লেখক:রাহীদ এজাজ।
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইউরোপসহ বিশ্বের প্রধান শক্তিধর দেশগুলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় বেশি জোর দিচ্ছে। জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি ও স্পেন উন্নত প্রযুক্তির সমরাস্ত্র বিক্রিতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এই দেশগুলো বাংলাদেশের কাছে বেশ কিছু আধুনিক সমরাস্ত্র ও প্রশিক্ষণে ব্যবহৃত হয়, এমন সরঞ্জাম বিক্রির জন্য নানা পর্যায়ে আলোচনা করছে।
সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফ্রান্স সফরেও সমরাস্ত্র বিক্রির বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। পাঁচ দিনের সরকারি সফরের প্রথম দিনে গত মঙ্গলবার তিনি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকের পর দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সম্মতিপত্র সই হয়েছে। গতকাল বুধবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন জঙ্গি বিমান ও বাণিজ্যিক জেট বিমান নির্মাণকারী ফরাসি প্রতিষ্ঠান দাসোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এরিক ট্রাপিয়ার। তিনি এ সময় দাসো রাফাল বিক্রির বিষয়ে কথা বলেন।
ইউরোপের দেশগুলোর কাছ থেকে সমরাস্ত্র কেনার আলোচনায় জড়িত সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ কর্মসূচির মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। তাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) শক্তিশালী দেশগুলো উড়োজাহাজসহ প্রতিরক্ষাসামগ্রী বিক্রিতে যথেষ্ট আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
গত দুই বছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি সফরের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে কূটনীতিকেরা বলছেন, সমরাস্ত্র ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে ইউরোপের আগ্রহ বাড়ছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইতালির প্রধানমন্ত্রী গুইসেপ্পে কন্তের আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি সফরে রোমে যান। এ সময় বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে ইতালি যথেষ্ট আগ্রহী ছিল। বাংলাদেশের কাছে চার দেশে যৌথ উদ্যোগে নির্মিত জঙ্গি বিমান ইউরোফাইটার বিক্রি করতে চায় ইতালি। এর পাশাপাশি নিজেদের তৈরি লিওনার্দো জঙ্গি বিমানও ইতালি বিক্রি করতে চায়। যদিও সে সময় দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা চুক্তিটি সই হয়নি।
এরপর ওই বছরের মার্চে দুই দিনের সফরে ঢাকায় এসেছিলেন ফ্রান্সের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফ্লোরেন্স পার্লে। তিনি সেবার ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় দাসো রাফাল বিক্রির বিষয়টিতে জোর দিয়েছিলেন।
জানা গেছে, এই মুহূর্তে ফ্রান্স ও ইতালি ছাড়াও যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও স্পেন বাংলাদেশের কাছে জঙ্গি বিমান, হেলিকপ্টার, ছোট সাবমেরিন, বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, মাইন সুইপারসহ নানা ধরনের সমরাস্ত্র বিক্রিতে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত সমরাস্ত্র সংগ্রহের ক্ষেত্রে মূলত চীনের ওপর নির্ভরশীল। সমরাস্ত্র বিক্রিতে ইউরোপের আগ্রহের বিষয়ে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফ্রান্স সফরের আগে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ ফোর্সেস গোলের লক্ষ্য পূরণের জন্য সমরাস্ত্র সংগ্রহে বৈচিত্র্য আনতে চায়। আমাদের সেই সামর্থ্য যে তৈরি হয়েছে, ইউরোপের দেশগুলোও তা জানে। তাই তারা আমাদের কাছে সমরাস্ত্র বিক্রিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে।’ গত মাসে বার্লিনে জার্মান পররাষ্ট্রসচিবও তাঁর আলোচনায় বাংলাদেশের কাছে সমরাস্ত্র বিক্রির প্রসঙ্গটি তুলেছেন।
উল্লেখ্য, এ বছর ৩০ মে বিমানবাহিনী প্রধান ও ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূতের উপস্থিতিতে ২৪টি প্রশিক্ষণ উড়োজাহাজ বিক্রির চুক্তি সই হয়েছে। এসব উড়োজাহাজের নির্মাতা জার্মানির গ্রোব এয়ারক্রাফট এসই।
দাসো রাফাল ও ইউরোফাইটার টাইফুনের লড়াই
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে বিমানবাহিনীর জঙ্গি বহরে নতুনত্ব আনার চেষ্টা চলছে। এ বিষয়ে কয়েক বছর ধরে যুক্তরাজ্য, ফান্স, জার্মানি ও ইতালি বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, জঙ্গি বিমান বিক্রির জন্য ফ্রান্স তাদের দাসো রাফাল নিয়ে প্রতিযোগিতায় নেমেছে যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি ও স্পেনের ইউরোফাইটার টাইফুনের সঙ্গে। ২০১৯ সালের এপ্রিলে দুই দেশের কৌশলগত সংলাপে যুক্তরাজ্য প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতার অংশ হিসেবে সমরাস্ত্র বিক্রির বিষয়টি তুলে ধরে। যুক্তরাজ্য জানায়, বহুমাত্রিক জঙ্গি বিমান বিক্রির বিষয়ে তাদের বিশেষ আগ্রহ আছে।
তালিকায় নানা কিছু
কয়েক বছর ধরে ইউরোপের দেশগুলোর কাছ থেকে সমরাস্ত্র কেনার সঙ্গে জড়িত সরকারি কর্মকর্তারা এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, জঙ্গি বিমান, প্রশিক্ষণ উড়োজাহাজের পাশাপাশি অন্যান্য প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রির বিষয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। যেমন ইতালি ইউরোফাইটার টাইফুনের প্রস্তাবের পাশাপাশি বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, হেলিকপ্টার, মাইন সুইপার বিক্রিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। স্পেন বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বিক্রির বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছে। নেদারল্যান্ডসের পক্ষ থেকে জাহাজসহ নৌবাহিনীর জন্য বিভিন্ন সমরাস্ত্র বিক্রির ইচ্ছা প্রকাশ করা হয়েছে।
জানতে চাইলে নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ইউরোপের চার দেশ—ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি ও স্পেনের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক রয়েছে। এদের সবাই অর্থনৈতিক কূটনীতির সুফল পেতে চায়। ইউরোপের প্রধান দেশগুলোর সমরাস্ত্র উৎপাদনের সামর্থ্য আছে বলে সুযোগটা নিতে চাইছে। যদিও এত বিপুল অর্থে সমরাস্ত্র কেনাকাটার সামর্থ্য আমাদের কতটা আছে, সেটি একটি প্রশ্ন।
বাংলাদেশের সঙ্গে ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়ে এই নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ বলেন, ফ্রান্সের সঙ্গে এই প্রথমবারের মতো প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সম্মতপত্র সই হওয়ার মধ্য দিয়ে বড় একটি পদক্ষেপ নেওয়া হলো। এর মধ্য দিয়ে ফ্রান্স প্রতিরক্ষার কেনাকাটা ও সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়টি বড় পরিসরে দেখছে বলেই মনে হচ্ছে।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ নভেম্বর ১১, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,