লেখক: জোসেফ বোরেল।
কোনো কোনো সপ্তাহ আছে যাকে একেকটি যুগ বলে মনে হয়। চলতি সপ্তাহটা ঠিক সে ধরনের। ইউক্রেনে রাশিয়ার নগ্ন হামলায় ইউরোপে আবার যুদ্ধঘটিত বিয়োগান্ত দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। রাশিয়ার বাহিনী বসত ভবন, দালান কোঠা, স্কুল, হাসপাতালসহ বেসামরিক সব ধরনের স্থাপনায় বাছবিচার ছাড়াই বোমা বৃষ্টি চালিয়ে যাচ্ছে। এই অন্যায্য ও চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধকে ন্যায্য যুদ্ধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ক্রেমলিনের প্রোপাগান্ডা যন্ত্র প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে আরও সহিংসতা নেমে আসার ভয়ে ইতিমধ্যেই ইউক্রেন ছেড়ে ১০ লাখ লোক পালিয়ে চলে গেছে।
অন্যদিকে, প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কির নেতৃত্বে ইউক্রেনের সেনারা ও দেশটির সাধারণ মানুষ রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে নায়কোচিত প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান আক্রমণের মুখোমুখি হয়ে তারা তাদের জাতীয়তার পরিচয় ভুলে ঐক্যের পথে নেমেছে। ভ্লাদিমির পুতিন হয়তো ভেবেছিলেন, ইউক্রেনবাসীর একটি বড় অংশ যেহেতু রুশ বংশোদ্ভূত বা রুশ ভাষাভাষী, সেহেতু তাঁরা ‘বৃহত্তর রাশিয়া’র অংশ হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় পুতিনকে সমর্থন করবেন। কিন্তু তাঁদের প্রতিক্রিয়া দেখে বোঝা যাচ্ছে, তাঁরা তাঁদের দেশকে নিজেদের দেশ হিসেবেই দেখতে চান এবং তাঁরা তাঁদের ভবিষ্যৎকে ইউরোপের সঙ্গে যূথবদ্ধ হিসেবেই দেখতে আগ্রহী।
ইউরোপীয় ইউনিয়নও কিন্তু অবিশ্বাস্য দ্রুততায় কাজ শুরু করে দিয়েছে। কেউ কেউ অবশ্য ভেবেছিল, আমরা বিভ্রান্ত করব, ইউক্রেনের সঙ্গে দ্বিমত করব এবং তাদের সহায়তা দিতে বিলম্ব করব। কিন্তু আমরা ইউক্রেনকে সমর্থন করার জন্য রেকর্ড গতিতে কাজ করেছি। অগ্রগতির পথের বাধাগুলো ভেঙে দিয়েছি। রাশিয়ার যেসব অতি ধনী গোষ্ঠী ক্রেমলিনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত এবং এই যুদ্ধের জন্য যাঁরা দায়ী, তাদের সবার ওপর আমরা নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছি।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার কথা দিন কয়েক আগেও চিন্তা করা যেত না, আমরা সেসব পদক্ষেপ নিয়েছি। আন্তর্জাতিক লেনদেন মাধ্যম সুইফট থেকে রাশিয়ার নেতৃস্থানীয় ব্যাংককে বাদ দেওয়া হয়েছে। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পদ জব্দ করা হয়েছে।
ইইউর যেসব সদস্য দেশ ইউক্রেনকে সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে সহযোগিতা করছে, ইইউ সেই সব দেশকে সহায়তা দিচ্ছে। ইউরোপিয়ান পিস ফ্যাসিলিটির আওতায় এসব ইইউ সদস্যকে ৫০ কোটি ডলার দেওয়া হচ্ছে। সর্বোচ্চ কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে আমরা অন্যান্য দেশকে সঙ্গে নিয়ে এসব পদক্ষেপ নিয়েছি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, জাপান, সিঙ্গাপুর এবং অন্যান্য অনেক আর্থিক ও অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। এমনকি খেলাধুলার মাঠেও রাশিয়ার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে। একের পর এক আন্তর্জাতিক কোম্পানি রাশিয়ান বাজার ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
এখনো ইউক্রেনের ময়দান থেকে ভয়ংকর সব খবর আসছে এবং কেউ জানে না কীভাবে এই যুদ্ধ শেষ হবে। পুতিন যথারীতি এসব ধ্বংসযজ্ঞকে পশ্চিমাদের সঙ্গে বাকি বিশ্বের মধ্যে চলা সংঘর্ষের একটি অনিবার্য উপজাত হিসাবে চিত্রিত করবেন। তিনি বলতে চাইবেন পশ্চিমাদের কারণেই এই রক্তপান এড়ানো তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এই খোঁড়া যুক্তির মাধ্যমে তিনি দায়মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করবেন। কিন্তু তাঁর সে দাবিকে প্রায় কেউই স্বীকার করবে না।
একজন স্বৈরাচারী নেতা সামরিক অভিযানের মাধ্যমে যা ইচ্ছা তাই ছিনিয়ে নেবেন—এটি বেশির ভাগ দেশ এবং জনগণ মেনে নেবে না। গত ২ মার্চ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ১৪১টি দেশ ইউক্রেনের সার্বভৌম অধিকারকে সমর্থন করে ভোট দিয়েছে।
