লেখক: এ কে এম শহীদুল হক ইন্সপেক্টর জেনারেল, বাংলাদেশ পুলিশ
সম্প্রতি পুলিশ ও র্যাব ঢাকায় কয়েকজন নারী অভিযুক্তের বাসাবাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার এবং তাদের বাসা থেকে মদ ও অন্যান্য মাদকদ্রব্য উদ্ধার করেছে। কিছুদিন ধরে এ বিষয়ে দেশব্যাপী আলোচনা-সমালোচনা চলছে। পুলিশ-র্যাব মিডিয়া ব্রিফিং দিচ্ছে। টেলিভিশনে টকশো হচ্ছে। মিডিয়াও নানা রকম প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। অনেক কাহিনি লিখছে, উপস্থাপন করছে। সামাজিক মিডিয়া তো নিত্যনতুন কল্পকাহিনি সাজিয়ে দর্শক ও পাঠকদের কৌতূহল সৃষ্টি করছে।
দেশে যখন এমতাবস্থা তখন সুদূর লন্ডন থেকে বিশিষ্ট লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী পরীমণিকে তার ভাষায় হায়েনার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে একটি আবেদন বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠিয়েছেন এবং তা প্রকাশিত হয়েছে। তিনি লিখেছেন- পরীমণির বাসায় যেভাবে যুদ্ধযাত্রার মতো অভিযান করা হয়েছে, তাতে মনে হয়েছে, কোনো ভয়ংকর ডাকাতকে গ্রেপ্তার করতে ওই যুদ্ধযাত্রা। তিনি পরীমণির অভিযোগে গ্রেপ্তারকৃত বোট ক্লাবের সদস্যদের প্রতি ইঙ্গিত করে লিখেছেন, ওই শক্তিশালী মহলটি প্রশাসনের একাংশকে বশ করে এ ঘটনাগুলো সাজিয়েছে। হয়তো তার ধারণা থেকেই তিনি এ কথা বলেছেন।
গাফ্ফার চৌধুরী লন্ডনে অবস্থান করলেও দেশের অবস্থা ও চলমান বিষয়াবলির ওপর নজর রাখেন। নিয়মিত কলাম লেখেন। তার লেখা থেকে সচেতন ব্যক্তিবর্গ অনেক তথ্য পেয়ে থাকেন। পরীমণির বাসায় পরিচালিত অভিযান সম্পর্কে করা পর্যবেক্ষণ তার অবস্থান থেকে ঠিকই আছে। একজন নারীকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের কারণে গ্রেপ্তার করতে হলে বা তার বাসায় তল্লাশি চালাতে হলে এত সংখ্যক র্যাব সদস্যের প্রয়োজন আছে কিনা- তা অনেকের মধ্যেই প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। তা ছাড়া র্যাব দেশের একটি এলিট ফোর্স। জঙ্গি তৎপরতা, খুন, রাহাজানি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যখন চরম অবনতি ঘটে, তখন বিএনপি-জামায়াত সরকার ২০০৪ সালে র্যাব গঠন করে। উদ্দেশ্য- র্যাব জঙ্গি, সন্ত্রাসী, অবৈধ অস্ত্রধারী এমন গুরুতর অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযান করবে। লঘু প্রকৃতির অপরাধ নিয়ে তারা কাজ করবে না। কাজেই পরীমণির বাসায় র্যাব যখন অভিযান চালাচ্ছিল, তখন মানুষের মনে হচ্ছিল- সেখানে বড় ধরনের কোনো অপরাধী লুকিয়ে আছে। অভিযানের পর জানা গেল, সেখানে কিছু মাদকদ্রব্য পাওয়া গেছে, যা র্যাব জব্দ করেছে। ভয়ংকর কোনো অপরাধী ছিল না। পরীমণির বাসায় অভিযান হচ্ছে শুনে তার বাসায় তার ভক্তরা, উৎসুক জনতা ও মিডিয়াকর্মীরা জড়ো হয়ে ভিড় করতে পারেন- হয়তো এমন আশঙ্কা ছিল। এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে যাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, সে জন্যই হয়তো অভিযানে অধিক সংখ্যক ফোর্স নেওয়া হয়েছে। এটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটা কৌশল।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়ে শর্তসাপেক্ষে যে কেউ অ্যালকোহল পান করতে পারে। কিন্তু বিপুল পরিমাণ অ্যালকোহল সংগ্রহ করে বাসাবাড়িতে মিনি বার তৈরি করে বাইরের লোক দাওয়াত দিয়ে এনে ককটেল পার্টি দেওয়া আইনের পরিপন্থি। কাজেই পরীমণির বাসায় এ ধরনের বার থাকার গোপন সংবাদ বা অভিযোগ পেলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালাবে- এটাই স্বাভাবিক। র্যাব তাই করেছে। খোলা চোখে বাড়াবাড়ি মনে হলেও আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।
