ঢাকা শহরের একটি অংশে সবুজ বনানীতে আচ্ছাদিত বিশাল অঞ্চল। পিলখানা নামে পরিচিত অঞ্চলটি। ষোড়শ শতকে মোগলদের হাতির আস্তাবল ছিল এখানে। ১৮৭৬ সালে এখানে স্থাপিত হয় আজকের বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-এর পূর্বসূরি প্রতিষ্ঠান ফ্রন্টিয়ার গার্ডসের সদর দপ্তর। বহু ঘটনার নীরব সাক্ষী পিলখানা। তার মধ্যে সবচেয়ে নির্মম ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারির ঘটনাটি।
সেদিন ছিল বিজিবির পূর্বসূরি বাহিনী বিডিআরের দরবার। আকস্মিকভাবেই দরবারের শুরুর দিকে বিদ্রোহের সূচনা হয়। অবশ্য বিদ্রোহীদের বিস্তারিত পূর্বপ্রস্তুতি ছিল এমনটাই দেখা যাচ্ছে। সে বিদ্রোহে, বাহিনীপ্রধানসহ ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা নিহত হন। তাঁরা প্রেষণে বিডিআরে কাজ করছিলেন। আরও নিহত হন ১০ জন বিডিআরের সদস্য ও সাতজন বেসামরিক ব্যক্তি। ৩০ ঘণ্টার মতো স্থায়ী হয় এ বিদ্রোহ। অবশ্য প্রায় সব হতাহতের ঘটনা শুরুর দিকেই ঘটে যায়। একটি ঘটনায় এত সেনা কর্মকর্তার একসঙ্গে মৃত্যুবরণ একটি বিরল নজির। উল্লেখ করা যায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে ৪৭ জন সেনা কর্মকর্তা প্রাণ হারিয়েছিলেন। এ ভয়াবহ নির্মম ঘটনায় গোটা জাতি শোকাহত ও ক্ষুব্ধ হয়। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজার জোরালো দাবিও ওঠে। অবশ্য আমাদের রাজনৈতিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় দুটো প্রধান দল ঘটনার সঙ্গে অপর দল সংশ্লিষ্ট বলে অভিযোগ করতে থাকে।
পিলখানার সদর দপ্তর ছাড়াও দেশের অন্যান্য স্থানে বিডিআর স্থাপনায়ও বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। তবে সেগুলোতে এ ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। দেশের প্রচলিত আইনে পিলখানায় সংঘটিত হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধের জন্য মামলা হয় ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। বিস্ফোরক দ্রব্য আইনেও আরেকটি মামলা হয়। তা ছাড়া বাহিনীটির আইনে বিদ্রোহের বিচার করতে ১১টি বিশেষ আদালত ও ৬০টি সংক্ষিপ্ত বিচার আদালত গঠন করা হয়। প্রায় ১৭ হাজারের মতো অভিযুক্ত ব্যক্তির মধ্যে অর্ধেকেরও বেশিকে চাকরি থেকে বরখাস্ত কিংবা বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। আট হাজারের অধিক ব্যক্তি কারাদণ্ড কিংবা অন্য কিছু লঘুদণ্ডে দণ্ডিত হয়। মূল ফৌজদারি মামলা ৮৫৫ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। দীর্ঘ বিচার-প্রক্রিয়া শেষে দায়রা আদালত ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ২৫৬ জনকে তিন থেকে ১০ বছর মেয়াদি কারাদণ্ড আর দুজন রাজনৈতিক নেতাসহ ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। ২৭৭ জনকে দেওয়া হয় বেকসুর খালাস।
এসব দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে। মৃত্যুদণ্ডের আদেশ তো হাইকোর্ট বিভাগ নিশ্চিতকরণের আগেই পূর্ণতা পাবে। সেখানেও যাঁরা দণ্ডিত হবেন, তাঁরা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করতে পারবেন। তবে দায়রা আদালতে এ রায়ে স্বস্তি পেয়েছে নিহত ব্যক্তিদের স্বজনসহ শোকার্ত জাতি। অবশ্য দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহল বেশ কিছু প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এর মধ্যে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রাণদণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে। সংস্থাটি ইউরোপীয় মূল্যবোধ থেকেই মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় প্রায় সব ক্ষেত্রে। আমাদের আইনের বিধানটি তারা অবজ্ঞা করতে চায়। অন্যদিকে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান পুনরায় বিচারের আগে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করার দাবি রেখেছেন। বিচারকালে আইনের মানদণ্ড সঠিকভাবে অনুসরণ করা হয়নি বলেও তিনি অভিযোগ করেছেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, দণ্ডিত ব্যক্তিরা উচ্চতর আদালতে আপিলের সুযোগ পাবেন। দায়রা আদালতের বিচারে কোনো ত্রুটি বা অসংগতি থাকলে উচ্চতর আদালত প্রতিকার দেবেন। সুতরাং বিষয়টি নিয়ে এখনই বিচলিত হওয়ার কিছু আছে বলে মনে হয় না।
দেশের প্রধান বিরোধী দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেছেন, তাঁদের একজন নেতাকে রাজনৈতিক আক্রোশে দণ্ডিত করা হয়েছে। গোটা বিচার-প্রক্রিয়া নিয়ে তিনি এ পর্যায়ে কোনো মন্তব্য করেননি। সে নেতাও আপিলের সুযোগ পাবেন বিধায় এ ধরনের বক্তব্য যথোচিত হয়নি। অপরদিকে রায় ঘোষণার দিনে সদ্য পদত্যাগপত্র জমাদানকারী আইন প্রতিমন্ত্রীর একটি বক্তব্যকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হয়। গণমাধ্যমে প্রচারিত তাঁর বক্তব্যের সারমর্ম হচ্ছে, একটি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার ষড়যন্ত্রে এ ঘটনা ঘটে। ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে রয়েছেন মানবতাবিরোধী অপরাধে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডের আদেশপ্রাপ্ত একজন রাজনৈতিক নেতা এবং এ বাহিনীর একজন সাবেক মহাপরিচালক। ওই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে ৪০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয় বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন।
সরকারের দায়িত্বশীল পদে আসীন একজন ব্যক্তির এ ধরনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উপেক্ষা করা যায় না। বরং প্রশ্ন জাগে মূল মামলায় তাঁদের আসামি করা হয়নি কেন? হয়তো বা শুরুতে এ তথ্য পাওয়া যায়নি। কিন্তু যখন পাওয়া গেল তখন তো সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া যেত। হতে পারে বিচারটি বিলম্বিত হবে বিবেচনায় তা করা হয়নি। কিন্তু বিস্ময়কর যে আজ অবধি এ বিষয়ে কোনো এজাহার দায়ের করা হয়নি। মামলার রায় দিতে গিয়ে ঘটনা কেন ঘটল—সে বিষয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ বিচার আদালতের রয়েছে। এর মধ্যে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা, অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া ও সেনাবাহিনীর মনোবল নষ্ট করার কথাও উল্লেখ আছে। তাহলে ধরে নেওয়া স্বাভাবিক, এ ধরনের হীন উদ্দেশ্যে কিছু ব্যক্তি ষড়যন্ত্র করেছিলেন। সে ষড়যন্ত্রের ফসল পিলখানা ট্র্যাজেডি। এটা একটি সুসংগঠিত বাহিনীর মেরুদণ্ডে গুরুতর আঘাত। গোটা জাতিকে আতঙ্কিত করা। এগুলোর নেপথ্যে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের আইনের আওতায় এখনো কেন নেওয়া হয়নি, এ প্রশ্ন অনেকের। আর আইন প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণের জন্যও সরকারের সক্রিয় ভূমিকা আবশ্যক। এত দেরি হওয়ার বিষয়টিই দুর্বোধ্য। তদুপরি এখনো এ বিষয়ে কার্যত নিষ্ক্রিয় থাকা অনেক প্রশ্নের অবতারণা করতে পারে।
