লেখক:আন্তন বারবাশিন।
২০০৪ সালে ভ্লাদিমির পুতিন যখন তাঁর প্রথম মেয়াদ শেষ করেন, তখন তিনি বিশ্বের সঙ্গে বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের নতুন পথ তৈরির কথা বারবার বলেছিলেন। সে উদ্দেশ্য থেকেই ভালদাই ক্লাব প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। এর বার্ষিক সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট পুতিন অংশ নিতেন। বাকি বিশ্বের কাছে রাশিয়ার নেতাদের বক্তব্য তুলে ধরার প্রধান একটা ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল ভালদাই ক্লাব।
২০০০-এর প্রথম দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে দ্বিতীয় দশকের প্রথম অংশ পর্যন্ত ভালদাই ক্লাব আয়োজিত সম্মেলনে রাশিয়ার শীর্ষ নেতৃত্ব ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে নানা রকম প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে রাশিয়ার অনন্য অগ্রসরতা ও বাকি বিশ্বকে রাশিয়া কতটা মুক্ত চোখে দেখে, তার বর্ণনা তারা সেসব উত্তরে দিত।
এ বছরের ২৭ অক্টোবর ভালদাই ক্লাবের সম্মেলনে আমরা যে বক্তব্য শুনতে পেলাম, তা এক যুগ আগেকার বক্তব্য থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ সম্মেলন সামনে রেখে রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি কার্যালয়ের প্রেস সচিব দিমিত্রি পেসকভ অঙ্গীকার করেন, রাশিয়ার জনগণ পুতিনের ভালদাই ভাষণ ‘পড়বে ও বাববার করে পড়বে’। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এখন নিজেকে ইতিহাসের নির্মাতা হিসেবে ভাবেন, নিজেকে পরাজিত দেখতে রাজি নন। সে কারণে জনগণের কাছে তাঁর এ ধরনের প্রত্যাশা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
পুতিনের ভাষণের বেশির ভাগ অংশই ছিল পশ্চিমের বিরুদ্ধে অভিযোগে পূর্ণ। রাশিয়াবিষয়ক বিশ্লেষকদের অনেকে পুতিনের এই বক্তব্য খারিজ করে দিয়েছেন। কেননা তাঁর এই বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। কিন্তু এই খোলামেলা ও অশ্লীল বক্তব্যের মধ্য দিয়ে পুতিনের এখনকার বৈশ্বিক কৌশল সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। ভিন্ন ভিন্ন দর্শকদের উদ্দেশ করে পুতিন তাঁর ভাষণে ভিন্ন ভিন্ন বার্তা দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্যের মূল বিষয়টি হলো, সংকটটা শুধু ইউক্রেন বিষয়ে নয়, তার চেয়েও অনেক বড় কিছু।
বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি পুতিনের সরাসরি বার্তা হলো, এখন ‘একক বিশ্বের পরিসমাপ্তি’ ও ‘বহুকেন্দ্রিক বিশ্ব জন্মের’ মুহূর্ত। প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের সময়কালের বেশির ভাগ সময় ধরে পুতিন ধর্মপ্রচারকের মতো এই কথাটিই বলে আসছেন। রাশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইয়েভজেনি প্রিমাকভের লেখা থেকেই পুতিন বিষয়টি নিয়েছেন।
বিস্ময়ের কিছু নেই, ভালদাই সম্মেলনে পুতিন যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে এই বিষয়ই প্রাধান্য পেয়েছে। সংকট সৃষ্টি ও তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার পেছনে তিনি পশ্চিম ও যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছেন। পৃথিবী এখন যেভাবে শাসিত হচ্ছে, সে প্রেক্ষাপটে নতুন শক্তির উত্থান যে অত্যাবশ্যক, সে ব্যাপারেও তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
চীন ও ভারতের মতো বিশ্বশক্তির প্রতি পুতিনের সরাসরি বার্তা হলো, আমেরিকার আধিপত্যের পরিসমাপ্তির মধ্য দিয়ে পশ্চিমাদের ফেরি করা গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও সর্বজনীন মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলোর পরিসমাপ্তি হবে। সাধারণভাবে এগুলো ‘উদারনৈতিক বিশ্বব্যবস্থা’ নামে পরিচিত।
পুতিন বলতে চান, অপশ্চিমনিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিকব্যবস্থারও জন্ম হতে চলেছে। ধারণাটি রাশিয়া গত এক দশক ধরেই বলে আসছে। ডলারের বদলে রুবলকে বিনিময়ের মুদ্রা হিসেবে এরই মধ্যে চালু করেছে মস্কো। কিন্তু একটা বিষয় স্পষ্ট যে, পশ্চিমাদের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞার নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলার জন্য যে গতিতে এ ব্যবস্থা চালু করা দরকার ছিল, তা হয়নি।