এখন প্রশ্ন হলো- পরীমণি গ্রেপ্তারের পর তার বিরুদ্ধে এত স্ক্যান্ডাল ছড়াচ্ছে কারা? আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী যাদের দিকে অঙ্গুলি প্রদর্শন করছেন, সত্যিকারভাবে তারাই স্ক্যান্ডাল ছড়াচ্ছেন কিনা, তা তো বলা যাবে না। পর্দার আড়াল থেকে কে কী করে, তা প্রমাণ না করে মন্তব্য করা ঠিক নয়। তবে কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণের জন্য নির্ভরযোগ্য ও পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ না পেলে এমন কোনো তথ্য বা কথা জনসমক্ষে প্রকাশ করা বা বলা সমীচীন নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হোক বা মিডিয়াকর্মী হোক, কারোরই উচিত নয় এ ধরনের তথ্য প্রকাশ করা। এতে সংশ্নিষ্ট ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়।
ইদানীং লক্ষ্য করা যায়, কোনো আলোচিত বিষয়ের ওপর পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা মিডিয়া ব্রিফিং করছেন। ইউনিটপ্রধান বা মামলার ঊর্ধ্বতন তদারকি কর্মকর্তা ছাড়া সবার মিডিয়া ব্রিফিং করা ঠিক নয়। একই ঘটনায় প্রতিদিন মিডিয়ার সামনে কথা বলতে হবে কেন? কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ বা কোনো অপরাধের নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য-প্রমাণ পেলে এবং তার ভিত্তিতে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা যাবে- এমন ক্ষেত্রেই মিডিয়াকে তথ্য দেওয়া যায়। প্রতিদিন কারও বিরুদ্ধে মুখরোচক ও চটকদার কথা বলে বাহবা নেওয়া বা দর্শক-শ্রোতার মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি করা মোটেও সমীচীন নয়। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের যেমন সতর্ক থাকতে হবে, তেমনি মিডিয়াকর্মীদেরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। বিচারের আগেই যাতে বিচার না হয়, অর্থাৎ মিডিয়া ট্রায়াল না হয়, সেদিকে সংশ্নিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
আমাদের সমাজে একটা প্রবণতা আছে। তা হলো কোনো নারী আপত্তিকর বা অস্বাভাবিক কিছু করলে বা কোনো অপরাধে জড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেলে তা ফলাও হয়ে জনসমক্ষে চলে আসে। মিডিয়ার মাধ্যমেই তা ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু যারা ওই নারীকে এ পথে এনেছে বা তাকে ব্যবহার করে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে, তারা সব সময় থেকে যায় পর্দার আড়ালে। তাদের জনসমক্ষে আনা হয় না। কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব করা বা কারও সঙ্গে দেশ-বিদেশে বেড়ানো তো আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ নয়। তদন্তের প্রাথমিক অবস্থায় এটা তো প্রমাণিতও নয়। তবে কেন এসব তথ্য মিডিয়ায় আসবে? যদি কেউ পেশাগত নৈতিকতা অনুসরণ না করে এরূপ তথ্য প্রকাশ করে, তবে অন্য পক্ষের পরিচয় কেন জনসমক্ষে আসে না? এটা তো নারীর প্রতি বৈষম্য ও অবমাননার শামিল।
সব দেশেই চিত্রজগতে চলচ্চিত্রশিল্পী অনেকের বিরুদ্ধে কোনো না কোনো স্ক্যান্ডাল ছড়ানোর চিত্র আমরা দেখেছি। কিন্তু এভাবে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে কারও মানহানির ঘটনা ঘটেছিল কিনা, আমার জানা নেই। অপরাধ প্রমাণের আগে কাউকে অপরাধী বলা উচিত নয়। এটা নীতি-নৈতিকতাবিরোধী।
