পৃথিবীজুড়ে গণতন্ত্র সংকটাপন্ন, এ কথা বারবার আলোচিত হচ্ছে। ফ্রিডম হাউসের ২০২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, ১৫ বছর ধরে গণতন্ত্রের পশ্চাৎযাত্রা অব্যাহত আছে, এই নেতিবাচক ধারা গত বছর সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়েছে। ২০২০ সালে ৭৩টি দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবনতি হয়েছে, উন্নতি ঘটেছে মাত্র ২৮টিতে। যেসব দেশে অবনতি ঘটেছে, সেগুলো পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের আবাসভূমি।
অবনতিশীল গণতন্ত্রের দেশগুলোর ক্ষমতাসীনেরা নিজেদের অগণতান্ত্রিক বলে মনে করেন না, বরং নিজেদের গণতন্ত্রের রক্ষাকারী বলেই দাবি করেন এবং বলে থাকেন, যেহেতু গণতন্ত্রের কোনো সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা নেই এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কোনো একক রূপ নেই, সেহেতু তাঁরা যাকে গণতন্ত্র বলে অভিহিত করছেন, সেটাই গণতন্ত্রের এক নতুন রূপ।
গণতন্ত্রের কোনো সর্বজনীন সংজ্ঞা নেই—এ কথার মানে এই নয় যে গণতন্ত্রের মূলনীতি বলে কিছু নেই। গণতন্ত্র কোনো ধরনের বিশেষ শাসনব্যবস্থাকে আদর্শ বলে বিবেচনা করে না—এ কথার অর্থ এই নয় যে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কিছু উপাদান অত্যাবশ্যকীয় নয়। গণতন্ত্র একাদিক্রমে একটি আদর্শ ও একটি শাসনব্যবস্থা। এর দুটি দিককে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই।
গণতন্ত্রের অপরিহার্য উপাদান ও মূলনীতিগুলোর অনুসন্ধানের সূচনা হয় প্রাচীন গ্রিসে অ্যারিস্টটলের সময়। তবে ষোড়শ শতাব্দী থেকে রাষ্ট্র ও নাগরিকের অধিকার নিয়ে আলোচনায় এই বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ব্যারন ডি মন্টেস্কু, টমাস হবস, জন লক, জেরেমি বেনথাম, জেমস মিল, জন স্টুয়ার্ট মিল, ডেভিড হিউম ও জাঁ জাক রুশোর অবদান এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের আলোচনাগুলোর শুরু হয়েছে স্বৈরবাদী (অ্যাবসলুটিস্ট) রাষ্ট্রের বিরোধী অবস্থান থেকে, ব্যক্তির স্বাধীনতার ওপর জোর দিয়ে।
হবসের (১৫৮৮-১৬৭৯) কিছুটা ঝোঁক ছিল স্বৈরবাদের দিকে, মূলত ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যের প্রশ্নকে কেন্দ্র করে। কিন্তু হবস জনগণের মধ্যে একটি সামাজিক চুক্তির ওপর জোর দিয়েছেন। কিছু অধিকার বিসর্জন দেওয়ার বিনিময়ে ‘সার্বভৌম ক্ষমতা’ জনগণকে সুরক্ষা দেবে, এমনটাই তিনি জোর দিয়ে বলেছেন। জন লক (১৬৩২-১৭০৪) সামাজিক চুক্তির প্রশ্নে শুধু যে হবসকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, তা-ই নয়; বরং ধারণাটিকে আরও দূরে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তাঁর যুক্তি ছিল, সামাজিক চুক্তিটি হতে হবে অবশ্যই রাষ্ট্র ও শাসিতের মধ্যে। লক খুব স্পষ্টভাবে রাজতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তাকে খারিজ করেননি। কিন্তু সম্মতির ভিত্তিতে সরকার প্রতিষ্ঠা করা এবং সরকার ও তার প্রতিনিধিরা ‘শাসিতের কল্যাণ’ বজায় রাখতে না পারলে সেই সম্মতি উঠিয়ে নেওয়া যাবে, এ ধারণার ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেছেন। এটি যেকোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ই সরকার ও শাসিতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধান পূর্বশর্ত হয়ে উঠেছে। আইনসভা ও নির্বাহী ক্ষমতাকে পৃথক করার প্রয়োজনীয়তার কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন।
মন্টেস্কু (১৬৮৯-১৭৫৫) তিন ধরনের সরকারের কথা বলেছেন: প্রজাতন্ত্রী সরকার, যা হয় গণতান্ত্রিক, নয় অভিজাততন্ত্রের রূপ গ্রহণ করতে পারে; রাজতন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্র। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, তিনি জনগণের সার্বভৌমত্বের কথা বলেছেন, জনগণই সার্বভৌম। গণতান্ত্রিক সরকার কাঠামোয় ভোটাধিকার ও ভোটদান পরিচালনার আইন অপরিহার্য হয়ে ওঠে এই মূলনীতিগত ধারণা থেকেই।
