২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে বিমান হামলা হয়। এ ঘটনার পর বিশ্ব রাজনীতির গতি-প্রকৃতি আমূল বদলে যায়। সে বছর অর্থনীতির ক্ষেত্রে বড় আরেক ঘটনার সাক্ষী হয় বিশ্ব। সেই ঘটনাও পরবর্তীকালে বিশ্ব অর্থনীতির ধারা অনেকটাই বদলে দেয়।
সে বছর সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখে টুইন টাওয়ারে এ হামলা হয়। আর ১১ ডিসেম্বর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সদস্যপদ লাভ করে চীন।
চীন বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায় আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবেশ করার পর ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার সিংহভাগ দেশের গতি-প্রকৃতি বদলে যায়। শুধু তাই নয়, যেসব দেশের হাতে তেল ও ধাতুর মতো মূল্যবান সম্পদ আছে, তাদের সময়ও বদলে যায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব মনে করেছিল, চীনের মতো বড় দেশ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পেলে রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের পথেও হাঁটবে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বলেছিলেন, মানুষ স্বপ্নপূরণের সক্ষমতা অর্জন করলে কথা বলার স্বাধীনতাও দাবি করবে।
কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের সেই কৌশল হালে পানি পায়নি। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য হওয়ার পর চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। এখন তারা অনিবার্যভাবে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতি হওয়ার পথে এগোচ্ছে। ২০০০ সালে চীনের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির আকার ছিল পাঁচ ট্রিলিয়নেরও কম, সেই চীনা জিডিপি ২০১০ সালে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। এরপর রকেটের গতিতে এগিয়েছে তারা। ২০২১ সালে তাদের জিডিপির আকার ১৭ দশমিক ২১ ট্রিলিয়ন ডলার হয়ে যাবে।
২০০০ সাল পর্যন্ত বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত ম্রিয়মাণ। প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন ধরনের সস্তা পণ্য উৎপাদন করত তারা। তার যে গুরুত্ব ছিল না তা নয়, কিন্তু তা কোনোভাবেই বিশ্বকে বদলে দেওয়ার মতো ছিল না।
কিন্তু ধীরে ধীরে চীন উঠে আসতে শুরু করে। তার উত্থানের সঙ্গে বিশ্ব ব্যবস্থাতেও বড় পরিবর্তন আসতে শুরু করে। এ উত্থানের পেছনে চীনের জাতিগত ঐকমত্য প্রধান ভূমিকা পালন করেছে—চীনা শ্রমিক শ্রেণির আকাঙ্ক্ষা, উচ্চ প্রযুক্তির কারখানা, চীনা সরকারের সঙ্গে পশ্চিমা বহুজাতিক করপোরেশনগুলোর বিশেষ সম্পর্ক—এসব কিছুই চীনের এ রূপান্তরে বড় ভূমিকা পালন করেছে।
চীন ধীরে ধীরে বিশ্বের বৃহত্তম কোম্পানিগুলোর সরবরাহব্যবস্থায় ঢুকে পড়ে। সস্তা শ্রম তার জন্য আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ায়। অর্থনীতিবিদেরা এর নাম দিলেন সাপ্লাই শক বা সরবরাহব্যবস্থায় ধাক্কা হিসেবে। চীনের এ প্রবেশ নিঃসন্দেহে বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থায় বড় ঝাঁকুনি দেয়। এর প্রভাব এখনো সারা পৃথিবীতে অনুভূত হচ্ছে।
এখন দেখা যাক বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় প্রবেশের মধ্য দিয়ে চীন কী অর্জন করেছে। প্রথমত, চীন ইতিমধ্যে চরম দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে। ২০০১ সালে চীনে চরম দরিদ্র ছিল ৫০ কোটি মানুষ, এখন যা কার্যত শূন্যে নেমে এসেছে, কারণ হিসেবে অর্থনীতিবিদেরা জানান, এ সময় চীনা অর্থনীতি ১২ গুণ বেড়েছে। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো চীনের কাছ থেকে যা কিনেছে, সেই ব্যবসা হয়েছে চীনা ব্যাংকগুলোর মধ্য দিয়ে, ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ফুলেফেঁপে উঠেছে।
২০০০ সালে চীন ছিল বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম রপ্তানিকারক। তবে শীর্ষ স্থানে উঠে আসতে খুব একটা সময় লাগেনি তার। প্রবৃদ্ধির হার শনৈঃ শনৈঃ বাড়তে থাকে। প্রবৃদ্ধির হার একসময় ১৪ শতাংশেও ওঠে। বলা হয়, একটি দেশের বাণিজ্য সক্ষমতা বোঝা যায় কনটেইনারবাহী জাহাজের সংখ্যা দিয়ে। ডব্লিউটিওতে যোগ দেওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে চীনা বন্দরে জাহাজ আসা-যাওয়া দ্বিগুণ হয়ে যায়—চার কোটি থেকে আট কোটি। আর ২০১১ সালে তা তিনগুণ বেড়ে দাঁড়ায় ১২ কোটি ৯০ লাখে। ২০২০ সালে তা ছিল ২৪ কোটি ৫০ লাখ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসব জাহাজের অর্ধেক কনটেইনার চীনে আসে খালি হয়ে আর চীন থেকে ফেরত যায় ভর্তি হয়ে।
চীন কার্যত বহুমুখী নীতি অনুসরণ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক বাণিজ্য প্রতিনিধি বার্সেস্কি বিবিসিকে জানান, চীন অনেক দিন ধরেই দ্বিমুখী নীতিতে চলছে। তারা রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক অবস্থা আরও সংহত করেছে। নির্দিষ্ট কিছু শিল্পে তারা বিপুল ভর্তুকি দিয়েছে। বাস্তবে চীন ছাড়া এখন বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থা একরকম অচল। এর মধ্য দিয়ে তারা আবারও বড় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
প্রযুক্তির ক্ষেত্রও সেটা ঘটেছে। মার্কিন কোম্পানিগুলোকে চীনা কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে ব্যবসা করতে বাধ্য করেছে তারা। আর মার্কিন এই কোম্পানিগুলোর অভিযোগ, চীনা কোম্পানিগুলো তাদের প্রযুক্তি চুরি করেছে।
ডব্লিউটিওর সদস্য হওয়ার মধ্য দিয়ে চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা বিশ্বের মতো হয়নি। বরং পশ্চিমা অর্থনীতিগুলো এখন অনেকটা চীনের মতো হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ ডিসেম্বর ১২, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,