রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ‘তাত্ত্বিক গুরু’ আলেকসান্দর দাগিনের মেয়ে দারিয়া দাগিনা হত্যাকাণ্ড একটি সন্ধিক্ষণের জন্ম দিয়েছে। এ হত্যাকাণ্ড রাশিয়ার জন্য কী অর্থ বহন করে, তা নিয়ে একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট।
শনিবার রাতে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর কাছে গাড়িবোমায় নিহত হন সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার দারিয়া (২৯)। তাঁর বাবা রুশ দার্শনিক আলেকসান্দর (৬০) দেশটির প্রেসিডেন্ট পুতিনের ‘মস্তিষ্ক’ হিসেবে পরিচিত।
আলেকসান্দর ও দারিয়া মস্কোর কাছে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। অনুষ্ঠান থেকে বাবা-মেয়ের একসঙ্গে একই গাড়িতে করে বাসায় ফেরার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আলেকসান্দর আলাদাভাবে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। দারিয়া তাঁর বাবার গাড়ি চালিয়ে বাসায় ফিরছিলেন। পথে গাড়িটি বিস্ফোরিত হয়।
রুশ তদন্তকারীরা বলছেন, ভাড়াটে লোক দিয়ে পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে বলে তাঁদের মনে হচ্ছে।
দারিয়া হত্যার ঘটনায় রুশপন্থী দলগুলো কোনো ধরনের তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই ইউক্রেনকে দোষারোপ করতে শুরু করেছে। অন্যদিকে ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা এ হত্যায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে।
পারিবারিক বন্ধুদের পাশাপাশি বাইরের কিছু বিশ্লেষকদের সন্দেহ, এ হামলার আসল লক্ষ্যবস্তু ছিলেন আলেকসান্দর।
রুশ সরকারে আলেকসান্দরের কোনো আনুষ্ঠানিক পদ-পদবি নেই। তবে তাঁকে পুতিনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলে মনে করা হয়। তাঁর উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা পুতিনের বিশ্বদর্শনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে আসছে। এ কারণে অনেকে তাঁকে পুতিনের ‘তাত্ত্বিক গুরু’ বলে অভিহিত করেন। ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের প্রতি আলেকসান্দর ও তাঁর মেয়ে দারিয়ার জোর সমর্থন রয়েছে।
যেভাবে বিস্ফোরণ
একটি টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজারে করে বাড়িতে যাচ্ছিলেন দারিয়া। গাড়িটি তিনিই চালাচ্ছিলেন। হাইওয়ে দিয়ে পূর্ণ গতিতে গাড়িটি চলছিল।
রাশিয়ার ইনভেস্টিগেটিভ কমিটি বলছে, চালকের দিকে গাড়িটির নিচে একটি বিস্ফোরক ‘ডিভাইস’ লাগানো ছিল বলে তারা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে। ‘ডিভাইস’ বিস্ফোরিত হলে গাড়িটিতে আগুন ধরে যায়। এতে দারিয়া ঘটনাস্থলেই নিহত হন।
পরে তদন্তকারীরা ঘটনাস্থলে যান। তাঁরা বিভিন্ন আলামত জব্দ করেন। একজন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ একটি বিশেষ পার্কিং লটে পোড়া গাড়িটি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।
রাশিয়ার ইনভেস্টিগেটিভ কমিটি এক বিবৃতিতে বলেছে, এ ঘটনায় হত্যা মামলা হয়েছে। তারা তদন্ত শুরু করে দিয়েছে। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য-উপাত্ত ও আলামত তারা বিশ্লেষণ, যাচাই-বাছাই করেছে। এতে তদন্তকারীদের মনে হয়েছে, এটি পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। ভাড়াটে লোক দিয়ে এ কাজ করানো হয়েছে।
আসল নিশানা
হামলার আসল লক্ষ্যবস্তু কে ছিলেন, তা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। তবে দারিয়ার বন্ধু আন্দ্রে ক্রাসনভ রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম তাসকে বলেছেন, তাঁর ধারণা, এ হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিলেন আলেকসান্দর অথবা বাবা-মেয়ে দুজনই।
