লেখক: রাফসান গালিব প্রথম আলো’র সহসম্পাদক।
একে কি আমরা চিত্রনায়িকা পরীমনির সৌভাগ্য হিসেবে বিবেচনা করব? শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ মহামারির কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে গোটা দেশের আলোচনায় থাকা কি চাট্টখানি কথা! বাংলা সিনেমার ইতিহাসের কোন রথী–মহারথী তারকার এমন সুযোগ হয়েছে? দুই দিন ধরে বাসা থেকে গলিতে বের হলে, সকালের নাশতা করতে হোটেলে ঢুকলে, চা খেতে টং দোকানে গেলে, ফেরিওয়ালার কাছে সবজি কিনতে গেলে কিংবা অফিসে আসতে রিকশায় উঠলে সর্বত্র একটাই নাম—পরীমনি। এর মধ্যে অবশ্য কারও কোনো স্বজন বা পরিচিতজনের মৃত্যুসংবাদ নিয়েও শোক বা আফসোস কম হচ্ছে না। কিন্তু দেশের প্রায় সব সংবাদমাধ্যম যেন পরীমনিকে নিয়ে নিজেদের রেটিং বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমে গেছে। চিত্রনায়িকাই এখন তাদের কাছে হয়ে উঠেছে আকর্ষণীয় সংবাদপণ্য।
এ জন্য আমাদের সংবাদমাধ্যমগুলো মূলত যে দিকে মনযোগ দিয়েছে, তা হচ্ছে, ‘গ্রাম থেকে’ উঠে আসা পরীমনির ‘উচ্চাভিলাষ’, ‘উচ্ছৃঙ্খল’ চলাফেরা বা তিনি কয়টি বিয়ে করেছেন— এসব দিকে। উপস্থাপন ভঙ্গিতে এটা স্পষ্ট যে এসব যেন অনেক বড় অপরাধ। আমাদের সমাজ বলি বা সিনেমার জগৎ বলি, সবই যেন এক পবিত্র জায়গা, সেখানে এমন সব কর্মকাণ্ড করে পরীমনি ভয়ংকরভাবে আইন ভঙ্গ করে ফেলেছেন! তাঁকে গ্রেপ্তার অভিযান, নিরাপত্তা বাহিনীর বিশাল বহর, শত শত উৎসুক মানুষের ঢলও যেন সেটাই প্রমাণ করে। কোথায় যেন খবরে দেখলাম, সেই ভিড়ের মধ্যে এক ফেরিওয়ালা নাকি মাস্ক বিক্রি করে কয়েক দিনের আয় কামিয়ে নিয়েছেন। সময়ের কাজ অসময়ে বা অসময়ের কাজ সময়ে করা আমাদের রাষ্ট্র বা সরকারকে যেন বৃদ্ধাঙ্গুলিই দেখিয়ে দিলেন তিনি।
করোনায় প্রতিদিন এখন আড়াই শর মতো লোক মারা যাচ্ছে। পরিচিত বা আপন মানুষকে আমরা হারিয়ে ফেলছি। শেষবিদায়ে অংশ নেওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। এমন অসহায়ত্বের মধ্যে একের পর এক কথিত মডেল, নায়িকা বা তারকাকে নিয়ে একই ধরনের ঘটনা ‘উৎপাত’ ছাড়া কীই–বা হতে পারে। ‘রাতের রানি’ আখ্যা দিয়ে সেনসেশন তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু ‘রাতের রাজা’ কারা, তা কি আমরা জানতে পারব? নিরাপত্তা বাহিনীর একই ধরনের অভিযান, একই ধরনের অবৈধ জিনিসপত্র উদ্ধার, একই ধরনের অভিযোগ এবং একই ধরনের বক্তব্য নিয়েও হাস্যরসের শেষ নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখলাম একজন বললেন, সবার বাসায় থেকে উদ্ধার হওয়া মদের বোতলগুলোও একই হতে পারে! যদিও তা কী করে সম্ভব জানি না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে নানা কৌতুকও হচ্ছে। কার বাসায় অভিযান চালানো হলে কী মিলবে তা নিয়ে হাস্যরসও হচ্ছে। কেউ একজন কৌতুক করে লিখেছেন, নায়িকা শাবানার বাসায় অভিযান চালানো হলে বিপুল পরিমাণ সেলাই মেশিন মিলবে।
মহামারিতে এমন সব তামাশায় মেতে আছি আমরা। ফলে পরীমনিকে আটকের দিনই প্রথম আলোতে একটি বাক্রুদ্ধ খবর আমাদের মনোযোগ পায় না। বিয়ের ৯ বছর পর মা হয়েছিলেন লাবণী রায় নামে এক নারী। করোনা জটিলতা দেখা যাওয়ায় মেয়ে জন্ম দিয়েই তাঁকে যেতে হলো আইসিইউতে। লাবণীর বুক থেকে দুধ চিপে নিয়ে মেয়েকে খাওয়ান নার্স। এত বছর প্রতীক্ষা ও দীর্ঘ সংগ্রামের পর মা হয়েছিলেন লাবণী। মেয়েকে কোলেই নিতে পারলেন না তিনি, ঠিকঠাক দেখতেও পারল না। আইসিইউ থেকে ফেরা হলো না তাঁর। মেয়ের জন্মের পরপর নাম বলে যান—‘স্পৃহা’। একটি সন্তানের জন্য কী স্পৃহা বা আকাঙ্ক্ষা ছিল, সেটাই মেয়ের নামের মধ্যে বলে গেলেন লাবণী। গতকাল আরেক খবরে জানা হয়ে গেল, গোটা দেশে বাবা বা মা হারিয়ে এতিম হয়ে গেছে সাড়ে তিন হাজার শিশু। সেটিও আমাদের অনেকের নজর কাড়েনি নিশ্চিত।