একই সঙ্গে তারা রাশিয়ার হামলাকে জাতিসংঘের সনদ এবং আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন হিসাবে নিন্দা করেছে। মাত্র চারটি দেশ রাশিয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছে (বাকি ৩৫টি দেশ ভোটদানে বিরত ছিল)। রাশিয়ার নেতারা তাদের দেশকে বাইরের বিশ্ব থেকে কতটা বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে তা এই ঐতিহাসিক বৈশ্বিক ঐকমত্যে থেকে প্রমাণিত হয়। ইইউ জাতিসংঘে নতুন অর্জিত ঐকমত্যের সুফল অর্জনে কঠোর পরিশ্রম করেছে। আমরা জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের কথার প্রতিধ্বনি করে বলতে চাই, সহিংসতা থামিয়ে কূটনীতির দ্বার উন্মুক্ত করাই এখন সবচেয়ে বড় কাজ।
রাশিয়ার আক্রমণের সপ্তাহে আমরা বিলম্বে হলেও একটি ভূ-রাজনৈতিক ইউরোপের জন্ম দেখতে পাচ্ছি। কীভাবে ইউরোপকে আরও শক্তিশালী ও নিরাপত্তা সচেতন করে তোলা যায়, তা নিয়ে বছরের পর বছর ধরে ইউরোপীয়রা বিতর্ক করে আসছে। বিশ্বমঞ্চে আমাদের রাজনৈতিক লক্ষ্যগুলো অর্জনে আমরা কীভাবে আরও ঐক্যবদ্ধ হতে পারি, তা নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে আলোচনা করে যাচ্ছি। সেসব আলোচনায় অতীতে তেমন কোনো কাজ হয়নি। কিন্তু গত এক সপ্তাহে রাজনৈতিক ঐকমত্য অর্জনের ক্ষেত্রে আমরা নজিরবিহীন অগ্রগতি অর্জন করতে পেরেছি। আসলে গত এক দশকে যা আমরা পারিনি গত এক সপ্তাহে এই ক্ষেত্রে তার চেয়ে অনেক বেশি অগ্রগতি পেয়েছি।
বিজ্ঞাপন
এটি একটি আশাবহ অগ্রগতি। তবে এখনো আরও অনেক কিছু করার আছে। প্রথমত, আমাদের অবশ্যই ইউক্রেন এবং দেশটির জনগণকে দীর্ঘ মেয়াদে সমর্থন করতে হবে। এই সমর্থন শুধু ইউক্রেনের স্বার্থে নয়, বরং এর পাশাপাশি আমাদের নিজেদের স্বার্থেও করতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, পুতিনকে জয়ী হতে দিলে কারও নিরাপত্তাই থাকবে না। আইন কানুন না থাকলে আমরা সবাই বিপদে পড়ব। এ জন্য ইউক্রেনের বেঁচে থাকাটা আমাদের অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। সেই লক্ষ্যে, আমাদের অবশ্যই রাশিয়ার জন্য একটি যৌক্তিক অবস্থানে ফিরে যাওয়ার পথ খোলা রাখতে হবে যাতে পুনরায় শান্তি ফিরে আসতে পারে।
দ্বিতীয়ত, ইউরোপীয় নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতার স্বার্থে এই যুদ্ধের নিহিতার্থ ও গতিপ্রকৃতি আরও বিশদভাবে আমাদের বুঝতে হবে। জ্বালানি-শক্তির কথাই বিবেচনা করুন। এটি পরিষ্কার যে, আমাদের কৌশলগত কারণেই বাধ্যতামূলকভাবে রাশিয়ার মতো কর্তৃত্ববাদী এবং আগ্রাসী শক্তির কাছ থেকে জ্বালানি আমদানি কমাতে হবে। আমরা আমাদের প্রতিপক্ষকে আক্ষরিক অর্থে অর্থায়ন করে তার যুদ্ধ করার ক্ষমতাকে বাড়িয়ে চলেছি।
ইউক্রেনে রাশিয়ার এই আক্রমণ আমাদের সবুজ জ্বালানির উত্তরণ-গতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে আমাদের বিনিয়োগ করা প্রতিটি ইউরো আমাদের রাশিয়ার কাছে থেকে পাওয়া জ্বালানি নির্ভরতা কমাবে। এটি একদিকে আমাদের কৌশলগত দুর্বলতা হ্রাস করবে, অন্যদিকে তা বিপর্যয়কর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এড়াতে সহায়তা করবে।
বিজ্ঞাপন
তৃতীয়ত, ক্ষমতার রাজনীতির জগতে আমাদের আত্মরক্ষার জন্য আরও বেশি সক্ষম করে তুলতে হবে। আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার অর্থ হলো রাশিয়ার আক্রমণাত্মক বিভ্রান্তিমূলক নেটওয়ার্কগুলোকে মোকাবিলা করা।
‘ভূ-রাজনৈতিক ইউরোপ’-এর আসল কাজটি একেবারে সোজাসাপ্টা। সেটি হলো, যত দ্রুত সম্ভব একটি মুক্ত ইউক্রেন নিশ্চিত করতে হবে। এরপর আমাদের মহাদেশ জুড়ে শান্তি ও নিরাপত্তা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমাদের সর্বশেষ উপলব্ধিকে ব্যবহার করতে হবে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
জোসেফ বোরেল ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ফর ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড সিকিউরিটি পলিসির হাই রিপ্রেজেনটেটিভ এবং ইউরোপিয়ান কমিশন ফর এ স্ট্রংগার ইউরোপ ইন দ্য ওয়ার্ল্ড-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ মার্চ ১০, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,