লেখক:মোক্তার হোসেন।
পোশাকশিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ আসে পোশাক খাত থেকে। সংগত কারণেই আমরা পোশাকশিল্প নিয়ে গর্ব করি। কিন্তু পোশাকশিল্পের বিকাশের সঙ্গে পরিবেশ বিপর্যয়ের যে ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে, তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রকৃত অর্থেই বিশাল হুমকি।
একটি পোশাকের মূল কাঁচামাল হলো কাপড়, যা তৈরি হয় সুতা থেকে। আর সুতা তৈরি হয় তুলা থেকে। তুলা উৎপাদনের সময় ফলন বৃদ্ধির জন্য গবেষণাগারে উদ্ভাবিত হাইব্রিড বীজ ব্যবহার করা হয় এবং তা উৎপাদনে জমিতে নানা রকমের কীটনাশক ব্যবহার করা হয়, যা মাটির জন্য খুবই ক্ষতিকর। কাপড় ও কাপড় থেকে পোশাক তৈরির সময় যে ধরনের রং এবং রঙের সঙ্গে যে ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়, তা পরিশোধন ছাড়া খোলা পরিবেশে ছেড়ে দেওয়া হলে পানিদূষণ, মাটিদূষণসহ নানা রকমের পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন, কারখানায় কাপড় ধোয়ার কাজে ব্লিচিং পাউডার ও অ্যাসিডের ব্যবহার খুবই সাধারণ বিষয়।
এ ছাড়া লবণ, পটাশসহ বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়, যা নিষ্ক্রিয় না করে যদি জলাশয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে সেই জলাশয়ের পানির অম্লত্ব অথবা ক্ষারত্ব বৃদ্ধি পেয়ে প্লাঙ্কটন, মাছসহ অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী মারা যাবে। এই দূষিত পানি যদি রান্নাবান্না, ধোয়ামোছা বা পানের কাজে ব্যবহার করা হয়, তাহলে পানিবাহিত রোগ, যেমন জন্ডিসসহ, চর্মরোগ, হৃদ্রোগ, ফুসফুসের জটিলতাসহ বিভিন্ন প্রকার ব্যাধি মহামারি আকার ধারণ করতে পারে।
আবার এই বর্জ্য কৃষিজমিতে ছাড়া হলে মাটির উর্বরতা হ্রাসসহ ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়ে জীববৈচিত্র্য নষ্ট হতে পারে। তবে দুই দশক ধরে পোশাকশিল্পের বর্জ্য পরিশোধনে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে বিশ্বের বড় বড় ব্র্যান্ড শতভাগ পানি পরিশোধনাগার নেই—এমন কারখানায় পোশাক উৎপাদন এবং যেসব রাসায়নিক পদার্থ মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর, সেসব রাসায়নিক পদার্থ তাদের পোশাক উৎপাদনে ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে।
একই সঙ্গে বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য পোশাক উৎপাদনের পর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নিশ্চিত করা হয় সেখানে সিসা, এজো-নিকেল, পিএইচ ও ফরামলডিহাইডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আছে কি না। পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনা করে মানবদেহের জন্য পণ্যটি নিরাপদ, তা প্রমাণিত হলেই কেবল সেই পণ্য রপ্তানির অনুমোদন দেওয়া হয়। ফলে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশেই পোশাক উৎপাদনের সময় মানুষের দেহের জন্য ক্ষতিকর নয়—এমন রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করেই পোশাক উৎপাদন করা হয় এবং কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য নিষ্ক্রিয় করেই পরিবেশে বিমুক্ত করা হয়। তবে এখনো তা শতভাগ বাস্তবায়ন না হলেও সিংহভাগ হয়েছে বলে দাবি করা যায়।