জাঁ জাক রুশো (১৭১২-১৭৭৮) তাঁর বহুল প্রচারিত সামাজিক চুক্তি (১৭৬২) বইয়ে জোর দিয়ে বলেছেন যে মানুষ সামাজিক চুক্তি গ্রহণ করবে। এতে কিছু অধিকার তাদের বিসর্জন দিতে হবে। কিন্তু তা কোনো রাজার কাছে নয়, বরং পুরো সমাজের কাছে, জনগণের কাছে। জনগণ তখন তাদের ‘সাধারণ ইচ্ছার’ প্রয়োগ ঘটাবে ‘জনকল্যাণের’ স্বার্থে আইন তৈরি করার জন্য। রুশোর মতে, সব রাজনৈতিক ক্ষমতাই থাকা উচিত জনগণের হাতে, যা জনগণের সাধারণ ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে। ‘জনগণই নিয়মনীতি তৈরি করবে, যা তারা নিজেরা মেনে চলবে আর তাই হচ্ছে সার্বভৌম ক্ষমতা।’
এই সাধারণ ইচ্ছা কার্যকর করবে সরকার, এ পর্যন্ত উল্লেখ করা প্রায় সব তাত্ত্বিকই এ কথা বলেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কীভাবে নিশ্চিত হব যে সরকার সীমা লঙ্ঘন করবে না। জেরেমি বেনথাম (১৭৪৮-১৮৩২) ও জেমস মিল (১৭৭৩-১৮৩৬) এ বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ করেছেন। তাঁদের মতে, শাসিতের কাছে শাসকের দায়বদ্ধতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বেনথাম লিখেছেন, গণতন্ত্রের অংশীদারেরা নিজেদের সুরক্ষার জন্য যে নির্বাহীদের নিযুক্ত করেন, তাঁদের হাতে তাঁরা যেন জুলুম বা লুণ্ঠনের শিকার না হন, সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করে গণতন্ত্র। সেটাই গণতন্ত্রের লক্ষ্য এবং তার প্রতিক্রিয়া। অর্থাৎ স্বৈরাচারী ক্ষমতার হাত থেকে গণতন্ত্রকে রক্ষা করার দরকার পড়ে। গণতন্ত্রকে রক্ষা করার দরকার পড়ে এমনকি তাঁদের হাত থেকেও, যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ‘সাধারণ ইচ্ছার’ বাস্তবায়ন করতে। ফলে বেনথাম ও মিল দুজনই জোর দিয়ে যা বলেছেন, তার সারসংক্ষেপ, বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডেভিড হেল্ডের ভাষায়, ‘ভোট, গোপন ব্যালট, সম্ভাব্য রাজনৈতিক নেতাদের (প্রতিনিধিরা) পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, নির্বাচন, ক্ষমতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পৃথক্করণ, বক্তৃতা ও জনসংশ্লিষ্টতাই পারে সাধারণত সমাজের স্বার্থ বজায় রাখতে।’
জন স্টুয়ার্ট মিল (১৮০৬-৭৩) দুটি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন—গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা। মিলের যুক্তি ছিল, আমাদের জীবনযাপনের জন্য স্বাধীনতা বা লিবার্টি অত্যাবশ্যক। স্বাধীনতা না থাকলে জনগণের কণ্ঠরোধ হবে এবং তারা নতুন চিন্তার অন্বেষণ, আবিষ্কার এবং জনগণ হিসেবে তাদের পরিপূর্ণ বিকাশের সামর্থ্য হারিয়ে ফেলবে। তাঁর কথা ছিল, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বসবাসরত সক্রিয় জনগোষ্ঠীর হাত ধরেই স্বাধীনতার সর্বোত্তম সুরক্ষা সম্ভব। মিল যে তিন ধরনের স্বাধীনতার কথা বলেছেন, তার মধ্যে প্রথমটি হলো চিন্তা ও আবেগের স্বাধীনতা, যার মানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। মিলের বক্তব্য হচ্ছে, শাসনক্ষমতার অতিগুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর মধ্যে অনিবার্য শর্ত হিসেবে একটি সাংবিধানিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা থাকা দরকার, যেখানে জনগণের সম্মতির বিষয়টি জনগণের প্রতিনিধিদের ওপর বহাল থাকে। অর্থাৎ ক্ষমতায় যাঁরা থাকবেন, তাঁদের ওপর নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা সংবিধানের মধ্যেই থাকা দরকার।
বিশিষ্ট রাজনৈতিক তাত্ত্বিকদের কাজের সংক্ষিপ্তসার থেকে দেখা যায়, গণতন্ত্রের চারটি মৌলিক আদর্শ রয়েছে—জনগণের সার্বভৌমত্ব, প্রতিনিধিত্ব, দায়বদ্ধতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা।
