হুট করে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন। বৃহস্পতিবার (১৯ জানুয়ারী, ২০২৩) তাঁর এই ঘোষণায় অবাক হয়েছেন বিশ্বের বহু মানুষ। তবে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেয়েছেন জেসিন্ডার নারী ভক্ত-অনুরাগীরা।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে জেসিন্ডা আরডার্নের দর্শন, উদারতা ও দক্ষতা তাঁকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। তিনি অনেক নারীর আদর্শ। কারণও আছে। একে তো সবচেয়ে কম বয়সী নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিউজিল্যান্ডের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি, তারপর আবার সরকারপ্রধানের কাজের চাপ সামলিয়ে সন্তান লালনপালন করে তাক লাগিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সন্তানের জন্ম দেওয়ার ঘটনা কিন্তু বেশ বিরল। জেসিন্ডা আরডার্নের আগে মাত্র একজন নারীই প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে সন্তানের জন্ম দেন। তিনি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো। এই দুই নারীকেই সন্তান পালন ও দেশ সামলানোর কঠিন কাজ একসঙ্গে চালিয়ে যেতে হয়েছে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে শিশুসন্তান নিভকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হন জেসিন্ডা আরডার্ন
এই দুই দায়িত্ব একসঙ্গে পালন করতে গিয়ে হয়তো বেশ চাপে ছিলেন জেসিন্ডা আরডার্ন। তবে তাঁর পদত্যাগের পেছনে যে রাজনৈতিক কারণও রয়েছে, তা কিন্তু একেবারে স্পষ্ট। এমন সময় জেসিন্ডা আরডার্ন পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন যখন নিউজিল্যান্ডের রাজনীতিতে প্রতিকূল হাওয়া বইছে। জীবনযাপনের বাড়তি খরচ ও অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় শঙ্কিত দেশটির মানুষ। এসবের জেরে তাঁর জনসমর্থনও কমেছে।
সমস্যা সব দেশেই থাকে। সরকারপ্রধানদের তা মোকাবিলাও করতে হয়। তবে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর জেসিন্ডা আরডার্নকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। বলা যায়, করোনা মহামারি, ক্রাইস্টচার্চ শহরে মসজিদে হামলা ও আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের কথা। বৃহস্পতিবার পদত্যাগের ঘোষণায় জেসিন্ডা আরডার্ন বলছিলেন, তাঁকে একের পর এক বড় সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
নিজ দেশের মানুষের সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে জেসিন্ডা আরডার্নকে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র কয়েক মাস পর যখন তিনি অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার খবর দিয়েছিলেন, তখন বিষয়টি নিয়ে কথা উঠেছিল। এ ছাড়া মাত্র ছয় সপ্তাহ মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়েও আলোচনার কেন্দ্রে ছিলেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী। অনেকের মনে হয়েছিল, ছুটির সময়টা খুবই কম হয়েছে।
সে সময় এ নিয়ে জেসিন্ডা আরডার্ন বলেছিলেন, ‘নিভ (মেয়ে) এখনো অনেক ছোট। তার সব চাহিদা আমি পূরণ করতে পারছি কি না এবং পাশাপাশি দেশের জন্য ঠিকঠাকভাবে দায়িত্ব পালন করছি কি না—এমন চিন্তা মাথায় আসবে, তা আমি জানতাম। তবে আমার এই আত্মবিশ্বাস আছে যে সবার সহায়তায় আমি সবকিছু সামলে নিতে পেরেছি।’
তবে হ্যাঁ, মা হিসেবে যে জেসিন্ডা আরডার্নের খাটুনি কম হয়নি তা প্রকাশ পেয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর বিভিন্ন পোস্টে। সেখানে মানুষ দেখেছে মেয়ের জন্মদিনে সুন্দর একটি কেক বানাতে গিয়ে কতটা পরিশ্রম করেছেন তিনি। এমনকি জ্যাকেটে ডায়াপার ক্রিমের দাগ নিয়ে সারা দিন একের পর এক সরকারি বৈঠক করার ঘটনাও সবার সামনে হাসিখুশিভাবে তুলে ধরেছেন তিনি।
তবে শেষ পর্যন্ত একজন রাজনীতিককে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, তা পদত্যাগ নিয়ে জেসিন্ডা আরডার্নের বক্তব্যে উঠে এসেছে। এ সময় তাঁর গলা কাঁপছিল। তিনি বলেন, ‘রাজনীতিকেরাও মানুষ। যতক্ষণ সম্ভব আমরা সবকিছু শুধু দিয়েই যাই। তারপর শেষ সময়টা চলে আসে। আমার জন্য এটা শেষ সময়। আমি জানি, এই দায়িত্বের জন্য আমাকে কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে।’
:::জেসিন্ডা আরডার্ন: প্রগতিশীল রাজনীতির বৈশ্বিক ‘মূর্ত প্রতীক’:::
পরিবারের সঙ্গে আরও বেশি সময় কাটাতে সব সময় মুখিয়ে থাকতেন বলে বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন জেসিন্ডা আরডার্ন। বলেন, তিনি চাইতেন যখন তাঁর সন্তান স্কুলে পা রাখবে, তখন তিনি পরিবারের সঙ্গেই থাকবেন। এরপরই সঙ্গী ক্লার্ক গেফোর্ডের কাছে বিয়ের কথা পাড়েন তিনি।
তবে শুধু পরিবারই নয়, জেসিন্ডা আরডার্নের পদত্যাগের পেছনে রাজনৈতিক হিসাব–নিকাশও আছে। নিউজিল্যান্ডের মানুষের ‘জেসিন্ডাপ্রীতির’ কারণে একসময় তিনি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠেছিলেন। তবে করোনার ধাক্কায় দেশবাসীর সঙ্গে তাঁর সেই সম্পর্ক অনেকটাই তিক্ত হয়ে পড়েছে। করোনার পর এখন অর্থনৈতিক সংকটের মুখে নিউজিল্যান্ড। এতে করে বেড়েছে জীবনযাপনের খরচ। গভীর হয়েছে সামাজিক বৈষম্য।
মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে করা একটি জরিপে দেখা গেছে, ২০১৭ সালের আগস্টের পর জেসিন্ডা আরডার্নের জনপ্রিয়তা সবচেয়ে কমেছে। তাঁর দল লেবার পার্টিরও জনসমর্থনে কিছুটা ভাটা পড়েছে। বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে নিজের সম্মান ধরে রাখতেই হয়তো পদ ছেড়েছেন তিনি। জেসিন্ডা আরডার্ন চাচ্ছেন না টালমাটাল এই অর্থনীতির কারণে পরবর্তী নির্বাচনে তাঁর ও তাঁর দলকে লজ্জাজনক পরাজয় মেনে নিতে হয়।
পদত্যাগের কারণ যদি এটাও হয়, তারপরও আজকের শক্তিশালী বক্তব্যের মাধ্যমে তা হয়তো অনেকটাই সামাল দিতে পেরেছেন জেসিন্ডা আরডার্ন। তাঁর ভাষ্য এটাই ছিল যে নিজের সক্ষমতার সীমাটা জানা সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং সেটা মেনে নিয়েই নিজের সীমাবদ্ধতাকে সম্মান করতে হয়। তিনি বুঝিয়েছেন, নিজেকে সীমার বাইরে ঠেলে দিয়ে কোনো কাজই করা উচিত নয়। আর কারও যখন আর কিছুই দেওয়ার থাকে না, তখন দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোটাই শ্রেয়।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:জানুয়ারী ২০, ২০২৩
রেটিং করুনঃ ,