বিদ্রোহের পর ২০১০ সালে বাহিনীটির নাম, পতাকা, মনোগ্রাম, পোশাক—সবই বদলে দেওয়া হয়। বাহিনীটির নাম বদলের আবশ্যকতা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। তবে বিদ্রোহে সংঘটিত ঘটনার ভয়াবহতা বিবেচনায় তেমন বিতর্ক আসেনি। ১৭৯৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালে রামগড় লোকাল ব্যাটালিয়ান নামে এ বাহিনীর যাত্রা শুরু। তবে সময়ান্তরে নাম, কার্যপরিধি ও গঠন কাঠামোয় পরিবর্তন এসেছে কয়েকবার। নাম ছিল ফ্রন্টিয়ার গার্ডস, বেঙ্গল মিলিটারি পুলিশ, ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ রাইফেলস। আবার মুক্তিযুদ্ধের সময় তদানীন্তন ইপিআর পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বড় প্রতিরোধ গড়ে তুললে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী একে পুনর্গঠিত করে নাম দিয়েছিল ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সেস (ইপিকাফ)।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের ছিল অতি গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। একটি হিসাব অনুসারে এ বাহিনীর প্রায় নয় হাজার সদস্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধে প্রাণ দেন ৮৭১ জন। দুটি বীরশ্রেষ্ঠসহ ১৪১টি বীরত্বসূচক পদক লাভ করে এ বাহিনী। স্বাধীনতার পর উত্তরোত্তর সবল হচ্ছিল এটি। চার হাজার ৪২৭ কিলোমিটার সীমান্ত প্রহরা, চোরাচালান রোধ, মানব ও মাদক পাচার এবং আবশ্যক হলে অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজেও তাদের নিয়োগ করা হয়। এমন গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের ধারক বাহিনীটিকে অকার্যকর করে দেওয়ার হীন উদ্দেশ্যেই এ ধরনের ঘটনার ষড়যন্ত্র হতে পারে। সে ষড়যন্ত্রকে উদ্ঘাটন করা তদন্তকারীদের অন্যতম দায়িত্ব ছিল। তারা শুধু ২৫ ফেব্রুয়ারি দেখল। এর আগের কোনো কিছুই তাদের বিবেচনায় তেমনভাবে এল বলে মনে হয় না। এখন সরকারের আইন প্রতিমন্ত্রী যা জানেন তা আইন প্রয়োগকারী সংস্থারও জানা থাকার কথা। তা যদি থাকে তাহলে তাদের নিষ্ক্রিয়তা রহস্যজনক। আর যদি না থাকে তাহলে আইন প্রতিমন্ত্রীর তাদের তা দেওয়া শুধু নৈতিক নয়, আইনগত দায়িত্ব।
পিলখানা ট্র্যাজেডি আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায়। প্রয়োজন রয়েছে সফলভাবে এ কলঙ্ক মোচনের। বিডিআর ভেঙে দিয়ে নতুন বাহিনী বিজিবি গঠন করা হয়েছে। তারা দ্রুতই সংগঠিত হচ্ছে। যথাযথ প্রশিক্ষণও নিচ্ছেন নবনিযুক্ত সদস্যরা। দায়িত্ব পালনে তাঁরা সফল হবেন—এ প্রত্যাশা সবার। বর্ণিত ঘটনাটিতে যাঁদের বিচার হয়েছে, তাঁরা আইনের আওতায় আছেন। কিন্তু নেপথ্যের ষড়যন্ত্রকারীরা পার পেয়ে যাবেন কেন? তাঁদের আইনের আওতায় না আনলে মূল ঘটনার বিচার অসম্পূর্ণ থাকবে। কিছু ষড়যন্ত্রকারীর নাম-পরিচয় তো আইন প্রতিমন্ত্রী গণমাধ্যমে দিয়েছেন। তাঁদের বাইরে অন্য কারও থাকাও অস্বাভাবিক নয়। ন্যায়নিষ্ঠভাবে জোরালো তদন্ত করলে প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসবে। আর এটা উপেক্ষা করলে এর দায় বর্তাবে যাঁরা তা করছেন, তাঁদের ওপর। বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার শেক্সপিয়ার। তাঁর এক অনবদ্য রচনা হ্যামলেট। হ্যামলেট ডেনমার্কের যুবরাজ। তিনিই নাটকটির মুখ্য চরিত্র। তাঁকে বাদ দিয়ে এ নাটকের মঞ্চায়ন হবে অসম্পূর্ণ। তেমনি নেপথ্যের ষড়যন্ত্রকারীদের আইনের আওতায় আনতে না পারলে পিলখানা ট্র্যাজেডির বিচারও খণ্ডিত হতে বাধ্য।
সূত্র: প্রথম আলো
লেখক : আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
তারিখ: ফেব্রুয়ারী ২৫, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,