সার্বভৌমত্বের মানে জনগণই সরকার প্রতিষ্ঠা করবে এবং সরকার জনগণের ইচ্ছার অধীন হবে। এ ধারণা শুধু স্বৈরাচারী ক্ষমতা বা অভিজাততন্ত্রের শাসনই অস্বীকার করে, তা-ই নয়; বরং আইনের শাসনের দিকেই ইঙ্গিত করে। অর্থাৎ আইনের চোখে সবাই সমান, এটিই গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি। সার্বভৌমত্ব একটি অবিচ্ছেদ্য বিষয়। সুতরাং একে কোনো দৈব ক্ষমতা, উন্নয়ন, জাতীয় নিরাপত্তা অথবা রাজনৈতিক মতাদর্শের নামে জনগণের কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া যাবে না।
প্রতিনিধিত্ব হচ্ছে শাসকের প্রতি শাসিতের সম্মতি প্রদানের উপায়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে জীবন, স্বাধীনতা ও সুখশান্তির অন্বেষণকে অপরিহার্য অধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং ‘এই অধিকারগুলো নিশ্চিত করতে সরকার গঠন করা হয়েছে, যা তার ন্যায্য ক্ষমতা শাসিতের সম্মতি থেকে আহরণ করবে।’ শাসিতের সম্মতিই সরকারকে শাসন করার নৈতিক অধিকারের বৈধতা প্রদান করে। ইংরেজ কবি জন মিল্টনের ভাষায়, ‘রাজা ও আধিকারিকদের ক্ষমতা হচ্ছে তা-ই, যা শুধু জনগণের আস্থার ভিত্তিতে, জনগণের সাধারণ মঙ্গলের উদ্দেশ্যে তাদের হস্তান্তর ও প্রদান করা হয়েছে। আর এ ক্ষমতা মূলগতভাবে জনগণের কাছেই থাকে। জনগণের স্বাভাবিক জন্মগত অধিকার লঙ্ঘন না করে তাদের হাত থেকে এ ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া যায় না।’
দায়বদ্ধতা এমন একটি ধারণা, যা একদিকে নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের (checks and balances) ওপর ভিত্তি করে বিকাশ লাভ করে; অন্যদিকে সরকারের দৈনন্দিন কার্যাবলিতে নাগরিকদের ভূমিকা নিশ্চিত করে। দায়বদ্ধতাকে কেবল খাড়াখাড়ি (উল্লম্ব) পদ্ধতি হিসেবে বিবেচনা করা উচিত হবে না। একটি টেকসই ও কার্যকর গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা হচ্ছে উল্লম্ব, আনুভূমিক ও সামাজিক। উল্লম্ব বা খাড়াখাড়ি দায়বদ্ধতা হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। আবার সরকারের আনুভূমিক দায়বদ্ধতা তৈরি হয় আপেক্ষিকভাবে স্বাধীন কিছু ক্ষমতাশালী প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে, যেগুলো কাজ করে জালের মতো। এগুলো হচ্ছে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত কতগুলো সংস্থা, যেমন দুর্নীতিবিরোধী ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো। সামাজিক দায়বদ্ধতা হচ্ছে নাগরিকদের সংগঠনের কাছে জবাবদিহির ব্যবস্থা।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কেন্দ্রে আছে বাক্স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, সংঘ গঠন ও সমাবেশের স্বাধীনতা। মানবাধিকারের অন্যতম উপাদান এটি। যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি বেনজামিন কারডোজো ১৯৩৭ সালে এক মামলায় একে অধিকারগুলোর মধ্যে ‘অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত’ বলে বর্ণনা করেন। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী সাংবিধানিক অধিকারগুলোর ‘স্তরবিন্যাস’ আছে আর সেখানে বাক্স্বাধীনতা সব সময়ই সবার ওপরে থাকবে। তাঁর মতে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাই মূল, স্বাধীনতার অন্যান্য প্রায় সব রূপের অপরিহার্য পূর্বশর্ত।
লেখক: আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর; সম্প্রতি প্রথমা থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর গ্রন্থ নিখোঁজ গণতন্ত্র: কর্তৃত্ববাদের পথরেখা ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: এপ্রিল ০১, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,