসলাম। কুশল বিনিময় করলাম। সাংসারিক কথা হলো। আমার মাথায় গল্পের প্লটগুলি ঘুরঘুর করছে। বাজারের পাশ দিয়ে একটা ট্রেন যাচ্ছিল, দেখা যাচ্ছিল স্পষ্ট।
শুরু করলাম গল্প বলা, দেখ জালাল ঐ যে ট্রেন যাচ্ছে, তোকে একটা ট্রেনের গল্প বলি, খুব বাস্তব জীবনের গল্প। তবে শোন, রেল লাইনের উপর দিয়ে ট্রেন চলে, কিন্তু ট্রেনের সব চাকাগুলি এক সাথে ঘোরে….. এই ভাবে শুরু করে শেষ করলাম রেল লাইন সমান্তরাল হলেও জীবন কিন্তু সমান্তরাল নয়। সুখ, দুঃখ, আনান্দ যাতনা এগুলি আমাদের খুব কাছাকাছি থাকলেও সবার কাছে সমান্তরাল হয়ে আসে না বা চলে না, জীবন অনেক জটিল।
জালালের পিঠ থাপরিয়ে বললাম বিখ্যাত গল্প না!! সে মাথা নাড়িয়ে শুধু বলল ” হ্যা”
তাহলে শোন আর একটা গল্প। জালাল একটু নড়ে হাই তুলল। মনে হল গল্পে ওর কোন আগ্রহ নেই। তবে জেনে নেওয়াটা ভালো, বললাম কিরে তোর গল্প শোনার আগ্রহ নেই!!
– নারে, গল্প শুনতে আর বলতে কোনটাই আর ভালো লাগে না।
আমি অবাক হলাম। অবাক হয়েই জানতে চাইলাম গল্প তোর ভালো না লাগলে, তবে কি তোর ভালো লাগে!!
বেশ দৃঢ় ভাবে বলল ” মাথার ক্যপ ”
– মাথার ক্যপ !!!
– হ্যা রে মাথার ক্যপ ।
– গল্প ছেড়ে ক্যপ !! আবাক করলি, রহস্যটা বলতো শুনি।
– আমি একটা মাথার ক্যপে কারখানা দিয়েছি, আমার বাড়িতেই।
কথাটা শেষ করে আমার হাত টেনে ওর বাড়ির দিকে আমাকে নিয়েই যাবে, জালালকে অনেক প্রফল্ল মনে হল, মনে হল স্কুলের সেই জালাল, আমাদের জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর।
ওর বাড়িতে যেতে যেতে ভাবলাম বয়সের পরিবর্তনের সাথে চিন্তার কত পরিবর্তন!!! বয়স ও চিন্তা একই সমান্তরাল রেখায় চলে না।
ছোট্ট বেলায় মনে হত খেলনা পাওয়ার মধ্য দিয়েই জীবনের সব চাওয়া পাওয়ার সমাপ্তি, একটু বড় হয়েই বই। আর একটু বড় হওয়ার পর মনে হল মোবাইল, নেট, ওয়েব সাইড এসব পাওয়ার মধ্য দিয়েই জীবনের সব চাওয়া পাওয়ার সমাপ্তি। এর মধ্যেই জীবন সাথী। অর্থ উপার্জন, ভালোবাসা, সংসার। তারপর সন্তান। এরপর অন্য কিছু।
একটি খারাপ লক্ষ্য, একটি খারাপ ইচ্ছা আমার মনে পুষে রেখেছিলাম। প্রতিশোধের আগুন, যা মিঠাতে চেয়েছিলাম জালালকে গল্প শুনিয়ে। ভুল একটা ধারনার সাথে বসবাস করে কাটিয়ে দিলাম বহু সময়, অথচ পরাজয় হল নিজের। জয়ী হল জালাল। ও জয়ী হয়েছে ও আমাকে ওর মাথার ক্যপের কারখানাটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাকে দেখিয়েছে। ও কী ভাবে ক্যপ তৈরি করে! কী ভাবে বিক্রী করে! কী ভাবে টাকা আয় করে সব আমাকে শুনাতে পেরেছে, বলতে পেরেছ।
আর আমি থেকেছি একটি ভুল ধারণার উপর ভর করে বহু কাল।
নিজের জানা মতে বা অজান্তে আমরা নানান ভুল ধারণা বা নানান প্রতিশোধের আগুন মনের মধ্যে ধারণ করে আমাদের স্বাভাবিক মনের গতি ও চিন্তার গতিকে ব্যহত বা প্রবাহিত করি ভিন্ন ভিন্ন খাতে।
আমাদের মন ও মনন চলুক তাঁর আপন ও উন্নত গতিতে। ফুটে উঠুক আমাদের মনের সুকুমার বৃত্তিগুলি স্বাভাবিক গতিতে, যে ভাবে বনে ও বাগানে ফুল ফোটে, যুগে যুগে। নদীতে পানির স্রোত, আকাশে মেঘের চলাচল কিম্বা চিলের উড়ে চলা। এই সব ভাবতে ভাবতে কিছু সময় জালালের সাথে থেকে হঠাৎ করেই জালালকে বললাম – আসিরে জালাল, আবার দেখা হবে রে, ভালো থাকিস।
তারিখ:
রেটিং করুনঃ ,