লেখক: আবু হেনা মুহিব।
নির্ধারিত জায়গার মধ্যে ঘুরছে রোবট। যে মুহূর্তে যেখানে যতটুকু থামার কথা, ঠিক ততটুকু থামছে সে। অ্যাসাইনমেন্টের বাইরে এক ইঞ্চিও নয়। ফরমায়েশ মতো কাজ চলছে একেবারে কাঁটায় কাঁটায়। ঘুরে ঘুরে প্যাকেট সংগ্রহ চলছে নির্দিষ্ট লাইন থেকে। সবশেষ নির্দিষ্ট বাক্সের কাছে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে রোবট। সেখান থেকে সংখ্যা অনুযায়ী বাক্সবন্দি করা হচ্ছে। অর্থাৎ সরবরাহের জন্য এখন প্রস্তুত পোশাক। এভাবেই রোবট কাজ করে যাচ্ছে সারা দিনমান। আলস্য নেই, অদক্ষতা নেই। ক্লান্তি কী, জানে না তারা। আদমজী ইপিজেডে ইউএইচএম লিমিটেডের কারখানার এই চিত্র এখন প্রতিদিনের। গড়ে ১০ জন শ্রমিকের কাজ করছে একেকটি রোবট। দ্রুত কাজ শেষ করছে তারা। এতে ব্যয় সাশ্রয় হচ্ছে কারখানার। বাড়ছে উৎপাদনশীলতা। দিন শেষে বিশ্ববাজার প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় এগোচ্ছে প্রতিষ্ঠান।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বৈশ্বিক প্রবণতার সঙ্গে এভাবেই এগোনোর চেষ্টা চলছে দেশের বস্ত্র ও পোশাক খাতে। মানুষের পাশাপাশি রোবট দিয়ে উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি কারখানায়। যদিও এখন পর্যন্ত তা খুবই কম। দেশে বস্ত্র ও পোশাক খাতে রোবটসহ অটোমেশন প্রযুক্তির ব্যবহারে যে উৎপাদন হচ্ছে, সেটি মোট উৎপাদনের মাত্র ৭ শতাংশ। নতুন শিল্প স্থাপনে অটোমেশন প্রযুক্তির ব্যবহার বেশি হচ্ছে। বিজিএমইএর হিসাবে, ২০২৫ সালের দিকে এ হার ২৩ শতাংশের মতো দাঁড়াতে পারে।
পোশাক খাতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এ ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী হতে গত কয়েক বছর আগে অটোমেশন বাড়াতে শুরু করেন উদ্যোক্তারা। শ্রমসাশ্রয়ী মেশিনারিজের আমদানি বাড়িয়েছেন তাদের অনেকে। মূলত এভাবেই দেশে পোশাক খাতে আলোচিত চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আসলে কী: স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শিল্প উৎপাদন ব্যবস্থাকে স্বয়ংক্রিয় করার প্রক্রিয়াকেই মূলত চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মানুষের ব্যবহার যথাসম্ভব কম থাকে এ ব্যবস্থায়। চারটি মূল বিষয়ের সমন্বয়ে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব কাজ করে থাকে। এগুলো হচ্ছে- আন্তঃসংযোগ, তথ্যের স্বচ্ছতা, প্রযুক্তি সহায়তা ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। বিভিন্ন স্মার্ট মেশিন, সেন্সর ও মানুষের মধ্যে সমন্বিত যোগাযোগের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া চলে। ২০১১ সালে জার্মানির এই প্রযুক্তি প্রথম আলোচনায় আসে। পর্যায়ক্রমে তা বিশ্ব স্বীকৃতি পায়। দেশে দেশে ধারণাটি ছড়িয়ে পড়ে।
বিনিয়োগ প্রয়োজন হয় চার গুণ: বস্ত্র ও পোশাক খাতে সাধারণ বিনিয়োগের তুলনায় রোবট প্রযুক্তির ব্যবহার করতে চার গুণ বেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়। রোবট ব্যবহারের উপযোগী করেই নির্মাণ করতে হয় কারখানার অবকাঠামো। রোবটের কাজের জন্য আলাদা ট্র্যাক নির্মাণ করতে হয়। তারপর রোবট কেনেন কারখানা মালিকরা। সাধারণত, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং জাপান থেকেই রোবট বেশি আমদানি করা হয়। ভারত থেকেও কিছু রোবট আসে। পরীক্ষামূলকভাবে দেশেও রোবট তৈরির কাজ চলছে। বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি এবং এনভয় টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুস সালাম মুর্শেদী জানান, রোবট ব্যবহারে অন্তত চার গুণ বেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়। বস্ত্র খাতে প্রতিযোগিতার যে পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তাতে রোবট কিংবা আধুনিক স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির বিনিয়োগ ছাড়া টিকে থাকা মুশকিল হবে। ফাস্ট ফ্যাশন এবং সাশ্রয়ী উৎপাদন ব্যবস্থায় যেতে অটোমেশনের ব্যবহার বাড়াতেই হবে। তবে পোশাক খাতে রোবটের ব্যবহার এখনও হাতেগোনা।