পোশাকশিল্পের নামীদামি ব্র্যান্ড, যেমন জারা, লিভাইস, গ্যাপ, আমেরিকান ইগলসহ অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান পরিবেশের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন। তারা ফ্যাশনের ধারা পরিবর্তনে বৈশ্বিক পরিবেশ রক্ষা এবং মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নয়, এই বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বের সঙ্গে রক্ষার চেষ্টা করে আসছে। যেমন, একসময় স্যান্ড ব্লাস্টিংয়ের (ধুলা দিয়ে কাপড়ে উপরিভাগের রং মুছে ফেলা) ব্যাপক প্রচলন ছিল, বর্তমানে তা বিশ্বব্যাপী নিষিদ্ধ। একই সঙ্গে এসব ব্র্যান্ড উৎপাদিত পণ্যের জন্য বেশ কিছু রাসায়নিক পদার্থ যেমন বেনজিডাইন, ক্লোরোএনিলিন, ক্রোসিডোলাই, ট্রিমোলাইটসহ অন্তত শতাধিক পদার্থ ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে, যা তারা পোশাক উৎপাদনের সময় থেকে শুরু করে তদারকি করে এবং সর্বশেষ পোশাকটি উৎপাদনের পর পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়।
নিষিদ্ধ এই রাসায়নিক পদার্থগুলোর তালিকা সংক্ষেপে আরএসএল লিস্ট বা রেসট্রিকটেড সাবস্ট্যান্স লিস্ট বলা হয়। সে কারণেই বর্তমানে সাসটেইনেবল গার্মেন্টস বা টেকসই পোশাক প্রস্তুতের দিকে প্রথম সারির ব্র্যান্ডগুলো এগিয়ে যাচ্ছে। যার অংশ হিসেবে রিসাইকেল্ড ইয়ার্ন অর্থাৎ পুরোনো পোশাক থেকে পুনরায় সুতা উৎপাদন করে (রিসাইকেল্ড ইয়ার্ন) সেই সুতা ব্যবহার, বেটার কটন, অরগানিক কটন, ওকা কটন (অরগানিক কটন এসকেলটর), রিসাইকেল্ড পলিস্টারের ব্যবহার দিন দিন বেড়ে চলছে। এসবের মধ্যে ওকা ও অরগানিক কটনের ব্যবহার পরিবেশের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ বলে কোনো কোনো ব্র্যান্ড চলতি বছরের মধ্যেই শতভাগ ওকা ও অরগানিক কটন ব্যবহার করার লক্ষ্যে কাজ করছে।
প্রসঙ্গত, অরগানিক কটন হলো বিশেষভাবে উৎপাদিত কটন, যা উৎপাদনে কোনো প্রকার ক্ষতিকর কীটনাশক কিংবা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কোনো প্রকার সার ব্যবহার করা হয় না এবং যার বীজও হাইব্রিড নয়। সে জন্য বীজ সংগ্রহ থেকে শুরু করে উৎপাদনের প্রতিটি ধাপ দ্য গ্লোবাল অরগানিক টেক্সটাইল স্ট্যান্ডার্ড (জিওটিস) নামের প্রতিষ্ঠান তদারকি করে এবং তার পোশাক উৎপাদনের প্রতিটি ধাপের জন্য সনদ পাওয়ার পর নিশ্চিত হয়ে সেই পোশাক কেনে। একই সঙ্গে পোশাক উৎপাদনের সময় এই কাপড় বিশেষ ব্যবস্থায় মজুত করা থাকে এবং উৎপাদনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে বিশেষ নজর রাখা হয়, যা একটি সুনির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান যাকে ‘কন্ট্রোল ইউনিয়ন’ বলা হয়, তাদের তদারকিতে হয়ে থাকে। এই কাপড় প্রস্তুতের সময় বিশেষ ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়, যা পরিবেশের জন্য তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিকর। তা ছাড়া যে ওয়াশিং প্ল্যান্টে এই পোশাক ধোয়া হয়, সেই প্ল্যান্টে শতভাগ কার্যকর ইটিপির (কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য পরিশোধন ক্ষেত্র) মাধ্যমে রাসায়নিক বর্জ্য সম্পূর্ণ শোধন করে পরিবেশে বিমুক্ত করা হয়।
সম্প্রতি কোনো কোনো ব্র্যান্ড জিরো ডিসচার্জ অর্থাৎ এক ফোঁটা পানিও পরিবেশে উন্মুক্ত করা হবে না, এই ব্যবস্থায় পোশাক উৎপাদনে কাজ শুরু করেছে। জিরো ডিসচার্জ পদ্ধতি এমনই এক বিশেষ ব্যবস্থা, যেখানে একটি পোশাক ধোয়ার কাজে ব্যবহৃত সম্পূর্ণ পানির শতভাগ রাসায়নিক পদার্থ নিষ্ক্রিয় করে সেই পানি পুনরায় ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতিতে পোশাক ধোয়া হলে পরিবেশের ক্ষতি হয় না। এর এই জিরো ডিসচার্জ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হলে পোশাক উৎপাদনে ব্যবহৃত ওয়াশিং প্ল্যান্টের পানি রিভার্স অসমোসিস (আরও) পদ্ধতিতে অথবা মেমব্রেন ফিল্টারেশনের মাধ্যমে পরিশোধন করে পানি এমনভাবে পরিষ্কার করা হয়, যা অনায়াসে পোশাক ধোয়ার কাজে ব্যবহার করা যাবে। এমনকি কেউ চাইলে তা পানও করতে পারবে।