সেদিন দেশের সবচেয়ে আলোচনার খবর হতে পারত এক বজ্রপাতেই একসঙ্গে ১৭ জন বরযাত্রীর মৃত্যুর ঘটনা। চাঁপাইনবাবগঞ্জে পদ্মাপাড়ে যে নৌকা করে বর–কনেকে আনতে গেলেন, সেটি করেই লাশ হয়ে ফিরত হলো। সারি করে খোঁড়া কবরেই দাফন হলো তাঁদের। দেশে বজ্রপাতের এক ঘটনায় কখনো এত মানুষের মৃত্যু হয়েছিল কি না জানা নেই। উন্নত বিশ্বের কোনো দেশে হইচই পড়ে যেত এমন ঘটনায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাতে কেন শতাধিক করে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, তা নিয়ে আমাদের কোনো ভাবনা নেই। ২০১৬ সালে তিন শতাধিক মৃত্যুর পর বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল সরকার। এরপর বজ্রপাত রোধে বিশেষ পরিকল্পনা এবং সতর্কীকরণ কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছিল জানি। এর জন্য জ্ঞান অর্জন করতে কর্মকর্তাদের পাঠানো হয় বিদেশ সফরে। ফিরে এসে তাঁরা কত দূর কী করলেন, তা–ও জানি না। কারণ, এসব নিয়ে আলোচনায় আমাদের কারও কোনো আগ্রহ নেই।
একইভাবে বলতে হয়, গ্রেপ্তার–আতঙ্কে স্বল্প বসনে লাইভে আসা পরীমনির ভিডিও নিয়ে হাসিঠাট্টা করা অবদমিত মানুষের কিছু আসে–যায় না একজন লিলি বেগম বা হাসানুজ্জামানের কান্নায়। সেদিন পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয় রূপগঞ্জে হাসেম ফুডস কারখানায় আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া শ্রমিকদের মৃতদেহ। হাসানুজ্জামানেরা কফিন জড়িয়ে বলে ওঠেন, ‘লাশ কই, সবই তো কঙ্কাল।’ কয়েক দিন আগে জানা গেল, সেই আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া ৫২ জনের ১৩ জন ছিল শিশু শ্রমিক। লিলি বেগমরা সন্তানের লাশ বুঝে পাওয়ার আগে কত সহজে জামিন নিয়ে বেরও হয়ে গেলেন কারখানার মালিক। লাশ দাফনের জন্য জনপ্রতি ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হলো। কিন্তু মৃত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ কী হবে, কে দেবে—কী হবে সেসব জেনে!
সেদিনের আরও একটি খবর নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা ছিল। ডেঙ্গুতে মারা গেছে ঢাকার এক সাংবাদিকের দশ বছর বয়সী ছেলে। আগস্টের প্রথম চার দিনেই সহস্রাধিক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত, এই খবরও। এখন পর্যন্ত মারা গেছেন দশজন, যার মধ্যে পাঁচজনই শিশু। এক মহামারির মধ্যে আরেক রোগের সংক্রমণে মানুষ মারা যাচ্ছে। আমরা বুঝতেও পারছি না। আমরা ভুলে গেছি, দুই বছর আগে ঠিক এই সময়ে ভয়াবহ ডেঙ্গু মহামারির ঘটনা। ২০১৯ সালে শুধু সরকারি হিসেবে মারা গিয়েছিল প্রায় ২০০ মানুষ। এবারও পরিস্থিতি তেমন হলে একসঙ্গে দুটি মহামারি কীভাবে সামাল দেব, সেই ভাবনাও কারও মধ্যে নেই।
পরীমনির বাসায় অভিযানের দিন সকালে বগুড়ায় লাশের অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে সড়ক আটকে দিয়েছিলেন পরিবহনশ্রমিকেরা। সেই অ্যাম্বুলেন্সে ছিল তাঁদেরই এক সহকর্মী মোহাম্মদ লিটনের লাশ। ঢাকায় পুলিশি হেফাজতে আত্মহত্যা করেছেন তিনি। পরিবারসহ শ্রমিকদের অভিযোগ, রিমান্ডে নির্যাতন করে তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে। তাঁকেও মাদক নিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। রিমান্ড বা পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু নিয়ে কিছুই বলতে চাই না। শুধু বলব, একটা সভ্য রাষ্ট্র আমরা কবে হতে পারব!
বিধিনিষেধ নিয়ে একের পর এক তামাশা তো দেখা হলো। গণটিকা কার্যক্রম নিয়েও সেটি শুরু হয়ে গেছে। গত দেড় বছরে স্বাস্থ্য খাতে এত অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কিছুই ঠেকানো গেল না। কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেই। বিশ্বের কত দেশে স্বাস্থ্যকর্তাদের বরখাস্ত বা পদত্যাগের ঘটনা দেখা হয়ে গেল। আর আমরা হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু বাড়িয়ে নির্লজ্জই থেকে গেলাম। এর বাইরেও প্রতিদিন কত কিছু ঘটে যাচ্ছে, কত কান্না ঝরছে। নায়িকার বাসায় পাওয়া মদের বোতলে আমরা সবকিছু ভুলে যাই কিংবা ভুলিয়ে দেওয়া হয়, কাঠি লজেন্সে ছেলে ভোলানো গল্পের মতো।
লেখক: রাফসান গালিব প্রথম আলো’র সহসম্পাদক।
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: আগষ্ট ০৭, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,