লেখা:অপূর্বানন্দ।
ভারতের গণতন্ত্রের মৌলিক কাঠামো ও চরিত্রকে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) অস্তিত্বসংকটে ফেলে দেবে, এমন একটি আশঙ্কায় ৯ বছর আগে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি যখন গদিতে বসেছিলেন, তখন থেকেই বিরোধী দলগুলো দৃশ্যত একজোট হচ্ছিল। দেশটির সবচেয়ে বড় বিরোধী দল কংগ্রেস পার্টির নেতা রাহুল গান্ধীকে তিন বছর আগে করা একটি মানহানি মামলার রায়ে সম্প্রতি গুজরাটের একটি আদালত দুই বছরের কারাদণ্ড দেন। এর পর পার্লামেন্ট থেকে রাহুলের বহিষ্কার হওয়ার ঘটনা সেই আশঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
মামলাটির শুনানি গ্রহণ, রায় ও সাজা দেওয়ার ধরন নিয়ে অনেক জুরি তীব্র সমালোচনা করেছেন। কিন্তু বিরোধীদের ঐক্যকে এটি অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে, পার্লামেন্টে রাহুল গান্ধীকে অযোগ্য প্রতিপন্ন করা সরকারের চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ একটি সংকেত। এ অবস্থায় বার্তা খুবই পরিষ্কার: বিরোধীদের এক হয়ে কাজ করার এটিই চূড়ান্ত সময়।
বহুদলীয় গণতন্ত্রের দেশ ভারতের অনেক বিরোধী দল এবং গ্রুপের নেতারা রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে নেওয়া এসব পদক্ষেপের অকুণ্ঠ সমালোচনা করেছেন। তাঁরা রাহুলের বিরুদ্ধে নেওয়া এ ব্যবস্থাকে মোদি সরকারের বিরোধী দলের নেতাদের অপমান ও ছোট করার চেষ্টার চূড়ান্ত পর্যায় হিসেবে দেখছেন। বিচার বিভাগ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ব্যবহার করে বিরোধী নেতাদের জনগণের সামনে অপরাধী প্রতিপন্ন করার সরকারি চেষ্টা যে ভয়ংকর মাত্রায় পৌঁছেছে, সেটি তাঁরা বুঝতে পারছেন।
সরকারের দমন–পীড়নের পাশাপাশি সরকারি ইঙ্গিত কার্যকরে বিচার বিভাগের সদা প্রস্তুত থাকার মনোভাব বিরোধীদের তথা ভারতীয় গণতন্ত্রের সামনে বাধার পাহাড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মুহূর্তটি সংসদীয় রাজনীতিকে ধরে রাখার জন্য অত্যাবশ্যকীয় সব ধরনের নাগরিক নিয়মকানুন ও দ্বিদলীয়তার ভেঙে পড়াকে চিহ্নিত করে।
বেশ কয়েকটি ঘটনায় দেখা গেছে, যেসব রাজ্যে মোদির বিজেপি হেরে গেছে, সেখানেও হয় প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো ভেঙে দিয়ে, না হয় রাজ্য সরকারকেই ভেঙে দিয়ে সেসব রাজ্যে ক্ষমতা দখল করে আছে। এই বিজেপি সরকার একটি অস্বচ্ছ নির্বাচনী বন্ড স্কিমের মাধ্যমে নির্বাচনী তহবিলের একটি বিশাল অংশকে কোণঠাসা করেছে। এর অধীনে নির্বাচনী তহবিলের চাঁদাদাতাদের পরিচয় এবং দাতারা কাকে অর্থ দিচ্ছেন, তা প্রকাশ করার বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি।
এটি মনে রাখা দরকার, গণতন্ত্র বলতে শুধু শাসক দল ও বিরোধী দলকে বোঝায় না। এটি প্রতিষ্ঠানগুলোর সেই ভারসাম্যের বিষয়কেও বোঝায়, যা রাষ্ট্রক্ষমতাকে জবাবদিহিমূলক অবস্থায় রাখে। ভারতে এসব প্রাতিষ্ঠানিক যন্ত্র ইতিমধ্যেই বিজেপি কুক্ষিগত করে নিয়েছে। নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে অথবা সরকারের পক্ষ হয়ে কাজ করছে।
ভারতের করপোরেট জগৎও বিজেপির পেছনে থেকে ভূমিকা রাখছে। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী যেসব প্রতিষ্ঠান একসময় রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর নজরদারি করত, সেগুলোও বিভিন্ন আইন ব্যবহার করে ভেঙে ফেলা হয়েছে। গুজরাটের ব্যবসায়ী গৌতম আদানির ২০১৪ সালে থাকা সম্পদের পরিমাণ ৭০০ কোটি ডলার থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত কেমন করে ১০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে, রাহুল গান্ধীর এ প্রশ্নের জবাব এখনো মোদি সরকার দেয়নি।
