লেখক:মোজাহিদুল ইসলাম মণ্ডল।
৬৮ শতাংশ মানুষ মুঠোফোন পাশে নিয়ে ঘুমায়। বৈশ্বিক একটি জরিপের ভিত্তিতে ২০১২ সালে সিএনএন দিয়েছিল এই হিসাব। ১০ বছর পর সংখ্যাটা এখন নিশ্চয়ই বেড়েছে। কতটা বেড়েছে, তা বুঝতে চোখ রাখতে হবে স্মার্টফোনে ব্যবহৃত অ্যাপের হিসাবে। গত বছর প্রায় ২৩ হাজার কোটিবার ডাউনলোড করা হয়েছে বিভিন্ন অ্যাপ। ২০২১ সালে এ জন্য ব্যয় হয়েছে ১৭ হাজার কোটি মার্কিন ডলার।
এই সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসাব থেকে বের হয়ে এবার মানুষে ফেরা যেতে পারে। কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন, ‘পাগলি আমার ঘুমিয়ে পড়েছে/ মুঠোফোন তাই শান্ত,/ আমি রাত জেগে দিচ্ছি পাহারা/ মুঠোফোনের এই প্রান্ত/…’। মানুষ কতটা রাত জেগে মুঠোফোন পাহারা দেয়, সেই হিসাব না পাওয়া গেলেও, দিন কত ঘণ্টা মুঠোফোন ব্যবহার করে, তার একটি হিসাব পাওয়া যাচ্ছে মুঠোফোনের অ্যাপ পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান অ্যাপ অ্যানির কাছ থেকে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মানুষ দিনে গড়ে পাঁচ ঘণ্টা সময় ব্যয় করে মুঠোফোনে। আর এর ৭০ শতাংশ সময় ব্যয় হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার একটি গবেষণার বরাত দিয়ে ইকোনমিস্টের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের সঙ্গে একাকিত্বের সম্পর্ক রয়েছে। যিনি যত বেশি একাকী, তিনি অনলাইনে তত বেশি সময় ব্যয় করেন।
অনলাইনে এত সময় কাটানোর প্রভাব পড়ছে মানুষের মনোজগতে। এমনকি শরীরের ওপরও। এ প্রসঙ্গে নিউইয়র্ক টাইমসে একটি নিবন্ধে লিখেছেন দুই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জনাথন হাইড ও জিন এম টুয়েঞ্জ। এতে তাঁরা লিখেছেন, স্মার্টফোন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শুধু একজন ব্যক্তির ওপর প্রভাব ফেলে না, এই মহাবিশ্বে মানুষের যে স্বাভাবিক সম্পর্ক রয়েছে, তার ধরন বদলে দিয়েছে এই দুই অনুষঙ্গ। বন্ধু, পরিচিতজন, খুব কাছের মানুষ ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলছে মুঠোফোন। জীবনের যে স্বাভাবিক গতিবিধি, তা বদলে দিয়েছে এই যন্ত্র। প্রভাবটা যাঁদের মুঠোফোন আছে, শুধু তাঁদের ওপরই পড়ছে না; যাঁর মুঠোফোন নেই, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অ্যাকাউন্ট নেই, তাঁর জীবনেও এর প্রভাব পড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ইউনিভার্সিটি বলছে, স্মার্টফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে সামনাসামনি মানুষে মানুষে যোগাযোগের ক্ষমতা কমে যেতে পারে। মানুষের ভয়, উদ্বেগ বাড়ে। এমনকি গাড়ি দুর্ঘটনার প্রবণতাও বাড়তে পারে মুঠোফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে। ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো, ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজ ও ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটার গবেষকদের বরাত দিয়ে বিবিসি বলছে, মুঠোফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে পরীক্ষায় খারাপ ফল করা, অতিরিক্ত পানাহার, একাধিক যৌনসঙ্গী বেছে নেওয়ার প্রবণতার মতো সংকট দেখা দিতে পারে।
