প্রতিশোধ সাময়িক শান্তি দেয় বটে, তবে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা তৈরি করে। যা ব্যক্তির চিন্তা আর আচরণে প্রকাশ পায়। এই সমস্যার কারণে প্রতিশোধপরায়ণ ব্যক্তি মানসিক শান্তি থেকে বহু দূরে থাকে। যে ‘অবিচার’কে কেন্দ্র করে সে প্রতিশোধ নিচ্ছে, তা নিয়ে তার মনে চিরস্থায়ী স্মৃতিক্ষত জমা হয়। এ প্রসঙ্গে ইংরেজ দার্শনিক, বিজ্ঞানী ও লেখক ফ্রান্সিস বেকন লিখেছিলেন ‘প্রতিশোধের মধ্য দিয়ে একজন মানুষ তার তথ্যগুলোকে সব সময় তাজা রাখে, যা হয়তো আপনা-আপনি শুকিয়ে যেত।’ আবেগের যে অংশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রতিশোধ কিন্তু সেটাকে মেরামত করতে পারে না, বরং সেই ÿক্ষতিগ্রস্ত আবেগকে আরও জটিল করে। প্রতিশোধের মধ্য দিয়ে মানুষ মূলত নিজের ওপরেই আরও অত্যাচার করে। এখন প্রশ্ন আসে, তাহলে কি অপরাধের জন্য শাস্তি থাকবে না? অবশ্যই থাকবে। কিন্তু এই শাস্তির মধ্য দিয়ে যেন কারও পুরস্কারকেন্দ্র তৃপ্ত না হয়। শাস্তি যেন হয় মানুষের সংশোধনের পন্থা মাত্র। শাস্তির উদ্দেশ্য আরেকজনের প্রতিশোধস্পৃহাকে তৃপ্ত করা নয়—শাস্তির উদ্দেশ্য শৃঙ্খলা আনা, অপরাধীকে সংশোধন করা এবং অবশ্যই পরবর্তী সময়ে এ ধরনের অপরাধ বা অবিচারের হার কমানো। শাস্তি, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রতিশোধস্পৃহার অস্ত্র হতে পারে না।
প্রতিশোধপরায়ণতা কোনো সমস্যার সমাধান নয়। বরং সমস্যা আরও বাড়ায়। প্রতিশোধ সাময়িক লাভ আর তৃপ্তি দেয় বটে কিন্তু কেড়ে নেয় দীর্ঘমেয়াদি শান্তি। প্রতিশোধপরায়ণতার মধ্য দিয়ে সভ্যতার সূচক কয়েক ধাপ নেমে যায়। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, ‘চোখের বদলে চোখ নিতে থাকলে এই পৃথিবীটা একদিন অন্ধ মানুষে ভরে যাবে।’ মনের দীর্ঘমেয়াদি শান্তি আনতে নিজেকে সভ্য দুনিয়ার সদস্য হিসেবে প্রমাণ করতে প্রতিশোধস্পৃহা ত্যাগ করতেই হবে।
কর্মক্ষেত্রে প্রতিশোধ
মার্কিন গায়ক, অভিনেতা ও প্রযোজক ফ্রাংক সিনাত্রা বলেছেন ‘সবচেয়ে বড় প্রতিশোধ হচ্ছে আরও, আরও বড় সফলতা’। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে নিজের সফলতার চেয়ে অপরের পাতে কী আছে, সেটা দেখতে গিয়েই প্রতিশোধের নেশা তৈরি হয়। ‘আরেকজন কেন আমার চেয়ে এগিয়ে গেল’, ‘ক্ষমতাবান ব্যক্তি কেন আমার নাম উচ্চারণ না করে আরেকজনের নাম উচ্চারণ করলেন’, ‘আরেকজন কেন ফাঁকি দেয়’, ‘আমি কেন অমুকের চেয়ে পিছিয়ে আছি’, ‘ওকে এবার বাগে পেয়ে নিই-এমন শিক্ষা দেবে বাবার নাম ভুলিয়ে দেব’, ‘আমার কেন প্রমোশন হয় না’—এসব ভাবতে ভাবতে নিজের সাফল্যের জন্য করণীয় কাজগুলোই করা হয়ে হয়ে ওঠে না। ‘হেলদি রিভেঞ্জ’ বলে একটি শব্দ আছে—সেটা হচ্ছে অপরের ক্ষতি না করে নিজের উৎকর্ষতা বাড়ানো।
কর্মক্ষেত্রে প্রতিশোধপরায়ণতা কমাতে যা করা উচিত:
নিজের কাজের দিকে মন দিন
অপরের সমালোচনার কারণে পিছিয়ে পড়বেন না
প্রতিদিন আরেকটু এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুন
মস্তিষ্কের পুরস্কারকেন্দ্রকে তৃপ্ত করার জন্য নিজের লক্ষ্য অর্জনকে সবচেয়ে বড় পুরস্কার বলে ভাবতে শিখুন।
আরেকজন কী পেল, সেটা বড় কথা নয়—আপনি কী করেছেন সেটাই বড় কথা এবং নিজেরে অর্জনগুলোকে প্রকাশ করুন।
প্রতিযোগিতাকর্মের উদ্দীপনাকে বাড়ায় সত্য কিন্তু তা যেন প্রতিশোধ গ্রহণের মতো পর্যায়ে চলে না যায়।
রাগকে নিয়ন্ত্রণ করুন
কাজ শুরুর আগে প্রতিদিন মিনিট পাঁচেক চোখ বুজে সুন্দর কিছু ভাবুন, সুন্দর দৃশ্যের কথা কল্পনা করুন, একটি সুরেলা গান শুনুন।
যাদের সঙ্গ আপনাকে আরাম দেয়, তাদের সঙ্গে সময় কাটান
নিজের দিকে মনোযোগ দিন, সামাজিক দক্ষতা বাড়ান
ধূমপান, মাদকের ব্যবহার পরিহার করুন
অপরের কাছে নিজেকে পূর্ণভাবে মেলে ধরুন, আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করুন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নিজের মনকে আরেকজনের ওপর বিষিয়ে তুলবেন না
পরিবারে, সম্পর্কে প্রতিশোধ
পরিবারে, স্বামী-স্ত্রী বা ভাইবোনের সম্পর্কেও প্রতিশোধস্পৃহা দেখা যায়। সামান্য কারণে পছন্দের মানুষই হয়ে যেতে পারে সবচেয়ে দূরের। সেই তার সব ধরনের ক্ষতিই হয়ে উঠে চরম কাঙ্ক্ষিত। সম্পর্কের জটিলতা, ব্যক্তিত্বের সংঘাত আর বৈষয়িক ইস্যুগুলো নিয়েই সবচেয়ে বেশি রেষারেষি ঘটে। তখন প্রতিশোধই হয় পরস্পরের উপজীব্য। আরেকজনের শেষ না দেখে রাতের ঘুম হয় না।
সূত্রঃ আহমেদ হেলাল
সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, প্রথম আলো, অক্টোবর ২০১৮।
রেটিং করুনঃ ,