বর্তমানে কতটি কারখানার উৎপাদনে রোবট ব্যবহার করা হচ্ছে জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম সমকালকে বলেন, স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির ব্যবহার অনেক। তবে এখনও রোবটের ব্যবহার খুব কম। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কারখানায় রোবটের ব্যবহার করা হচ্ছে। এর বাইরে ইপিজেডের কিছু কারখানায় উৎপাদনে রোবটের ব্যবহার রয়েছে বলে জানান তিনি। যোগাযোগ করা হলে মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ড. রুবানা হক সমকালকে বলেন, তাদের কারখানায় ঠিক রোবট নয়, অটোমেটেড জ্যাকোয়ার্ড মেশিন ব্যবহারে উৎপাদন চলছে।
চ্যালেঞ্জও কম নয়: আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে রপ্তানি আদেশ পাওয়ার সময় থেকে ক্রেতাদের হাতে উৎপাদিত পণ্য পৌঁছানো পর্যন্ত সময়কে লিড টাইম বলা হয়। উৎপাদনের নানা প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ লিড টাইম বাংলাদেশের পোশাক খাতের অন্যতম বড় দুর্বলতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উৎপাদনশীলতায়ও প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে। ১০ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি করতে বাংলাদেশের শ্রমিক লাগে ১৪০ থেকে ১৪২ জন। ভিয়েতনামে এ সংখ্যা অর্ধেকেরও কম। ৪৭ থেকে ৫০ জন। রোবট কিংবা অটোমেটেড মেশিনের ব্যবহারের সুফল হিসেবে দ্রুত উৎপাদন ব্যবস্থায় সময় কম লাগছে। এতে লিড টাইমের ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। ব্যয় সাশ্রয় হচ্ছে। উৎপাদনশীলতা বাড়ছে। ক্রেতাদের আস্থা বাড়ে এতে। তবে রোবট ব্যবহারের চ্যালেঞ্জও কম নয়। উৎপাদনে রোবট ব্যবহারের ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২০ জন শ্রমিকের কাজ করছে একটি রোবট। পোশাক খাতের সোয়েটার কারখানায় নিটিংয়ে একজন শ্রমিক একসঙ্গে চারটি অটোজ্যাকোয়ার্ড মেশিন পরিচালনা করছেন। একেকটি জ্যাকোয়ার্ড মেশিনের দাম পড়ছে দুই হাজার ডলারের মতো। এক সময় ৭০০ ডলার মূল্যের সাধারণ জুকি মেশিনে একই কাজ করতে হতো। বেশি বিনিয়োগ হলেও মজুরি সাশ্রয় হচ্ছে। একটি মেশিন কমপক্ষে চারজন শ্রমিকের মজুরি সাশ্রয় করছে। মানুষের পরিবর্তে যন্ত্রের এই ব্যবহার শ্রমিকদের জীবন-জীবিকা কি কিছুটা হুমকিতে ফেলল? সে রকম শঙ্কাই করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, অটোমেশন যে হারে ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে এশিয়ার কিছু দেশে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক এবং সংশ্লিষ্ট খাতে ৮০ শতাংশেরও বেশি কর্মসংস্থান হারিয়ে যেতে পারে।
তবে অনেক উদ্যোক্তা এবং শ্রমিক নেতা এই শঙ্কার সঙ্গে একমত নন। তারা মনে করেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব কিংবা সর্বাধুনিক অন্যান্য প্রযুক্তির ব্যবহার বস্ত্র খাতে যতটা সহজে করা যাচ্ছে, পোশাক খাতে সেটা সম্ভব হবে না। তাদের যুক্তি, তুলা থেকে একটি পোশাক চূড়ান্ত পণ্য হিসেবে রূপান্তর প্রক্রিয়ায় গড়ে ১৮টি পর্যায় পার হতে হয়। অনেক ছোট কাজ থাকে এ প্রক্রিয়ায়। রোবটের পক্ষে এটি খুব সহজ হবে না। আপাতত উৎপাদন প্রক্রিয়ায় একই ধরনের কাজ হয়- এমন ক্ষেত্রেই রোবট ব্যবহার করা সম্ভব। সময়ের সঙ্গে হয়তো সব কাজই রোবটে করা সম্ভব হতে পারে।
জানতে চাইলে নিট পোশাক উৎপাদক এবং রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সমকালকে বলেন, তৈরি পোশাক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কাজের অনেক ভিন্নতা থাকে। এসব কাজ মানুষ ছাড়া করা যায় না। রোবটের পক্ষে ভিন্ন ভিন্ন কাজ করা সম্ভব নয়। তার মতে, আধুনিক প্রযুক্তির কারণে শ্রমিকের সংখ্যা হয়তো কিছুটা কমবে। আবার একই সঙ্গে নতুন বিনিয়োগ এবং নতুন ক্ষেত্রও তৈরি হচ্ছে। ফলে শ্রমিকদের কাজ হারানোর কোনো ভয় নেই। তার পরামর্শ, প্রযুক্তির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন।
প্রায় একই মত শ্রমিক নেতাদের। জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি এ প্রসঙ্গে সমকালকে বলেন, দেশের পোশাক কারখানার মালিকদের একটি সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে শ্রমিক ঠকানো। নানা ফাঁকফোঁকরে শ্রমিক ঠকানোর মাধ্যমে মুনাফা করেন তারা। কিন্তু রোবটকে ঠকাবে কীভাবে। রোবট রক্ষণাবেক্ষণে অর্থ লাগে। এর চেয়েও বড় কথা, রোবটে বিনিয়োগ লাগে সাধারণ বিনিয়োগের তুলনায় কয়েকগুণ। এত বেশি অর্থ বিনিয়োগ করার মতো মানসিকতা অনেক কারখানা মালিকেরই নেই। ফলে নিকট ভবিষ্যতেও শ্রমিকদের কাজ হারানোর ভয় নেই।
সূত্রঃ সমকাল।
তারিখঃ অক্টোবর ৩০, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,