একই সঙ্গে হ্যান্ড স্যান্ডিং, যাকে আমরা সিরিশ কাগজ বলি, সেই সিরিশ কাগজের মাধ্যমে হ্যান্ড স্যান্ডিংয়ের ব্যবহার বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তার পরিবর্তে বিকল্প হিসেবে লেজার রশ্মি ব্যবহার শুরু করেছে। পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট বা সংক্ষেপে পিপি ব্যবহার বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পটাশিয়াম ম্যাঙ্গানেট মানুষের জন্য খুবই ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ। ইউরোপের শীর্ষ ব্র্যান্ড জারা আগামী চার বছরের মধ্যে পটাশিয়াম পার ম্যাঙ্গানেট ব্যবহৃত পোশাক কেনাবেচা সম্পূর্ণরূপে বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে। বিষয়টি মাথায় রেখে কোনো কোনো কাপড় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ক্লিনকোর নামের এক নতুন ধরনের ডায়িং পদ্ধতি ব্যবহার করছে। এই ক্লিনকোর পদ্ধতিতে উৎপাদিত কাপড়ে শুধু লেজার রশ্মি ব্যবহার করলেই হ্যান্ড স্যান্ড ও পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ছাড়া প্রয়োজনীয় আকর্ষণীয় পোশাক প্রস্তুত করতে সক্ষম হবে।
পোশাকশিল্পসহ বিভিন্ন শিল্পে যে পানি ব্যবহার করা হয়, তার অধিকাংশই আসে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে। পৃথিবী ক্রমেই পরিবেশ বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কারণ, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর যদি নিচে নেমে যায়, তাহলে ভূমিকম্পের শঙ্কা বেড়ে যায়, যার ফলে সুনামি, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, মরুকরণসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
সংগত কারণেই এখন পানির ব্যবহারে যত্নশীল হওয়া সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে এবং সে জন্যই পৃথিবীর বড় বড় ব্র্যান্ড খুব কম পানিতে ধোয়া যায় এমন পোশাককে পরবর্তী ট্রেন্ড হিসেবে সাধারণ ক্রেতাদের জন্য প্রস্তুত করা খুব স্বল্প পরিসরে শুরু করেছে। যার অংশ হিসেবে ইদানীং ইউফ্লো, আপ সিস্টেম ওয়াশিং মেশিন যার মাধ্যমে খুবই কম পানিতে, খুব কম পরিমাণ রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে পোশাক উৎপাদন করা যায়, যেখানে অন্তত ৪০ শতাংশ পানি কম ব্যবহার হয় এবং তুলনামূলক কম রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারের মাধ্যমে। তা ছাড়া ওজোন নামে একধরনের বিশেষায়িত যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়েছে। এই ওয়াশিং মেশিন মূলত দুই প্রকার। এক প্রকার ওজোন মেশিন যাতে খুব কম পরিমাণ পানির প্রয়োজন হয়, আর অন্যটিতে কোনো প্রকার পানির প্রয়োজন পড়ে না। এই যন্ত্র মূলত প্রকৃতি থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে ওজোনে রূপান্তর করে।
একই সঙ্গে সাধারণ ব্যবহারকারীদের পানির সদ্ব্যবহার ও দীর্ঘদিন পোশাক ব্যবহারে উৎসাহিত করা হচ্ছে। সম্প্রতি জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, লন্ডন, ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বড় বড় ব্র্যান্ড শপে পুরোনো পোশাকের বিনিময়ে নতুন পোশাক দেওয়া হচ্ছে। সেই পুরোনো পোশাক সামান্য পরিবর্তন কিংবা পরিবর্তন ছাড়াই বিক্রি করা হচ্ছে। একটি পোশাক তৈরিতে প্রচুর পরিমাণ জ্বালানি, পানি ও শ্রমশক্তি ব্যবহৃত হয়। এগুলো সবই সীমিত। আর সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করতে পারলেই কেবল পৃথিবীর বাসযোগ্যতা টিকিয়ে রাখা যাবে, তা না হলে বিপদ।
***লেখা:মোক্তার হোসেন জ্যেষ্ঠ মার্চেন্ডাইজার, ইন্ডিটেক্স (জারা), বাংলাদেশ।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ জানুয়ারী ০১, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,