দক্ষিণ বিশ্বের উদ্দেশে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বর্তমান সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে সাবেক সোভিয়েত আমলের একটা বয়ান দিয়েছেন। তা হলো, মস্কো প্রতিটি দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং মনে করে প্রতিটি জাতির নিজস্ব পথ অনুসরণের অধিকার রয়েছে। পশ্চিমাদের ধারাবাহিক অর্থনৈতিক আধিপত্য এবং নয়া উপনিবেশবাদী বিশ্বায়নের মধ্য দিয়ে তারা যে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে শোষণ করছে, সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন পুতিন।
পুতিন তাঁর বক্তব্যে পশ্চিমা সমাজের রুগ্ণতা নিয়েও কথা বলেন। পশ্চিমা বিশ্বের যাঁরা তাঁদের সরকারব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলেন অথবা মূলধারার সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন না, তাঁদেরকে নিয়েই পুতিন তাঁর কথাগুলো বলেছেন। পুতিন নির্দিষ্টভাবে পশ্চিমা রক্ষণশীলদের আবেগ-অনুভূতি নিয়ে খেলতে চেয়েছেন। পশ্চিমা সভ্যতার ঐতিহ্যগত খ্রিষ্টীয় সারসত্তা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন। পুরুষ ও নারীর বাইরে আর কোনো লৈঙ্গিক ধারণা থাকতে পারে কিংবা সমকামিতার অধিকারবিষয়ক ধারণা তিনি খারিজ করে দিয়েছেন। পুতিন তাঁর বক্তব্যে জোর দিয়ে বলেন, তাঁর সমস্যাটা পশ্চিমা অভিজাতদের সঙ্গে, পশ্চিমা সাধারণ জনগণের সঙ্গে তাঁর কোনো বিরোধ নেই।
ভ্লাদিমির পুতিন তাঁর বক্তব্যে পরিবেশকর্মীদের কাছেও নালিশ জানিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, ইউক্রেন সংঘাতের উছিলায় পশ্চিমা বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি উপেক্ষা করছে। সংক্ষেপে, পুতিন তাঁর বক্তব্যে পশ্চিম, পূর্ব ও দক্ষিণ বিশ্বকে তাদের নিজস্ব সমস্যা ও বৈশ্বিক সংকটকে বড় পরিসর থেকে দেখার জন্য বলেছেন। সবাইকে ইউক্রেন যুদ্ধকে একটি প্রিজমের ভেতর দিয়ে দেখতে বলেছেন। সেটা হলো—সংকটটা শুধু ইউক্রেন নয়, তার চেয়েও অনেক বড় কিছু।
পুতিন ও ক্রেমলিন এখন বিশ্বকে বিশেষ করে পশ্চিমকে এই বার্তাই দিতে চাইছে যে, ইউক্রেনকে তারা অনেক বেশি সমর্থন দিচ্ছে। বিশ্ব যেভাবে অতি গুরুত্বের সঙ্গে ইউক্রেন ইস্যু দেখছে, আসলে এ বিষয়টি ততটা গুরুত্ব পাওয়ার যোগ্য নয়। ‘সম সুযোগের ভিত্তিতে সংলাপের মাধ্যমে’ খুব সাদামাটাভাবে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
অতি অবশ্যই, এই সব সংকটে ইন্ধনের ক্ষেত্রে মস্কো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে গ্যাসযুদ্ধ চালিয়ে, জাতিসংঘের সঙ্গে করা শস্য চুক্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, ইউক্রেনের গম রপ্তানি কমিয়ে দিয়ে এবং দক্ষিণ বিশ্বে খাদ্যঘাটতি বাড়িয়ে দিয়ে রাশিয়া নতুন নতুন সংকটের জন্ম দিচ্ছে। রাশিয়ার লক্ষ্য হচ্ছে, ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে বিশ্বের চোখ সরিয়ে দেওয়া এবং এই সংকটকে ছোট ও আঞ্চলিক ইস্যু হিসেবে উপস্থাপন করা।
প্রকৃতপক্ষে যাঁরা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পুরো প্রেক্ষাপট খুব ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করেন না এবং যাঁরা যুদ্ধাপরাধের সংবাদগুলোকে অবিশ্বাস করেন, তাঁদের কাছে পুতিনের যুক্তি যথেষ্ট যৌক্তিক বলে মনে হতে পারে। দুর্ভাগ্যজনক সত্য হচ্ছে, পুতিন যেটাকে সংলাপ অথবা সমাধান বলছেন, সেটা হলো রাশিয়ার কাছে ইউক্রেনের শর্তহীন আত্মসমর্পণ। পুতিনের দাবি হচ্ছে, ইউক্রেনে যুদ্ধ ও আগ্রাসনের নামে রাশিয়া যে বিভীষিকা চালাচ্ছে, সেটি যেন দেখেও না দেখে পশ্চিমা বিশ্ব।
পুতিন চান বিশ্ব যেন ইউক্রেনকে ভুলে যায়। যদিও এই চাওয়াটা তাঁর ব্যক্তিগত।
****আন্তন বারবাশিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও রিডল রাশিয়ার সম্পাদকীয় পরিচালক
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:নভেম্বর ০৮, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,