ইউক্রেনের আকাশসীমায় বিমান উড্ডয়ন নিষিদ্ধের এলাকা (নো-ফ্লাই জোন) ঘোষণা করতে কিয়েভের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে সামরিক জোট ন্যাটো। ইউক্রেনের যুদ্ধ নিজেদের ঘরে টেনে আনতে চায় না ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো। এর পরিবর্তে নানা অবরোধ ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পথে হাঁটতে চায় তারা। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ঠেকাতে সরাসরি কেউই তাঁর মুখোমুখি হতে চান না। এর পরিবর্তে নানা জটিল হিসাব-নিকাশ করছেন পশ্চিমা নেতারা।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, রাশিয়ার ওপর নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা এবং ইউক্রেনকে জোরালো সমর্থন সত্ত্বেও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো রুশ বাহিনীর হামলা বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ওপর চাপ বাড়ানোর ক্ষেত্রে পশ্চিমা নেতাদের হাতে খুব বেশি বিকল্পও নেই।
বিশ্বের উন্নত অর্থনীতির সাত দেশ জি-৭-এর নেতারা গত শুক্রবার রাশিয়ার ওপর আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের পক্ষ থেকেও রাশিয়ার ওপর চাপ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। ইতিমধ্যে ইউরোপীয় মিত্রদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার আর্থিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তির রপ্তানি নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে। রাশিয়াকে বিভিন্ন খেলা থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং কয়েক ডজন কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে।
তবে এখন পর্যন্ত রাশিয়ার জ্বালানি খাত তুলনামূলকভাবে নিষেধাজ্ঞা থেকে রেহাই পেয়েছে। অনেক মার্কিন আইনপ্রণেতা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে রাশিয়ার তেলের আমদানি নিষিদ্ধ করার জন্য অনুরোধ করছেন। প্রেসিডেন্ট তা একেবারে উড়িয়ে দেননি। কোনো কোনো নেতা আবার রাশিয়ান আর্থিক ব্যবস্থাকে বিশ্বের অন্যান্য অংশ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করার আহ্বান জানিয়েছেন।
ইউক্রেনে কাজ করা সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম টেলর বলেন, ‘অনেকেই ভেবেছিলেন নিষেধাজ্ঞার হুমকিতে পুতিনকে আটকানো যাবে। কিন্তু তা হয়নি। বাড়তি নিষেধাজ্ঞাতেও যে কাজ হবে, তা-ও স্পষ্ট নয়।’
ব্লিঙ্কেন এমন কঠোর পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সতর্ক করে বলেছেন, এ ধরনের পদক্ষেপ নিলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সরবরাহ কমে যাবে। মার্কিন নাগরিক এবং ইউরোপীয়দের জন্য জ্বালানি খরচ বেড়ে যাবে।
এদিকে পারমাণবিক সংঘর্ষের আভাস বিবেচনায় নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, সংঘাত যতক্ষণ ইউক্রেন বা ন্যাটোভুক্ত দেশের বাইরে চলবে, ততক্ষণ যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলো তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকবে।
তবে অ্যাডাম কিনজিঙ্গার এবং রজার উইকারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান নেতা মনে করেন, মিত্রদের শেষ পর্যন্ত নো-ফ্লাই জোনের ঝুঁকি নিতে হবে।
নো-ফ্লাই জোন ঘোষণায় না
আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি তাঁর দেশের আকাশসীমায় নো-ফ্লাই জোন ঘোষণা করতে ন্যাটোর প্রতি অনুরোধ জানান। এ নিয়ে শুক্রবার ব্রাসেলসে বৈঠকে বসে ন্যাটো। বৈঠকে ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ জেলেনস্কির অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা থেকে ইউক্রেনকে সুরক্ষা দিতে গেলে ন্যাটো বাহিনীকে রুশ বিমান ভূপাতিত করতে হবে। এ পদক্ষেপের কারণে ইউরোপে পুরোদমে যুদ্ধ বেধে যেতে পারে, যেখানে আরও অনেক দেশ জড়িত হবে। আমরা এ সংঘাতের অংশ নই।’
জেনস স্টলটেনবার্গ আরও বলেন, ‘ন্যাটো জোট হিসেবে ইউক্রেনের চেয়ে আমাদের বড় দায়িত্ব হলো এ যুদ্ধের বিস্তার ঠেকানো। এমন কিছু ঘটলে (যুদ্ধ বিস্তৃত হলে) তা অনেক বেশি ভয়াবহ ও বিধ্বংসী পরিণাম বয়ে আনবে। এতে মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়বে।’
ন্যাটোর এমন ঘোষণার পর শুক্রবার রাতে ক্ষোভ জানিয়ে টেলিভিশনে ভাষণ দেন ভলোদিমির জেলেনস্কি। তিনি বলেন, ‘আজ যে ন্যাটোর সম্মেলন হলো, তা একটি দুর্বল সম্মেলন। এখানে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে ইউরোপের স্বাধীনতার জন্য লড়াইকে সবাই একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করে না। নো-ফ্লাই জোন ঘোষণার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে ইউক্রেনে আরও বেশি বোমা হামলার সবুজ সংকেত দিয়ে দিলেন ন্যাটোর নেতারা।’ এতে যাঁদের মৃত্যু হবে, তার দায় ন্যাটোকে নিতে হবে বলে সতর্ক করেন জেলেনস্কি।
কূটনীতিতে গুরুত্ব
মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান র্যান্ড করপোরেশনের বিশেষজ্ঞ স্যামুয়েল চারাপের মতে, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ও জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের মতো মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কূটনৈতিক সমাধানের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত। নিষেধাজ্ঞার ওপর নির্ভর করেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে সৈন্য হঠাতে রাজি করানোর চেষ্টা করতে হবে। চারাপ বলেন, ‘এটা অসম্ভব কাজ। তবে আমি মনে করি, এ মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে ভালো উপায়।’
এদিকে চীন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের জায়গায় নিজস্ব বাজি ধরছে। পশ্চিমা কূটনীতিকেরা মনে করছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বেইজিং আরও বেশি অস্বস্তিতে পড়ছে। রাশিয়ার অর্থনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রভাব ঠেকাতে বেইজিংকে সাহায্যের হাত বাড়াতে হবে। কূটনীতিকেরা বলেন, পশ্চিমাদের তুলনায় চীন পেছন থেকে আরও বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
ইউক্রেনকে দ্রুত সদস্য করতে চায় ইইউ
কমিশনের উপপ্রধান ম্যারোস সেফকোভিচ বলেছেন, ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভ্যন্তরে নিহিত এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশটির ইইউ সদস্য হওয়া উচিত। ফ্রান্সে শুক্রবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের মন্ত্রীদের এক বৈঠক শেষে ম্যারোস বলেন, ‘এখন কড়া বার্তা দেওয়ার উপযুক্ত সময়। ইউক্রেনের জনগণ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অংশ, এটা ইঙ্গিত দেওয়ার সময়। আমরা যত দ্রুত সম্ভব তাদের সদস্য করতে চাই।’
এর আগে চলতি সপ্তাহে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি দ্রুত ইউক্রেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য করতে আহ্বান জানান। তবে ইইউ কর্মকর্তারা সহানুভূতি দেখালেও বলছেন, সদস্যপদ পাওয়ার জন্য কোনো সংক্ষিপ্ত পথ নেই। যোগদানপ্রক্রিয়া দীর্ঘ হবে।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ মার্চ ০১, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,