দারিয়া হত্যা কী বার্তা দেয়
দারিয়া হত্যার ঘটনা একটি নতুন সংকট তৈরি করতে যাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। এদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সতর্ক করে বলেছেন, তাঁর দেশের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে রুশ হামলা জোরদার হতে পারে।
রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা ও স্বঘোষিত দোনেৎস্ক প্রজাতন্ত্রের প্রধান ব্যক্তিত্ব ডেনিস পুশিলিন তাৎক্ষণিকভাবে দারিয়া হত্যার জন্য ইউক্রেনকে দায়ী করেছেন। তিনি অবশ্য তাঁর দাবির পক্ষে কোনো তথ্য-প্রমাণ দেননি।
ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা গাড়ি বিস্ফোরণের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। তাঁদের ভাষ্য, এ ঘটনা রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ বিরোধের ফলাফল হতে পারে।
জেলেনস্কির উপদেষ্টা মিখাইলো পোডোলিয়াক ইউক্রেনীয় টেলিভিশনে গতকাল রোববার বলেন, ‘এর সঙ্গে আমাদের অবশ্যই কোনো যোগসূত্র নেই।’
ইউক্রেনের কর্মকর্তারা এ ঘটনা নিয়ে কথাবার্তা বা গণমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করছেন।
যেমন ইউক্রেনের চিফ ডাইরেক্টরেট অব মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের মুখপাত্র আন্দ্রি ইউসভ দ্য ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, তাঁরা দারিয়া হত্যার ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করবেন না।
তবে এ হত্যাকাণ্ডের জেরে আন্দ্রি ইউসভ একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন, ‘আমি বলতে পারি যে রুশ বিশ্বের অভ্যন্তরীণ ধ্বংসের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।’
আন্দ্রি ইউসভের ভবিষ্যদ্বাণী হলো, রুশ বিশ্ব তার ভেতর থেকে নিজেই নিজেকে গ্রাস করবে।
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা গতকাল বলেছেন, দারিয়া হত্যায় ইউক্রেন জড়িত বলে প্রমাণিত হলে কিয়েভ সরকার কর্তৃক বাস্তবায়িত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের নীতি সম্পর্কে তাঁদের কথা বলা উচিত।
মারিয়া জাখারোভা আরও বলেন, দারিয়া হত্যার বিষয়ে দোনেৎস্ক প্রজাতন্ত্রের নেতা পুশিলিন যে অভিযোগ তুলেছেন, তা অবশ্যই উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে যাচাই করা উচিত।
গাড়ি বিস্ফোরণের ঘটনাটি নিয়ে বিশ্লেষকেরা নানা কথা বলছেন। কেউ কেউ বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে অসন্তুষ্ট, এটা এমন অভ্যন্তরীণ পক্ষের কাজ হতে পারে।
আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ নিকোলাস টেনজার গতকাল টুইট করে বলেন, হামলাটির উৎস স্পষ্টতই অভ্যন্তরীণ, বাহ্যিক নয়।
মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের গোয়েন্দাবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান অ্যাডাম বি শিফ বলেছেন, তিনি আশা করেন, এ হামলার পেছনে ইউক্রেনের হাত নেই। তিনি তেমনটা দেখতে চান না।
কিছু বিশ্লেষক রুশ ভূখণ্ডের কেন্দ্রস্থলে পুতিনের এক ঘনিষ্ঠ মিত্রের মেয়ের ওপর হামলার যে প্রতীকী তাৎপর্য রয়েছে, সে দিকটির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে রাশিয়ার কারাবন্দী বিরোধী নেতা আলেক্সি নাভালনির ঘনিষ্ঠ মিত্র লিওনিড ভলকভের মন্তব্যটি তাৎপর্যপূর্ণ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি লিখেছেন, হামলার ঘটনাটি এমন একটি জায়গায় ঘটেছে, যেটি পুতিনবাদের কেন্দ্রস্থল।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: আগষ্ট ২২, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,