প্রভাবটা যে কেবল নেতিবাচক, তা নয়। স্মার্টফোন ব্যবহারের ইতিবাচক দিকও রয়েছে। সিএনএন বলছে, আরব বসন্ত থেকে শুরু বিভিন্ন দেশে এই স্মার্টফোনের কল্যাণে আন্দোলন নতুন গতি পেয়েছে। গণমাধ্যমটি একটি উদাহরণ তুলে ধরেছে। এতে বলা হচ্ছে, আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক স্কুলে বই পৌঁছানো সম্ভব হতো না। কিন্তু স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় সেখানকার অনেক স্কুলে এখন স্মার্টফোনের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক পিউ রিসার্চ মুঠোফোনের ব্যবহার নিয়ে ১১টি দেশে জরিপ চালিয়েছে। এতে বলা হচ্ছে, অধিকাংশ মানুষই মুঠোফোনের ব্যবহারের ইতিবাচক দিকগুলোয় বেশি জোর দিচ্ছে। তবে তারা স্বীকার করছে, এর কারণে ক্ষতি হচ্ছে। এরপরও ইতিবাচক দিকগুলোই প্রাধান্য পাচ্ছে। ভেনেজুয়েলার ৭১ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকার ৬৫ শতাংশ, ভারতের ৬৪ শতাংশ, ভিয়েতনামের ৬৩ শতাংশ, তিউনিসিয়ার ৫৪ শতাংশ, কলম্বিয়ার ৫০ শতাংশ মুঠোফোন ব্যবহারকারী বলছেন, এই যন্ত্রের কারণে তাঁদের সময়ের অপচয় কমছে, বরং সময় বেঁচে যাচ্ছে।
স্মার্টফোনের প্রভাব বা এর আসক্তিটা কীভাবে বোঝা যায়, তারও কিছু উপায় বলে দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, এই লক্ষণগুলো হলো, অন্য যেকোনো যন্ত্রের চেয়ে একজন মুঠোফোনটা বেশি ব্যবহার করছেন কি না, ফোনে থাকা সব কটি অ্যাপ ব্যবহার করা হচ্ছে কি না, সব কাজের জন্য মুঠোফোনে অ্যালার্ম দিয়ে রাখছেন কি না, ব্যবহারকারী যাবতীয় বিষয় মুঠোফোনেই পড়ছেন কি না, আয়ের একটি বড় অংশ ফোনের জন্য ব্যয় করছেন কি না, দিন শেষে মুঠোফোনে চার্জ থাকছে কি না, ফোন নষ্ট হলে ব্যবহারকারী কতটা মন খারাপ হচ্ছে, একই মুঠোফোন ব্যবহার করলে দুজন মানুষের দেখা হলে সেটা নিয়ে কথা বলছেন কি না, শৌচাগারে ও স্নানঘরে গিয়েও মুঠোফোন ব্যবহার করছেন কি না, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তবে ব্যবহারকারী মুঠোফোনে আসক্ত।
যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম সিএনবিসি এই আসক্তি থেকে বের হয়ে আসার বেশ কিছু উপায় বাতলে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে গণমাধ্যমটি বলছে, নিয়ম করে মুঠোফোন ব্যবহার করুন। প্রয়োজনে বিভিন্ন অ্যাপ থেকে আসা পুশ নোটিফিকেশন বন্ধ করে দিন। যে অ্যাপগুলো ব্যবহারে সময় বেশি যায়, সেগুলো হোম স্ক্রিন থেকে সরিয়ে ফেলুন। ফোন বিছানায় নেবেন না। সর্বোপরি, নিজের কাছে জবাবদিহি করুন।
মুঠোফোন ব্যবহারের ব্যাপারে সবচেয়ে বড় সতর্কবার্তাটি দিচ্ছেন জিন টুয়েঞ্জ। তিনি সান ডিয়াগো ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক। ‘আইজেন’ নামে একটি বই লিখেছেন তিনি। এই বইতে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, স্মার্টফোন কি একটি প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিচ্ছে? এর পক্ষে যুক্তিও তুলে ধরেছেন তিনি। এই অধ্যাপক দেখিয়েছেন, ১৯৯৫ সালের পর যাঁরা জন্মগ্রহণ করছেন, তারা কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় রয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, এর সঙ্গে মুঠোফোনের সম্পর্ক রয়েছে।
১৯৯৫ পর জন্ম নেওয়া একটি প্রজন্মের সঙ্গেই যে মুঠোফোনের হৃদ্যতা গড়ে উঠেছে, এমনটা নয়। মুঠোফোনের কল্যাণে সব প্রজন্মেরই এখন প্রযুক্তির সঙ্গে সখ্য। এর ক্ষতিকর দিক নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে কমবেশি সবারই। কিন্তু এর সঙ্গ ছাড়া বা কমানো কতটা সহজ, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। নয়তো কবি শ্রীজাত কি আর এমনি লেখেন, ‘শাখে শাখে ডাকে ভার্চ্যুয়ালের দিন/ আমাকে বরং প্রান্তিক বলে ভেবো/ বসন্ত আর সামলাতে পারছি না।/ মাঝে মাঝে শুধু আড়চোখে/ দেখে নেব—/ আমার স্ট্যাটাস শেয়ার করছ/ কি না।/….’
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ জানুয়ারী ২৩, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,