রাহুল গান্ধী এর আগে মোদি ও আদানির মধ্যে বিশেষ সম্পর্ক আছে বলে যে অভিযোগ করে আসছিলেন, আদানির শেয়ারবাজার প্রতারণা নিয়ে গত জানুয়ারিতে হিনডেনবার্গের প্রতিবেদন প্রকাশের পর সেই ধারণা আরও জোরালো হয়। এমনকি এটিকে সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি বলা হচ্ছে। আদানি অভিযোগের সত্যতা অস্বীকার করলেও শেয়ারবাজারের রায় যা পরিষ্কার করার, তা করে দিয়েছে। আদানির শেয়ার তলানিতে এসে ঠেকেছে এবং গ্রুপটি বিরাট আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। এই কেলেঙ্কারির পর রাহুল তাঁর অভিযোগ দ্বিগুণ করে দেন এবং পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে এ বিষয়ে পার্লামেন্টে বিশেষ আলোচনার এবং সংসদীয় তদন্তের দাবি জানান। তবে সরকার সংসদে অচলাবস্থা তৈরি করার মাধ্যমে সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করে।
এর মধ্যে রাহুল যুক্তরাজ্যে একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে দেওয়া ভাষণে বলেছিলেন, ভারতের গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়েছে এবং বৈশ্বিক গণতন্ত্রের স্বার্থে ভারতের গণতন্ত্রকে টেকানো জরুরি। ভারতের গণমাধ্যমগুলো ব্যবহার করে বিজেপির নেতারা রাহুলের এই বক্তব্যকে বিদেশের মাটিতে ভারতকে ছোট করা বক্তব্য ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজ হিসেবে প্রচার করেছেন। রাহুল গান্ধী পার্লামেন্টেই এর জবাব দিতে চাইলেও স্পিকার তাঁকে সে সুযোগ দেননি। এর মধ্যেই রাহুলের বিরুদ্ধে আদালত রায় দেন এবং তাঁকে পার্লামেন্ট থেকে বহিষ্কার করা হয়।
এই পটভূমিতে সব বিরোধী দল একজোট হয়ে ভারতের গণতন্ত্রের ওপর আসা হুমকির গভীরতা সম্পর্কে ভোটারদের ধারণা দিতে পারে। তবে তাদের সামনে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো। সংবাদমাধ্যমগুলোর বড় অংশ শাসকগোষ্ঠীর মুখপত্র হিসেবে কাজ করে; বিকৃত তথ্য দিয়ে বিরোধী দলগুলোকে ভোটারদের কাছে ছোট করার চেষ্টা করে এবং মুসলমান, খ্রিষ্টান ও বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের খেপিয়ে তোলে। বিরোধী দলগুলোকে এ চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হবে।
এ অবস্থায় ভারতের জনগণকে একছাতার তলায় আনতেই হবে। রাহুল গান্ধী সম্প্রতি ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ কর্মসূচিতে চার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছেন এবং বিজেপির হুমকি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার চেষ্টা করেছেন। সেই পটভূমিতে বিরোধী দলগুলোকে এক করার এ কাজের নৈতিক কর্তৃত্ব তাঁর আছে।
এখন তিনি পার্লামেন্ট থেকে বহিষ্কৃত হওয়ায় সংসদীয় বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হলেন এবং স্বাধীনভাবে দেশের অবস্থা সম্পর্কে রাজপথে গিয়ে সাধারণ মানুষকে বলতে পারবেন। মোদি সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে রাহুল একটি মন্দ শব্দও উচ্চারণ না করার পরও সরকার একের পর এক তাঁর ওপর আক্রমণ করায় বোঝা যাচ্ছে, সরকার তাঁকে কতটা ভয় পাচ্ছে। কিন্তু এ মুহূর্তে শুধু গান্ধীতে আটকে থাকলে হবে না। গান্ধীকে এখন জনদৃষ্টিকে তাঁর দিক থেকে ভারতের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের দিকে ফেরাতেই হবে।
*****আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
● অপূর্বানন্দ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:এপ্রিল ০১, ২০২৩
রেটিং করুনঃ ,