লেখক: পার্থ শঙ্কর সাহা।
সম্প্রতি এশিয়ার শীর্ষ ১০০ বিজ্ঞানীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশের দুই বিজ্ঞানী—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক গাউসিয়া ওয়াহিদুন্নেসা চৌধুরী ও অণুজীববিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা। সিঙ্গাপুরভিত্তিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সাময়িকী এশিয়ান সায়েন্টিস্ট এ তালিকা তৈরি করেছে। গাউসিয়া ওয়াহিদুন্নেসা চৌধুরী প্লাস্টিকের দূষণ এবং প্রকৃতি ও মানুষের জীবনে এর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে একাধিক গবেষণা করেছেন। জলজ প্রতিবেশ এবং বিপন্ন প্রাণী সুরক্ষায় অবদানের জন্য তিনি ওডব্লিউএসডি-এলসিভিয়ার ফাউন্ডেশন অ্যাওয়ার্ড পান ২০২২ সালে। উপকূলীয় নারীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য কাজ করছেন। জুওলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের তিনি একজন সদস্য। পড়ুন তাঁর সাক্ষাৎকার।
নতুন করে আবার পড়ালেখার সুযোগ পেলে কোন বিষয়ে পড়তেন?
সব সময় মানুষ ও এই পৃথিবীর মঙ্গলের জন্য নিজেকে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছি। আমার মনে হয় শিক্ষকতা ও গবেষণা—এ দুই-ই আমার কাজ। আমাকে প্রাণিবিদ্যা পড়াতে হয়, আর এ জন্য তো নিয়মিত পড়তে হয়। নতুন নতুন জিনিস শিখতে হয়। তাই আবার নতুন করে পড়ালেখার সুযোগ পেলে প্রাণিবিদ্যাই বেছে নেব।
গবেষণা এমন একটা কাজ, যেখানে মনঃসংযোগ ধরে রাখাটা খুব জরুরি। কীভাবে মনঃসংযোগ ধরে রাখেন?
গবেষণা এমন একটা বিষয়, যেখানে প্রতিটি কাজ মনোযোগ দিয়ে করতে হয়। প্রতি ধাপে মনঃসংযোগ না দিলে ভুলের আশঙ্কা থাকে। কাজ ছোট হোক বা বড়, পুরো সময় যেন আমরা গবেষণার ভাবনাই ভাবি। কিছু সময়ের জন্য হলেও, নিজেকে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে হলেও, এই মনোযোগ ধরে রাখতে হয়। আজকের এই যান্ত্রিক সমাজে মনঃসংযোগ ধরে রাখা খুব কঠিন। তবে ইচ্ছাশক্তি থাকলে সম্ভব। কখন কোন কাজ করব, একটা পরিকল্পনা করে এগোলে মনঃসংযোগ থাকবে। শুধু গবেষণা নয়, সব কাজের ক্ষেত্রেই এ কথা খাটে।
বিজ্ঞানী হওয়ার যাত্রায় কোন সময়টা সবচেয়ে কঠিন ছিল?
আমার পুরো যাত্রাই নানা কিছু শেখার মধ্য দিয়ে গেছে। এ পথ যে খুব মসৃণ ছিল তা নয়; প্রতিটি ধাপেই শিখেছি ধাক্কা খেয়ে খেয়ে। যতই বাধা পাব, ততই শেখাটা প্রগাঢ় হবে। যত চ্যালেঞ্জ থাকে, শেখার কাজটা ভালো হয়, এটাই আমি বিশ্বাস করি। কোনো কোনো কাজ শুরুতে কঠিন লাগে বা মাঝপথেও কঠিন হয়ে পড়তে পারে। তখন কিন্তু হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। আমি ছেড়ে দিইনি।
গবেষক বা বিজ্ঞানী হওয়ার ক্ষেত্রে দেশের শিক্ষার্থী, বিশেষ করে মেয়েদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী?