পুরুষতান্ত্রিক পুঁজিবাদী সমাজে নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষের ভোগের সামগ্রী হিসেবে ব্যবহূত হয়। এটা বিভিন্ন সমাজে প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে। রাজা-বাদশাহরা বাইজি-নর্তকী রেখে মনোরঞ্জন করতেন। শিল্পবিপ্লবের পর যখন নগরায়ন শুরু হয়, তখন থেকেই নগরগুলোতে যৌনকর্মীর তৎপরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। দরিদ্র মেয়েরা এ পথে আসে। আবার উচ্চবিত্ত সমাজে এক শ্রেণির সুন্দরী ও স্মার্ট নারীর আনাগোনাও দেখা যায়। তারা পতিতাবৃত্তিতে জড়ায় না। তবে তাদের রূপের আকর্ষণে অনেক পুরুষই আকর্ষিত হয়। ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, আমলা, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, প্রভাবশালী ব্যক্তি ও ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের সঙ্গে এই নারীরা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলে। মৌমাছিরা পুষ্পরস অন্বেষায় ফুলের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়। বিনিময়ে তাদের বিলাসী ও কথিত গার্লফ্রেন্ডের পেছনে বিপুল অঙ্কের অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে। এভাবে সোসাইটি গার্ল হিসেবে পরিচিত অনেকেরই আয়-রোজগারের ব্যবস্থা হয়। কেউ কেউ বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিকও হয়।
নারীদের আকর্ষণে সমাজের নামিদামি ব্যক্তিরাও সেক্স স্ক্যান্ডালে জড়িয়ে পড়েন। রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তি, মন্ত্রী, আমলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাগুরুদেরও যৌন কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে যাওয়ার সংবাদ ও অভিযোগ প্রায়ই পাওয়া যায়। অতি সম্প্রতি যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের গভর্নর অ্যান্ড্রু কুয়োমো পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। এটা সমাজব্যবস্থার ফল কিনা, তা সমাজবিজ্ঞানীরা বলবেন। কিন্তু সোসাইটি গার্ল সমাজেরই প্রোডাক্ট। নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং ব্যক্তিবিশেষের বিকৃত লালসা ও মানসিকতাও এর প্রধান কারণ। একটা দেশের আর্থ-সামাজিক, অপসংস্কৃতি বা সংস্কৃতির অতি আধুনিকতাও এ দায় এড়াতে পারে না। সমাজ থেকে এ প্রবণতা নির্মূল করা হয়তো কখনও সম্ভব হবে না।
তদন্তে গ্রেপ্তারকৃত অভিযুক্ত নারীদের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ-সংশ্নিষ্টতার সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে আদালতে তাদের বিচার হবে। এ ক্ষেত্রে কারও কিছু বলার নেই। কিন্তু তারা যেন কারও কোনো প্রতিহিংসার শিকার হয়ে হয়রানি না হন, তা সচেতন মহলের কাম্য। আদালত কর্তৃক অপরাধ প্রমাণের আগে চরিত্র হনন, তাদের অপরাধী হিসেবে আখ্যায়িত করা সমীচীন নয়। এ আচরণ তাদের প্রতি অবিচারের সমতুল্য। বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তার আবেদনে সে কথাই বলেছেন। সচেতন নাগরিকদেরও একই প্রত্যাশা। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক- জনগণ তা দেখতে চায়।
সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল, বাংলাদেশ পুলিশ
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: আগষ্ট ১৯, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,