প্রথম চ্যালেঞ্জটা আসে পরিবার থেকে। পরিবারের আস্থা অর্জন করতে হয় শুরুতেই। তারপর আসে কাজ আর পরিবারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা। নিজেকে ঠিক করতে হবে—আমার সামনে এসব চ্যালেঞ্জ আছে, এগুলো আমি এই এই পথে মোকাবিলা করব। বিজ্ঞানী হওয়ার ক্ষেত্রে মেয়েদের পরিবারের সব সদস্যের সহযোগিতা দরকার। আবার মেয়েদের মনোবল শক্ত থাকতে হবে। বাধাগুলো পার হব—এ প্রত্যয় থাকতে হবে।
‘জেন জি’র কোন গুণ বা দিক আপনার ভালো লাগে?
আমি তো শিক্ষার্থীদের নিজের সন্তানের মতোই দেখি। আমি মনে করি, শিশুরা তাদের মা–বাবার চেয়ে বেশি জানে। জেনারেশন জেডের (জেন জি) মুক্ত মানসিকতা আছে। তারা একই সময়ে একাধিক পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। তাদের যোগাযোগের দক্ষতা অনেক বেশি। তাদের যেটা ভালো লাগে না, তারা সেটা সরাসরি বলে। ব্যাপারটা ভালো লাগে। তবে সেই ভালো লাগার বোধ তখনই সৃষ্টি হয়, যখন তাদের প্রকাশভঙ্গিতে পরিমিতির বোধ থাকে, পরিশীলতা থাকে। তাদের নিবিড় যোগাযোগের কারণে কেউ যেন আঘাত না পায়, সেটা যেন তারা মনে রাখে—এটাই আমার প্রত্যাশা।
শিক্ষার্থী ও তরুণদের কোন তিনটি পরামর্শ দিতে চান?
আমি সব সময় শিক্ষার্থীদের বলি, অবশ্যই একটা স্বপ্ন থাকতে হবে। এর মধ্যে পরিবার, এই দেশ ও দেশের মানুষ—সবাই থাকবে। আর বড় স্বপ্ন দেখতে হবে। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, স্বপ্ন পূরণের জন্য কঠোর পরিশ্রম করার মনমানসিকতা থাকতে হবে। তৃতীয় পরামর্শ হলো, আশা ছেড়ে দেওয়া যাবে না। বাধা এলে হাল ছাড়া যাবে না। যে স্বপ্ন দেখেছি, তা পূরণ করব—এ প্রত্যয় থাকতে হবে।
কোন বিজ্ঞানীকে আপনার আদর্শ মনে হয়?
আদর্শ বিজ্ঞানীর কথা উঠলে আমার প্রথমেই যাঁর নামটি মনে পড়ে, তিনি জেন গুডল। তিনি ইথোলজিস্ট, প্রাণী সংরক্ষক এবং সর্বোপরি একজন মানবতাবাদী। আর যাঁদের সঙ্গে কাজ করেছি, তাঁদের মধ্যে আছেন আমার পিএইচডির সুপারভাইজার ডেভিড অলড্রিজ। মানুষের চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে নতুন কাজের ক্ষেত্র বের করতে হয়, সে বিষয়ে তিনি অসম্ভব দক্ষ। আছেন অধ্যাপক হিদার কোল্ডওয়ে। তরুণ বিজ্ঞানীদের তুলে ধরতে তাঁর ভূমিকা অনন্য। অসম্ভব ইতিবাচক মানসিকতার মানুষ। যেকোনো সমস্যা নিয়ে গেলেই দু–তিনটি সমাধানের সূত্র বলে দিতেন। আর বলতেন, দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। এখন আমি যখন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কাজ করি, তাদের নানা বিকল্পের সন্ধান দেওয়ার চেষ্টা করি।
ভবিষ্যতে কোন গবেষণার সঙ্গে যুক্ত হতে চান?
চলমান যে গবেষণাগুলো রয়েছে, সেগুলোকে নির্ভুলভাবে করার চেষ্টা করছি। আমি দেখতে চাই যে আমার গবেষণা মানুষের বেঁচে থাকার কাজে লাগছে, বাংলাদেশের প্রাণ ও প্রকৃতি ভালো থাকছে, বাংলাদেশের প্রাণীদের বাসস্থান ভালো থাকছে। এ ধরনের কাজেই যুক্ত থাকতে চাই। আমার স্বপ্ন আরও অনেকের স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। আমরা সকলে মিলে বাংলাদেশের প্রাণ ও প্রকৃতি রক্ষায় কাজ করছি।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:জুন ২৫, ২০২৩
রেটিং করুনঃ ,